আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বলেই ফেললেন করোনা সেরে যাচ্ছে এই মহৌষধিতে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি আরও বললেন “মেডিসিনের ইতিহাসে এই ওষুধ অন্যতম বড় গেম চেঞ্জার”, তারপরই পৃথিবী জুড়ে উঠল ঝড়। এই বিষয়ে কোন এক দেশনেতার চাইতে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানীদের কথা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংক্রামক রোগসংক্রান্ত পরামর্শদাতা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডা অ্যান্থনি ফসি কিন্তু পরিষ্কার ভাবেই জানিয়ে দিলেন এই ওষুধটির কোভিড -১৯ চিকিৎসায় ভূমিকা তেমন কিছু বিশ্বাসযোগ্য না। তাহলে কেনই বা এত হৈ চৈ এই ওষুধকে নিয়ে?
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি?
এটি একটি অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ। ম্যালেরিয়া ছাড়াও এটি অন্য কানেক্টিভ টিস্যু ডিসঅর্ডার যেমন লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, জোগ্রেন সিন্ড্রোম, ইত্যাদি রোগে ব্যবহার হয়। এটি কাজে বা গঠনগত দিক থেকে অনেকটাই আমাদের খুব পরিচিত ওষুধ, অন্য আর এক অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধ ক্লোরোকুইনেরই মত। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্লোরোকুইনের থেকে একটু কম।
কেন হঠাৎ এই ওষুধ দিয়ে করোনা চিকিৎসা?
দক্ষিণ ফ্রান্স-এর নামকরা ইউনিভার্সিটি ‘মেডিটেরিয়ান ইনফেকশান ইউনিভার্সিটি হসপিটাল ইনস্টিটিউট’। সেখানকার বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪৮ জন করোনা রোগাক্রান্ত মানুষের উপর প্রয়োগ করলেন এই ওষুধ। কিছু দিন আগে কিছু চীনের বিজ্ঞানীরা বলেছেন মানব শরীরের বাইরে এই ওষুধটি দিয়ে কোভিড-১৯ এর ভাইরাসকে মারা সম্ভব। দিশেহারা পৃথিবীকে ফরাসী বিজ্ঞানীরা শোনালেন আশার কথা। এই ওষুধটির প্রয়োগে তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে রোগীদের শরীর থেকে হাওয়া এই ভয়ানক ভাইরাস। এই ৪৮ জনের মধ্যে অবশ্য ছয় জন সাথে পেয়েছেন অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মত অন্য আর একটি ওষুধ। এই পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়েই আশান্বিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
কতটা নির্ভরযোগ্য এই রিপোর্ট?
সম্প্রতি ‘ল্যানসেট রিউম্যাটোলজি’ পত্রিকায় এই বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ আর ভাইরোলজি বিভাগের ডাক্তার ডগলাস রিচম্যান বললেন “মানব শরীরের বাইরে কোন ভাইরা্রসে বিরুদ্ধেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা সেইভাবে প্রমাণিত নয়, এমনকি ইনফুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপরেও এটি কার্যকর নয়। এটা আমার ব্যক্তিগত মত যে করোনা ভাইরাসের উপরেও এটি তেমন কার্যকর হবে না।”
ফরাসী যে বিজ্ঞানীরা করলেন এই ড্রাগ ট্রায়াল, তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করে নিলেন তাঁদের পরীক্ষা হয়েছে অত্যন্ত কমসংখ্যক মানুষের ওপরে যেটার স্ট্যাটিসটিকাল সিগনিফিক্যান্স খুব কম। তাছাড়া এই পরীক্ষা চলাকালীন ৬ জন মানুষ হয়ে যান ‘ড্রপ আউট ‘ আর এই ওষুধ দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী ফল তাঁরা দেখে উঠতে পারেননি। কাজেই তাঁদের নিজেদের কথাতেই শোনা গেল একরাশ সংশয়।
তাছাড়াও একটা ওষুধ মানবশরীরে প্রয়োগের আগে যে যে পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, এই ওষুধটি কিন্তু সেই সব শর্ত পূরণ করেনি।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
চিকিৎসক মহলে এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সর্বজনবিদিত। বমি বমি ভাব, মাথার যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, ওজন কমে যাওয়া ছাড়া মানসিক অবসাদ তৈরি করতে পারে। এছাড়াও যাঁদের জি ৬ পি ডি নামের এনজাইম কম বা অনুপস্থিত থাকে আর কারো কারো হার্টের কিউ টি প্রলংগেশন করে এই ওষুধে জীবনহানিও হতে পারে।
আই সি এম আর কি বলছে?
এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে চিকিৎসক মহল চলছেন এই সংস্থার বিজ্ঞানীদের কথা শুনেই। তাঁরা কিন্তু হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে কেবলমাত্র যাঁরা এই রোগের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী অথবা করোনা আক্রান্তের বাড়ির লোক বা পরিজনদেরই প্রতিরোধক হিসাবেই দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্যে নয়।সেটাও অবশ্যই যেন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে নেওয়া হয়। আমাদের দেশে আর আমেরিকাতে এই ওষুধ খাওয়ার পর মৃত্যুর ঘটনাও কিন্তু আছে।
বাস্তবতা
সারা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানী আর দেশনেতাদের ঘুম কেড়েছে এই করোনা ভাইরাস। এমন এক অবস্থায় পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৪০ টি সংস্থা কাজ করছে ভ্যাকসিন নিয়ে। ঠিকঠাক প্রোটোকল মেনে এগুলি বাজারে সাধারণের ব্যবহারের জন্যে আসতে সময় লেগে যাবে প্রায় বছর খানেক। আমাদের হাতে থাকা ওষুধগুলো দিয়ে যদি এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সে নিয়েও চলছে পৃথিবী জুড়ে কাজ। কিন্তু সেটাও সময়সাপেক্ষ। এমন এক অবস্থায় ডুবন্ত মানুষের মত খড়কুটো যা পাওয়া যায় তাই ধরে বাঁচতে চাওয়াই হইয়ত খুব কঠিন বাস্তব। কিন্তু বিজ্ঞানের নিদান যদি শুনতেই হয় তা দেশনেতার চেয়ে বিজ্ঞানীদের মুখ থেকে শোনাই কি শ্রেয় নয়?
দেশনেতারা পলিসি তৈরী করবেন এটাতো পৃথিবীর নিয়ম। এই পলিসি তৈরী করার জন্য তাদের বিভিন্ন বিষয়ের উপদেষ্টা থাকেন। মেগালোম্যানিয়াক (বেশীরভাগ দেশ নেতা থেকে খুচরো নেতা প্রায় সবাই এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত) দেশ নেতা ততক্ষণই সেই উপদেষ্টাদের কথা শোনেন যতক্ষণ সেটা তাদের পছন্দসই হয়। আর উপদেষ্টাও নিয়োজিত হন নেতার পছন্দের। আমাদের রাজ্যের কথাই ধরা যাক না কেন, এখানে কোটি সংক্রমণের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেবার দায়িত্বে একজন হেপাটোলজিস্ট। আমাদের রাজ্যে ভাইরোলজিস্ট, মাইক্রো বায়োলজিস্ট, কমিউনিটি মেডিসিন, এন্টেরিক ডিজিজ এর কোনো বিশেষজ্ঞ নেই কিন্তু নোবেল লরিয়েট আছেন।
রাজনীতিক ও ডক্টর দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে। প্রথম জন নিজেকে বাঁচায় আর অপর জন নিজের জীবন দিয়ে মানুষ বাঁচায়।