বিপিনবিহারী বোস বিষ্ণুপুর থানার বড়বাবু। অত্যন্ত রাশভারী মেজাজের কারণে সবাই তাঁকে বেশ সমীহ করে চলে। কিন্তু প্রায় একবছর হল তিনি বড্ড সমস্যায় পড়েছেন।
তাঁর বয়স যখন দশ বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান “আলসারেটিভ কোলাইটিস” নামক এক রোগে। গত একবছর ধরে বিপিনবাবুরও খালি ভয় হচ্ছে তাঁরও যদি ঐ রোগ দেখা দেয়। তাই সামান্য পেট ব্যথা হলেই তিনি ডাক্তারের কাছে ছোটেন।তিনি শুনেছেন শাকসবজি খেলে নাকি এই রোগ হবার সম্ভাবনা কমে। তাই তিনি এখন খালি শাক- সবজি খান, মাছ-মাংস খাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছেন। গত একবছরে পেট ব্যথা নিয়ে তিনি পাড়ার হারান ডাক্তারের কাছে প্রায় বার দশেক গেছেন। উদ্দেশ্য একটাই- হারানবাবুর মুখ থেকে শোনা যে পেটব্যথার পিছনে কোন মারাত্মক কারণ লুকিয়ে নেই। শেষের দিকে হারান ডাক্তার তাঁকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে উঠতেন এবং একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিতে বলেছিলেন।
হয়েছে পেটের সমস্যা- তার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবার যে কি দরকার তা বিপিনবাবুর বোধগম্য হয় নি। তাই তারপর তিনি ডাক্তার পরিবর্তন করেছেন। জেনারেল ফিজিসিয়ান, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, গ্যাস্ট্রএন্টেরলজিস্ট, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সবার কাছেই তিনি ছুটে গেছেন। নিজের শহরে, কলকাতায়, কখনও বা সাউথ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে চেক আপ করিয়েছেন।রক্তের পরীক্ষা নিরীক্ষা, পেটের ইউ এস জি, এন্ডোস্কোপি,কোলনস্কোপি হয়েছে অনেক বার- যদিও খারাপ কিছু ধরা পড়েনি। কিন্তু তাঁর খালি মনে হচ্ছে তাঁর হয় “আলসারেটিভ কোলাইটিস” না হলে ক্যান্সার কিছু একটা খুব খারাপ রকমের রোগ হয়েছে। তাঁর আর চাকরীতে মন নেই।
সারাদিন থানায় উদাস হয়ে বসে থাকেন। আরো একটা ব্যাপার হল সমস্ত ডাক্তারবাবুই কিছু না কিছু ওষুধ দিচ্ছেন- কিন্ত বিপিনবাবু নেট ঘেঁটে ওষুধের সাইড-এফেক্ট পড়ে ভয় পেয়ে গিয়ে ওষুধ গুলিও ঠিকমত খাচ্ছেন না। পেটের ব্যামো তাঁকে যতটা কাবু করেছে, তার চেয়ে বেশী তাঁর মনে চিন্তা যে রোগটা ঠিকমত ধরা পড়ছে না কেন। শেষ পর্যন্ত সাউথ ইন্ডিয়ার এক বিখ্যাত হাসপাতালের এক বিখ্যাত ডাক্তারবাবু যখন তাঁকে আবার সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিতে বললেন, তখন তিনি ভাবলেন একবার সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিয়ে দেখাই যাক।
সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবু সমস্ত শুনে বললেন বিপিনবাবুর সমস্যার নাম “হাইপোকন্ড্রিয়াসিস“।
উপরোক্ত গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক হলেও বিপিনবাবুর মত সমস্যায় পড়া প্রচুর লোকজন আমাদের চার পাশেই আছেন। চলুন তাহলে দেখা যাক হাইপোকন্ড্রিয়াসিস রোগটি কী?
আমরা সিনেমা, সিরিয়ালে অনেক সময় দেখি যুদ্ধক্ষেত্রে কোন সৈনিক তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশে বারবার গুলি খাওয়ার পরেও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা হয়তো অতি নাটকীয়। কিন্তু এটাও সত্যি যে মানসিক দৃঢ়তা বেড়ে গেলে শারীরিক ব্যথা, বেদনা অনেক কম অনুভূত হয়।মানসিক ও শারীরিক সমস্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকার কারণে উভয়েই উভয়কে প্রভাবিত করে।শুধু তাই নয় ,মানসিক সমস্যার বহিঃপ্রকাশ অনেক সময় হয় শারীরিক সমস্যা দিয়েও।
“হাইপোকন্ড্রিয়াসিস” নামক রোগে রোগী সামান্য বা সাধারণ কোন শারীরিক সমস্যাকে খুব ভয়ঙ্কর কোন রোগের লক্ষণ হিসাবে দেখেন। যেমন সামান্য পেট ব্যথাকে তিনি ভাবেন পাকস্থলী বা অন্ত্রের কোন মারাত্মক রোগ না হলে ক্যান্সার, মাথা ব্যথা হলেই ভাবেন মাথার মধ্যে টিউমার তৈরী হয়েছে ইত্যাদি। তিনি অনেক চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করেন, অনেক সময় চিকিৎসককে অহেতুক পরীক্ষানিরীক্ষা লিখে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন।যদিও কোন পরীক্ষাতেই খারাপ কিছু ধরা পড়ে না।
যদিও রিপোর্ট খারাপ না হওয়ায় এরপর রোগীর আশ্বস্ত হওয়া উচিত ছিল, তার বদলে ওই রোগী ভাবেন তাঁর রোগটি বোধ হয় ঠিকমত ধরা পড়ছে না। ডাক্তারবাবুরা যতই বোঝান যে তাঁর আসল রোগ হচ্ছে- রোগ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা, তা তাঁর বোধগম্য হয় না। রোগের লক্ষণ কমানোর জন্য চিকিৎসক ওষুধ দিলে সেই ওষুধ দিলেও রোগী অনিয়মিত ভাবে সেগুলি খান। রোগের উপশম অপেক্ষা রোগের কারণ খুঁজে বের করাই রোগীর মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।
এই রোগ সাধারণত ২০ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়স্কদের মধ্যে প্রথম দেখা দেয়। এই রোগ মহিলা ও পুরুষ উভয়েরই হবার সম্ভাবনা সমান। প্রাত্যহিক জীবনে অতিরিক্ত চিন্তা এই রোগের প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়। এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, উদ্বিগ্নতা, শুচিবাই, ইত্যাদি সমস্যা খুব বেশী করে দেখা যায়।
এই জাতীয় সমস্যা দেখা গেলে অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন। রোগ সম্বন্ধে উপযুক্ত জ্ঞানলাভ, চাপ কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপযুক্ত ওষুধের মাধ্যমে এই রোগের সঠিক চিকিৎসা সম্ভব।
I want to consult about this matter as I have a patient like this