আমি অরাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমি রাজনীতিতে, রাজনৈতিকতাতে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীতে, এই আকাশের নিচে, এই সূর্যের আলোয় ও রাতের গভীরে যা যা ঘটছে, তার প্রতিটি রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ। এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনাময়ও বটে।
রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতি নয় অবশ্য। গণতন্ত্রে দলের বাইরেও একটি পরিসর থাকে – অন্তত থাকা উচিত – দল-নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ – যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, থাকা উচিত। সে ভূমিকাও রাজনৈতিকই, কিন্তু দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে।
গণতন্ত্রের প্রধানতম নিয়ামক দলীয় রাজনীতি, নিঃসন্দেহে। কেননা, সবচেয়ে বেশি মানুষের সমর্থন যাঁরা পেলেন, সরকার চালাবেন তাঁরা। আপনি সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একগুচ্ছ মানুষের সমাহার হিসেবে দেখতে চাইতেই পারেন, কিন্তু আদতে তাঁরা একটি দল। রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেই নির্বাচিত দল যখন সরকার হয়ে ওঠেন, তাঁদের সরকার-পরিচালনার কাজটি যাঁদের মাধ্যমে হয় – অর্থাৎ পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদি প্রভৃতি – তাঁরা দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে। সরকারের কাজ সঠিকভাবে চলছে কিনা, সেসব যাঁরা দেখেন – বিচারব্যবস্থা সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি – তাঁরাও দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে। অবশ্যই এঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে, সামূহিক ভূমিকাও – সে ভূমিকা রাজনৈতিকই – কিন্তু এঁরা দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে থাকেন। অন্তত থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত।
যেমন ধরুন, কোনও শিক্ষক দলীয় সদস্য হতেই পারেন, দলীয় নেতাও হতে পারেন – কিন্তু তিনি যখন শিক্ষকতা করবেন, তাঁর মাথায় দলীয় রাজনীতির অঙ্ক থাকাটা অনুচিত। তিনি যখন শিক্ষাপ্রশাসনের অঙ্গ হবেন, শিক্ষানিয়ামক সংস্থার ভার গ্রহণ করবেন – তখনও তাঁকে দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে উঠতে হবে। অতিক্রম করে উঠতেই হবে।
ঠিক এই একই কথা বাকি পেশার মানুষজনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও।
চিকিৎসকদের উচিত-অনুচিত নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ‘স্টেট মেডিকেল কাউন্সিল’। সেই সংস্থার সদস্য যাঁরা হবেন – চিকিৎসকদের ভোটে নির্বাচিত সদস্য – তাঁদের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠেই সংস্থা পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে সমগ্র কাউন্সিলটিই তাৎপর্য হারায়।
এই রাজ্যের মেডিকেল কাউন্সিল দীর্ঘদিন যাবৎ দুই চিকিৎসকের অঙ্গুলিহেলনে চলে এসেছে। যে দুজনের একজনেরও প্রাথমিক পরিচিতি চিকিৎসক হিসেবে নয়, পরিচিতি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই, কাউন্সিলের ক্রিয়াকলাপ নির্দিষ্ট দলের স্বার্থরক্ষার্থে ঘটেছে – আরও বেশি করে রাজনৈতিক ও পেশাগত ঈর্ষা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন – আগের বাক্যটি কোনও গুজব না অভিযোগ নয়, একেবারে তিক্ত সত্যি। আর ভুক্তভোগীরা তো জানেনই…
যখনই কোনও প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহৃত হয় – বা বলা ভালো, যে প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট স্বার্থরক্ষার্থে কার্যকরীভাবে ব্যবহারের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে – সেই প্রতিষ্ঠানের দখল বজায় রাখতে দলীয় লড়াই অনিবার্য হয়ে ওঠে। এবং সেই সুবাদে বিবিধ দুর্নীতি ও গাজোয়ারিও অনিবার্য হয়ে ওঠে। রাজ্যের মেডিকেল কাউন্সিলও কোনও ব্যতিক্রম নয়। সে নিয়ে আইন-আদালতে অভিযোগ মামলা-মোকদ্দমা সবই হয়েছে – আইন আইনের পথে শম্বুকগতিতে এগোনোর কারণে অভিযোগের ফয়সালা হতে বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে। তবে, আশার কথা এই, কচ্ছপও রেস জেতে। আদালতও নির্বাচনে ‘অনিয়ম’-এর বিরুদ্ধে রায় দিয়ে উঠতে পারেন শেষমেশ। চার বছর বাদে হলেও অবশেষে নতুন করে নির্বাচনের রায় আসে। এসেছে।
প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনীতির দখলমুক্ত করার যে লড়াই, সে লড়াইও রাজনৈতিকই। দলীয় রাজনীতি নয়, নাগরিক সমাজের কর্তব্যপালনের দায়। রাজনৈতিক দায়। রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের নির্বাচন, ঠিক একারণেই, রাজ্যের প্রতিটি চিকিৎসকের সামনে নাগরিক দায়িত্বপালনের লড়াই।
অবশ্য দায় পালন করতে পারার জন্য ন্যূনতম কিছু পরিকাঠামো লাগে। মানে, খুনী-চিটিংবাজ জনপ্রতিনিধিকে সরিয়ে বিকল্প বাছতে পারার জন্য গণতন্ত্রে ভোটটুকু দিতে পারা জরুরি। এখানেও দলীয় আজ্ঞাবহ প্রশাসনকে সরানোর জন্য ভোটটুকু দিতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক সত্যিটা হলো, মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে ভোট দিতে পারা-ই চ্যালেঞ্জ। কেননা অর্ধেক চিকিৎসক অবধি ব্যালট পৌঁছায় না, পোস্ট-অফিস থেকেই হাওয়া হয়ে যায়। শিক্ষক-চিকিৎসকদের প্রাপ্য ব্যালট কলেজ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে শাসক-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকদের হাতে পৌঁছে যায়। আর নেতানেত্রীদের হুমকি ইত্যাদি প্রভৃতি তো রয়েছে। কাজেই, মুখে যা-ই বলি, দায়িত্বপালনের কাজটা সহজ হয় না। এবারেও হবে না।
তো যেকথা বলছিলাম, যদি ব্যালট হাতে পান – বা ব্যালট হাতে পাওয়ার কাজে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হতে পারেন – তাহলে মনে রাখুন, রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলকে দলীয় রাজনীতির দখলমুক্ত করার যে লড়াই, সে লড়াইও রাজনৈতিকই। দলীয় রাজনীতি নয়, নাগরিক সমাজের কর্তব্যপালনের দায়। সেও রাজনৈতিক দায়।
ভালো কথা এটুকুই, দলীয় রাজনীতি বনাম দলীয় রাজনীতিমুক্ত নিয়ামক প্রতিষ্ঠান – লড়াইটা এবারে সরাসরি। কেননা, এই প্রথমবার, নির্বাচনে শাসক-ঘনিষ্ঠ দলের যে প্যানেল, তার সমর্থনে সভা হচ্ছে – “তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকপ্রার্থীদের সমর্থনে চিকিৎসক সমাবেশ” নামে – অর্থাৎ প্রার্থীরা যে “তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকপ্রার্থী, সে নিয়ে কোনও ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচার অসাধু প্রয়াস নেই। এ এক নজিরবিহীন ব্যাপার।
অতএব, চিকিৎসকদের সামনে বেছে নেওয়ার সুযোগটা স্পষ্ট। তাঁরা ” তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকপ্রার্থী”-দের বাছবেন – নাকি মেডিকেল কাউন্সিলকে দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাইরে রাখবেন। বিচারের দায় আপনার।
ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন এসে রাজ্যের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ক্রমশ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে, নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা কমিয়ে ক্রমশ সরকার-মনোনীত প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে – কমিশনে এখন মনোনীত প্রতিনিধিই অনুপাতে অনেক বেশি, নির্বাচিত ও রাজ্যগুলির প্রতিনিধি সংখ্যালঘু – চিকিৎসকদের নিয়ামক সংস্থা কেন্দ্রীয়ভাবেই গণতান্ত্রিক নিয়মকানুনের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেই সুযোগে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে আয়ুশ জুড়ে পুরোটাই ধোঁয়াশা হয়ে পড়ছে, এরকম চলতে দিলে এক কি দুদশক বাদে সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীতেই এদেশের ডাক্তারি পড়াশোনাটা হাস্যাস্পদ হয়ে উঠবে – এর প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ।
পাশাপাশি এ কথাও গুরুত্বপূর্ণ যে, বিগত এক দশকে আমাদের কাউন্সিল এসব নিয়ে ভাবেননি। তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন অপছন্দের চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে ব্যতিব্যস্ত করতে, হয়রান করতে এবং নিজেদের আখের গোছাতে। কিন্তু সে তো পরের ধাপের কথা।
রাজ্যের প্রতিটি চিকিৎসকের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন ভালো-মন্দ অভাব-অভিযোগ দেখার অন্যতম জায়গা রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল। এ এমনই এক জায়গা, যাকে চিকিৎসকের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। মুশকিল নয়, অসম্ভব। সেই জায়গাটা যদি দলীয় স্বার্থের হিসেবেনিকেশ কষার কাজে ব্যবহৃত হয় – সেই জায়গাটা যদি অদক্ষভাবে পরিচালিত হয় – হয়রানিটা প্রায় সামগ্রিক।
অতএব, রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের আগামী নির্বাচন এই রাজ্যের চিকিৎসকের সামনে – একদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থটি ভেবে দেখার জন্যও বটে, আবার সামগ্রিকভাবে চিকিৎসক সমাজের স্বার্থরক্ষার জন্যও বটে – গুরুত্বপূর্ণ।
লড়াইটা রাজনৈতিকও। লড়াইটা নিয়ামক প্রশাসনকে দলীয় রাজনীতি থেকে পৃথক করার জন্য। নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই – গণতান্ত্রিক কাঠামোয় – সে লড়াইও রাজনৈতিকই হয়। দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নাগরিক রাজনীতি।