মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ক্লাস নিয়ে ফেরার সময় ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। টুক করে খানিক স্মৃতি রোমন্থনের লোভে ঢুকে পড়লাম আমার পুরানো হাসপাতালে। চেনা মুখ ভিড় করলো। সহযোদ্ধা ডাঃ সরেনের পাশে গিয়ে বসলাম। সুখ দুঃখের দুটো কথা বলার মাঝেই ছুটে এলো একদল উদবিগ্ন মুখ। সাথে আমাদের ব্লকের ফরেস্ট অধিকর্তা। চেনা মুখ। মুখে চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু তার মাঝেই আমাকে দেখে হাসি মুখে বললেন- ডাক্তারবাবু, আপনি আছেন? দেখুন না, আমাদের আপিসের নন্দীবাবু হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়েছি। কিছুতেই কিছু হলো না। গোঙাচ্ছেন তখন থেকেই। বোধ হয় স্ট্রোক হয়েছে। প্লিজ তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন।
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই চেয়ার ছেড়ে রোগীর পানে দৌড়তে যাচ্ছিলাম আর কি। কিন্তু আমি তো এখন এ হাসপাতালের চিকিৎসক নই। তাই ডাঃ সরেনের পিছু নিলাম।
রোগী এক্কেবারেই অসাড়। মৃদু গোঙাচ্ছেন। দূর থেকে দেখে “মৃত” বলেই ঠাহর হয়। চিকিৎসার ভাষায় গ্লাসগো কোমা স্কেলে মেরেকেটে তিনের বেশি পয়েন্ট পাবে না। প্রেসার মাপা হলো। বেশ কম। পালস প্রায় অস্তিত্ব সংকটে। চোখের তারায় আলো ফেলতে প্রাণের অস্তিত্বের জোরালো প্রমা্ণ পাওয়া গেলো বটে। প্লান্টার রিফ্লেক্স দুই দিকেই এক্সটেনসর।
এ ধরনের জ্ঞান হারিয়ে কোমায় যাওয়া যে কোনো রোগী দেখলেই প্রথমেই স্ট্রোক, হার্টঅ্যাটাক বা শরীর-লবণের তারতম্যের কথা মনে পড়ে। প্লান্টার রিফ্লেক্স দুই দিকেই এক্সটেনসর দেখে মেটাবলিক ডিস-অর্ডারের কথাই মনে ধরলো। কিন্তু ব্রেনের দুইদিকে স্ট্রোক হলেও তো এটা হতে পারে। এই রকম সাত পাঁচ ভাবছি। ফরেস্ট অফিসারের প্রশ্নে ঘোর ভাঙলো। “কি বুঝছেন ডাক্তারবাবু?” আমি যদিও এ হাসপাতালের এখন আর কেউ নই, তবুও পরিচিত রোগীর প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া চিকিৎসক ধর্মবিরোধী। তাই উত্তর না দিয়ে পারলাম না। “আপাতত কিছু রিপোর্ট করিয়ে নেওয়া ভালো। হাসপাতালে সোডিয়াম, পটাসিয়াম রিপোর্ট হয়ে যাবে। সিটি স্ক্যানও করাতে হতে পারে”।
রোগীর থেকে তফাতে দাঁড়িয়ে এই কথাই বলছি তখন।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন প্রিয়া সিস্টার। হাতের গ্লুকোমিটার মেশিন তুলে ধরলেন আমার দিকে। রিডিং মাত্র উনিশ। অর্থাৎ কিনা ভয়ংকর ভাবে হাইপোগ্লাইসিমিয়া। “অ্যাঁ, বলেন কি! ইমিডিয়েট ডেক্সট্রোজ স্যালাইন দিন”।
আমার বলার সাথে সাথেই প্রিয়া দিদিমনি হাসি হাসি মুখে বললেন- আপনাদের বলার আগেই এ রিপোর্ট দেখে ডেক্সট্রোজ রেডি করে নিয়েছি স্যার। ডাঃ সরেনের নির্দেশের অপেক্ষা শুধু।
সত্যি বলছি, সিস্টার দিদিমনির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে মুগ্ধ হলাম। কাজের সুবাদেই বেশ কয়েকদিন হাসপাতালের ইমারজেন্সী ডিউটি থেকে দূরে থাকি। সাত পাঁচ ভাবনার মাঝে হাইপোগ্লাইসিমিয়ার কথা তৎক্ষণাৎ মনেই আসেনি।
সরেন বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী ২৫% ডেক্সট্রোজ ইনফিউসান শুরু করা হলো।
ততক্ষণে ফরেস্ট অফিসার বাবু আরও একবার ঘিরে ধরলেন। রোগের আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা চাই। উনার দিকে তাকিয়ে বললাম- হাইপোগ্লাইসিমিয়া অর্থাৎ কিনা রক্তে শর্করার (সুগার) মাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়া। মূলত ডায়াবেটিস রোগীরা, তাঁরা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার না খেয়ে যদি ইনসুলিন নেন বা সুগারের ওষুধ খান তাঁদের ক্ষেত্রে হঠাৎই রক্তশর্করার মাত্রাতিরিক্ত কমে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে ঘাম বেরোনো থেকে শুরু করে, মাথা ঘোরা, নিস্তেজ ভাব ও অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে মৃত্যুমুখী হওয়ার অবস্থা আসতে পারে। সেজন্য এ ধরনের রোগীকে আমরা সবসময়ই পকেটে একটু চিনি রাখতে পরামর্শ দিই। বেগতিক দেখলেই মুখে চালান করে দিন। মুহূর্তেই মুক্তি। ডায়াবেটিস রোগী ছাড়াও সুরাপ্রেমীরা মাঝেমধ্যেই এর প্রকোপে পড়েন। কমবয়েসী মেয়েদের মধ্যে অথবা ভারী চেহারার প্রসূতি এ বিপদের সম্মুখীন হন বারংবার। এছাড়াও কিছু ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারও এ বিপদ ডেকে আনতে পারে। রোগনির্ণয় করতে পারলেই চিনি বা গ্লুকোজের প্রয়োগে কেল্লাফতে। তা না হলেই নন্দীবাবুর মত বেঘোরে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠবে।
মিনিট পাঁচেকের এসব কথাবার্তার মধ্যেই পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, নন্দীবাবু উঠে বসেছেন। যেন, কিচ্ছুটি হয়নি – এমন ভাব করে বললেন, ডাক্তারবাবু,আমি ডায়াবেটিসের রোগী। ইনসুলিন নিই নিয়মিত। আজ সকালেও নিয়েছি। অফিসে এসে বসার পরেই ধীরে ধীরে সব অন্ধকার। যাকগে যাক, এখন আমি একদম সুস্থ। বাড়ি যাবো।
ফরেস্ট অফিসার বাবু এতক্ষণের কোমায় চলে যাওয়া নন্দীবাবুর ম্যাজিক গতিতে উঠে বসে অনর্গল কথা বলছেন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখদুটো গোলগোল করে আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
আশ্বস্ত করে নন্দীবাবুর উদ্দেশ্যে বললাম, এরপর থেকে ইনসুলিন নেওয়ার ক্ষেত্রে পেট ভরে খাওয়ার কথা ভুলবেন না কিন্তু।
হাতের স্যালাইন খুলে চলে যাবার আগে নন্দীবাবু হাসিমুখে বলেছিলেন- সুগার বাড়লে না হয় আঠারো ঘা, কমলে তো দেখছি সাড়ে ছত্রিশ ঘা।
প্রিয়া সিস্টারের দিকে তাকিয়ে উনার হেঁয়ালীর উত্তরে অবিমিশ্র হাসি হেসেছিলাম শুধু।