টিটেনাস হলে কি মানুষ বাঁচে ?’
প্রশ্ন শুনেই মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। আঠারো- উনিশ বছরের মেয়ে। বেশ লম্বা। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। একমাথা দীর্ঘ চুল। দিব্যি মায়াময় দুটো চোখ। করোনার সময় বলে নাক মুখ মাস্কে ঢাকা।
এ বয়সের মেয়েরা সাধারণত মা-বাবার সাথে ডাক্তার দেখাতে আসে। ও এসেছে একা।
বললাম, ‘হঠাৎ টিটেনাসের কথা জিজ্ঞাস করছিস কেন?’
মেয়েটি বলল, ‘সম্ভবত আমার টিটেনাস হতে চলেছে। লক্ষণ টক্ষণ দেখে তাই মনে হচ্ছে।’
আমি এতোদিন ডাক্তারি করছি। একটাও টিটেনাস রোগ নির্ণয় করতে পারিনি। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘কি লক্ষণ চটপট বলে ফেলতো।’
মেয়েটি বলল, ‘ডাক্তার কাকু, রাত্রে শুলে আমার হাত পায়ে কেমন খিঁচ ধরছে।’
মেয়েটির সম্বোধন আর লক্ষণ দুটোই শুনে হতাশ হলাম। যদিও বয়স চল্লিশ হতে চলল, তবুও একজন কিশোরী কাকু বলে ডাকলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
মাস্কের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘পায়ে তো অনেক কারণেই খিঁচ ধরতে পারে। টিটেনাসের মতো একটা বিরল অসুখের কথা মনে হলো কেন?’
‘কারণ আমার পনেরো দিন আগে পায়ে পেরেক ফুটেছিল। আমি টিটেনাস টক্সয়েড নিইনি।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কত বয়স তোর?’
‘উনিশ বছর।’
‘পনেরো বছরের ইনজেকশনটা নিয়েছিলি তো?’
‘হ্যাঁ, নিয়েছিলাম।’
বললাম, ‘তাহলে নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। পনেরো বছরের ঐ ইনজেকশনটাই টিটেনাস টক্সয়েড ছিল। ওটা নিলে পাঁচ বছরের মধ্যে যতবারই কাটাকুটি হোক, আর ইনজেকশন নেওয়ার দরকার নেই। তোর কিছুতেই টিটেনাস হতে পারেনা।’
মেয়েটি চলে গেল। দু’সপ্তাহ বাদে আবার এসে হাজির। তার আগের দিন আমফান ঝড় হয়ে গেছে। চেম্বারে ভিড় কম। কারেন্ট নেই। ইনভার্টারের চার্জও শেষ। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছি। গ্রামের হাসপাতালের স্মৃতি মনে পড়ছে।
মেয়েটিকে দেখে চিনলাম। বললাম, ‘কি হলো রে, আবার এসেছিস?’
‘ডাক্তার কাকু, আমার ঠিক এখানটায় কদিন ধরে ব্যথা করছে।’ মেয়েটি পেট আর বুকের ঠিক সংযোগ স্থলে হাত রাখল।
বললাম, ‘খুব উলটো পালটা খাচ্ছিস না-কি? খুব ঝাল- মশলা?’
‘না না…। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত সচেতন।’
মেয়েটির সাথে আজও যথারীতি কেউ আসেনি। পরের রোগীও মহিলা। তাকেই ডেকে নিলাম।
মেয়েটির পেট ভালো করে চেপে দেখলাম। চোখে যন্ত্রণার কোনো ছাপ পড়ছে না। হাতেও সন্দেহ জনক কোনো কিছুর স্পর্শ পেলাম না। বললাম, ‘কোনো ভয় নেই। পেটে খারাপ কিছু হয়নি।’
মেয়েটি বলল, ‘ডাক্তার কাকু, আমার ইসোফেগাসে ক্যান্সার হয়নি তো?’
চমকে উঠে বললাম, ‘বালাই ষাট। তোর এই বয়সে ক্যান্সার হবে কেন?’
মেয়েটি বলল, ‘ইন্টারনেটে দেখলাম, ইসোফেগাসে ক্যান্সার হলে ঠিক এই জায়গাতেই, যাকে এপি গ্যাস্ট্রিক রিজিওন বলে, এখানেই ব্যথা হয়।’
এতক্ষণে অল্প অল্প বুঝতে পারছি। মেয়েটির আসলে যা হয়েছে, তাকে বলে হাইপোকন্ড্রিয়াসিস। এই রোগ ডাক্তারি ছাত্রদের মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায়। এম বি বি এসের দ্বিতীয় আর তৃতীয় বর্ষে অনেক বন্ধু বান্ধবের ধারণা ছিল তারা সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস, প্যানক্রিয়াটিক কার্সিনোমা ইত্যাদি জটিল অসুখে ভুগছে।
আজ রোগীর চাপ কম। হাতে সময় আছে। অনেক্ষণ ধরে বুঝিয়ে বললাম, কেন ইসোফেগাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মেয়েটি ঘাড় কাত করে সব শুনলো। দেখে মনে হলো সব বুঝেছে। তারপর বলল, ‘তাহলে কি আমার হার্টের অসুখ হলো। আপনি বরঞ্চ আমাকে একটা এন্ডোস্কোপি আর ইসিজি লিখে দিন। করিয়ে আনি।’
যাহ বাবা। এতো দেখছি সব কেচে গন্ডুষ করতে হবে। ধমক টমক না দিয়ে হৃদরোগ সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করলাম। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, সে যতই মাস্কে ঢাকা থাকুক।
মেয়েটি চলে গেল। সপ্তাহ তিনেক পরে আবার হাজির। এবার তার মা সঙ্গে এসেছেন।
বললাম, ‘কী রে, আবার কী হলো?’
মেয়েটির মা বললেন, ‘আর বলবেন না ডাক্তার বাবু। এই মেয়ের জ্বালায় আমরা জেরবার হয়ে যাচ্ছি। তিন দিন ধরে ওর দুপাশের বুকে ব্যথা হচ্ছে। মেয়ের ধারণা ওর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর কি মাসিক চলছে?’
মেয়েটি ঘাড় নাড়লো, ‘হ্যাঁ, তিন দিন ধরে।’
বললাম, ‘মাসিকের সময় ব্রেস্টে একটু ব্যথা হতে পারে। তাই নিয়ে মাথা খারাপ করিস না। তুই কটা দিন দ্যাখ।’
মেয়েটি বলল, ‘একবার এফ এন এ সি করে দেখলে হয় না?’
মেয়েটির মা ধমকে উঠলেন, ‘তুই ডাক্তার বাবুর থেকে বেশি বুঝিস। উনি বলছেন কিছু হয়নি।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মোবাইলটা হলো যত নষ্টের গোড়া। অন লাইন ক্লাস হচ্ছে বলে কিনে দিতে বাধ্য হয়েছি। পড়াশুনো তো হচ্ছে ছাতার মাথা। সারা দিন ধরে আজব আজব রোগ সম্পর্কে পড়ছে, আর মাথাটা খারাপ করছে।’
মেয়েটিকে বললাম, ‘তার চেয়ে তুই বরং একটা রোগ সম্পর্কে পড়াশুনো কর। হাইপোকন্ড্রিয়াসিস।’
‘সেটা আবার কী রোগ ডাক্তার কাকু?’
আবার “কাকু”!! বিষন্ন মুখে বললাম, ‘পড়াশোনা করেই দেখ না। বুঝতে অসুবিধা হলে এসে বলিস।
কয়েক দিন বাদে ওই মেয়ে হাজির। বলল, পড়াশুনো করেছি। বুঝতে পেরেছি একটা বিচ্ছিরি রোগের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছিলাম।’
‘রোগটা কি বলতো?’
‘এই রোগে লোকজন নিজের সামান্য সমস্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মনগড়া একটা জটিল রোগ বলে ভেবে নেয়। ইন্টারনেটে নিজের লক্ষণ মিলিয়ে রোগ খোঁজে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই শুচিবাই বা অবসেশনে ভোগে। যেমন আমিই বারবার হাত ধুই। করোনা মহামারী আসার আগেও ধুতাম। এখন আরো বেড়ে গেছে।’
বললাম, ‘বুঝতেই যখন পেরেছিস, তখন তোকে নিজেকেই রোগ সারাতে হবে। খবরদার, গুগুলে রোগের উপসর্গ মিলিয়ে রোগ খুঁজবি না। বরঞ্চ কোনো সমস্যা হলে আমাকে এসে বলবি।’
মেয়েটি বলল, ‘তবে তোমাকে একটা সত্যি সমস্যার কথা বলবো। এটা নিয়ে আমি কিন্তু গুগল করিনি। এক সপ্তাহ ধরে আমার মাথার ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। এটা কি ব্রেন টিউমার হতে পারে? আমি কি একটা সিটি স্ক্যান করে নেব, ডাক্তার জেঠু?’
কাকু থেকে একেবারে জেঠু! অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়লাম। বললাম, ‘মা রে, স্ক্যান ট্যান পরে করিস। তুই আগে একবার চোখের ডাক্তার দেখা।’