সে রাতে এমারজেন্সি ডিউটি করছি। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দেখি এক ২২-২৩ বছরের মেয়ে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এমারজেন্সিতে ঢুকছে। বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাকে ঘিরে রয়েছে বাড়ির বেশ কিছু লোকজন। তারাও বেশ চিন্তিত এবং ভয়ার্ত। একেবারে হুলুস্থুল বাধিয়ে তুলেছেন এমারজেন্সিতে। “একটু তাড়াতাড়ি করুন, দেখে যান।” আমি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক, হার্ট রেট একটু বেশির দিকে, পালস অক্সিমিটার দিয়ে দেখলাম রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক রেঞ্জের মধ্যেই আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম—এর আগে কখনো হয়েছে কিনা! বললেন–‘এর আগেও দু-একবার হয়েছে’। স্টেথো দিয়ে শুনলাম চেস্ট একদম ক্লিয়ার। আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছিল বা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকেন?’ সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, কোনো উত্তর দিলেন না। আমি বললাম— ‘একটা ইসিজি করিয়ে নিতে হবে।’ কিছুক্ষণ পরে ওঁরা ইসিজি রিপোর্ট করিয়ে নিয়ে এলেন, দেখলাম কোনো খারাপ কিছু নেই। বাড়ির লোকজন বললেন—‘মাঝে মাঝে ঠিক হয়ে যায়, তারপর আবার জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।’ ততক্ষণে মেয়েটি একটু ধাতস্থ হয়েছে। শ্বাসকষ্ট একটু কমেছে তবে বুকটা ভারী হয়ে আছে, কিছু যেন চেপে ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি কথাবার্তা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। আগের সেই অস্থির অবস্থাটা নেই। অল্প কথা বলেই বুঝলাম বাড়িতে অনেক দিন ধরেই কিছু বিষয় নিয়ে ঝামেলা চলছে আর একই রকম ঘটনা ৩-৪ বছর আগেও ঘটেছিল, একইরকম। খানিকটা শোনবার পর বুঝলাম স্ট্রেস থেকেই হচ্ছে এরকম।এই থেকে থেকে, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্টের মতো, যাকে বলে হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম (Hyperventilation Syndrome)। একটা ওষুধ দিয়ে বললাম—‘এখন বাড়ি যান, ঘুমান। কাল এসে ওপিডি-তে দেখিয়ে নেবেন।’
হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম কী??
যখন আপনি হঠাৎ করে প্রচণ্ড জোরে জোরে, গভীর কিন্তু খুব দ্রুত শ্বাস নিতে শুরু করেন, বুক অস্বাভাবিক রকমের ভারী হয়ে আসে এবং এই কারণে আপনার শরীরের রক্তে অক্সিজেনএবং কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর মাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হয়—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্তে কার্বন ডাইওক্সাইডের পরিমাণ কমে আসতে থাকে। এই শ্বাসকষ্টের সমস্যা বার বার হতে থাকলে তাকে হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম বলা হয়।
কেন হাইপারভেন্টিলেশান হয়??
দেখা গেছে অধিকাংশ মানুষের হঠাৎ করে কোনো ‘স্ট্রেস’ বা অত্যাধিক দুশ্চিন্তা জীবনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে অনেক মানুষেরই এই ধরনের সমস্যা শুরু হয়। অনেকের ক্ষেত্রে অনেকদিন ধরে চলা স্ট্রেস কিংবা দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যায় থাকলেও এরকম হতে পারে। শুধুমাত্র যে মানসিক সমস্যার কারণেই এই হাইপারভেন্টিলেশান হয় তা নয়, অনেক শারীরিক সমস্যার কারণেও হতে পারে। যেমন—অত্যাধিক পরিমাণে রক্তপাত, ওষুধের ওভারডোজ, হাঁপানির সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস, মাথায় আঘাত লাগা বিভিন্ন কারণে। অনেক সময়েই অ্যাজমা বা হাঁপানির রোগের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা হয়।
তাই প্রথমেই কেউ শ্বাসকষ্ট নিয়ে এমারজেন্সিতে এলে তাকে হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম না ভেবে, তার যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করে, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দেখে, বুকে স্টেথো রেখে, ফুসফুসের অবস্থা বুঝে, ইসিজি করে দেখে নেওয়া জরুরি। এর সবগুলোই মোটামুটি যদি স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে থাকে তখন হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম-এর কথা ভাবতে হবে।
কী কী লক্ষণ হতে পারে ??
হাইপারভেন্টিলেশানের সময় ব্যক্তি খুব দ্রুত গভীরভাবে শ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকে, বারবার করে শ্বাস টানতে থাকে, তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়। ফলে রক্তে কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর মাত্রা কমে যায়। আমাদের রক্তনালিকাগুলো সরু হতে শুরু করে। তাই মাথা ধরা বা ঝিমঝিম করা, চোখে ধোঁয়া ধোঁয়া লাগা, মুখ শুকিয়ে আসা, বুক ভারী হয়ে আসা, হাত পায়ে অসাড়ভাব দেখা দেয়, মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসা, খিচুনির মতো ভাব আসা—এগুলো হয়ে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে চললে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে কিংবা সামান্য পরিমাণে রক্তের pH-এর মান পরিবর্তন হয়ে হতে পারে।
কিছু মানুষের এই হাইপারভেন্টিলেশান শ্বাসকষ্ট সারাজীবনে হয়তো দু-একবার হয়। প্যানিক(Panic) অ্যাটাক, ভয়, কিংবা প্রচণ্ড স্ট্রেসের সময় এরকম হয়ে থাকে তাদের। অনেকের ক্ষেত্রে আবার হাইপারভেন্টিলেশানে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা, প্রচণ্ড রেগে গেলে কিংবা পারিবারিক ঝামেলা হলে হাইপারভেন্টিলেশান হতে শুরু করে।
যখন এই হাইপারভেন্টিলেশান অনেকবার হয় তখন তাকে হাইপারভেন্টিলেশান সিনড্রোম বলে।
হাইপারভেন্টিলেশানের চিকিৎসা কী??
হাইপারভেন্টিলেশান অ্যাটাকের সময় একজনের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। তাকে তখন শান্ত করাই প্রধান লক্ষ্য। এইসময় রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন না। তাই দ্রুত স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনাই প্রথম কাজ।
হাইপারভেন্টিলেশানে আক্রান্ত কারও শ্বাসকষ্ট হলে তাকে—
১। বড়ো মুখ করে শ্বাস নেওয়ার বদলে, ঠোঁট ছোটো করে সরু মুখে করে শ্বাস নিতে বলতে হবে।
২। একটা কাগজের ঠোঙা বা ব্যাগে শ্বাস নেওয়া যেতে পারে।
৩। বুকের বদলে, পেট থেকে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করা।
৪। তাকে যতটা সম্ভব মৌখিকভাবে আশ্বস্ত করা, ‘হার্ট অ্যাটাক-এর মতো কিছুই হয়নি’ ‘মরে যাবে না’, ‘এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাবে’—এগুলো বারবার বলে তাকে একটু সাহস জোগানো।
৫। ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে থাকার চেষ্টা করা।
৬। একটি নাসারন্ধ্র বন্ধ করে, অন্য নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস নেওয়া।
৭। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি একটু কমে এলে জগিং করতে বলা বা একটু জোরে হাঁটাহাঁটি করতে বলা।
কীভাবে একে প্রতিরোধ সম্ভব??
নিজেকে স্ট্রেসমুক্ত রাখাই এর প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। বিভিন্ন রিল্যাক্সেশান থেরাপির মাধ্যমে স্ট্রেস কমিয়ে আনা, যারা দুশ্চিন্তাপ্রবণ তাদের নিজের চিন্তা ও অনুভূতির উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার চেষ্টা করা, আগামীদিনে এই হাইপারভেন্টিলেশান আক্রমণ আটকে দিতে পারে। অনেকরকমের ওষুধ যা কিনা দুশ্চিন্তা কমিয়ে আনে, ব্যবহার করা যেতে পারে। নিয়মিত ঘুমের অভ্যেস এবং সঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া সবমিলিয়ে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন এই রোগকে প্রতিরোধ করতে পারে।
মনে রাখতে হবে কেউ ইচ্ছে করে এটি করে না, যতই তার ব্যবহারে অতিনাটকীয়তা থাকুক, তাকে দোষারোপ না করে তাকে আশ্বস্ত করা, তাকে ভরসা দেওয়া, নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকার পরামর্শ দিয়ে এই রোগকে সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়া সম্ভব।