- কথা হয়েছিল ঘাসে বসে। কথা হয়েছিল কপালের কুঞ্চনে তিরতিরানি আর গোঁফের জায়গায় গুড়িগুড়ি স্বেদবিন্দুদের, বাম হাতের উল্টো পিঠে সপাট মুছে-টুছে নিয়েটিয়ে। কথা হয়েছিল সর্বসম্মতে এমত–
” দাঁড়ান না, দাঁড়ান! বাংলা ভাষা কাঁপিয়ে দেব আমরা! আপনি আমি আর দিয়া, বাঘের মতো! তিনজনে।”
মেসেঞ্জারে-গ্রূপ গড়ে নিয়ে তাই গল্প আর আড্ডা হতো প্রায়ই। একজন, আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন… বিদেশে থাকেন কিনা! ফোনের নম্বর পাল্টে যায় তাই তাঁর। প্রায়ই। অগত্যা, ওই মেসেঞ্জার গ্রূপ। যেখানে, মুহুর্মুহু লেখা আদান প্রদান, ” মেইল চেক করেন না কেন, আপনাকে চিঠি লিখছি যে!”
এইসব হত টতো।
প্রথম বই প্রকাশ হয়েছিল একসাথে, তিনজনেরই। পারস্পরিক–” উফফ আপনার বইয়ের ফার্স্ট কপি আমি কিনেছি। নিন। সই দিন। অটোগ্রাফ”
হ্যাঁ জানি, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে লেখাটা! কীই করতে পারি আমি আর! কত ঝগড়া হলো! কত আড্ডা। কোভিড যখন এলো, আর আমি চরম একাকী অবসাদে, সেই সময়ে বিনা প্রয়োজনে যোগাযোগ যে দুই জন করত, তাঁদের একজন আপনি। অন্যজন কে, তিনি নিজেও জানেন! জানেন তো শ্রীজাতা! তিনজনের তিনটে শেষ প্রকাশিত বই– ‘চাঁদের সিঁড়ি’, ‘জলপাই নিরুদ্দেশ’, আর ‘আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী’।
মিল নেই! হ্যাঁহ! বলুন! বলুন তো!
আচ্ছা ধরা যাক মিল নেই। তাহলে প্ৰথম বই! আমাদের? ‘ স্বপ্নবেলায়’, ‘রেড ভেলভেট’, ‘ ট্র্যাপিজ রমণী’।
মিল পাচ্ছেন না! লালচে স্বপ্নের জন্য ট্র্যাপিজে ঝুলেও, টিঁকে থাকছি আমরা! পাচ্ছেন না! মিল! এইবার!
সেসব যাক। বাঘের মতো বাংলা সাহিত্য দাপিয়ে বেড়াব বলে বাওয়াল দিয়েছিল যারা, তারা একসাথে থামিয়ে দিল লেখা! একসাথে।
সেসব যদিও বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য এইটাই যে I am fucking sick and tired of crying.
আজ বছর পনেরো হলো ডাক্তারি করছি, লাশ ফাস মৃত্য এসব দেখেছি কত। কিন্তু আজ এই ভোর রাতে আর পারছি না মাইরি! অথচ নাইট চলছে। ইমারজেন্সি। রোগী আসছে। ক্লিষ্ট। এবং পারছি না। চোখ জ্বলে যাচ্ছে। জলে।
জানেন মাইরি, জানেন, আজ যখন বাড়ি ফিরছিলাম মিনিট দশেক আগে, জলপাইগুড়ি শহর ভেসে যাচ্ছে জলে। একাধিক রাস্তা বন্ধ। এবং আমি সেই মুহূর্তে ভাবছি– ইস, প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে, ইস, যদি বাড়ি না ফিরতে পারি!
ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হলো, এই এত শোকের মাঝেও আমি নিজের সামান্যতম সুখের কথাই ভাবছি! এবং এটাই জীবন। যে জীবন ছাড়তে হলে …।
আমি ক্লাস সিক্সে প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা করি। সাবান খেয়ে। ব্যাকরণ সিংয়ের দাদা সাবান খেয়ে মরে গিয়েছিল, তাই।
হিরাইথ hiraeth,
যা বাস্তবে নেই, যা হয়না, হয়নি কোনোদিন, তার জন্য আছাড়ি পিছাড়ি প্রচেষ্টা।
সেখানে তলিয়ে গেলেন কেন! দিন পাঁচেক আগেও কথা হয়নি! বলুন তো! হয়নি!
” যা খুশি হোক, টিকে থাকুন( নাকি টিঁকে! এই চন্দ্রবিন্দু বানানরীতি নিয়েও রাতভোর/ রাতভর তর্ক)।”
তো তাই, টিকে/টিঁকে যদ্দিন আছেন, ততদিন কিছু মানুষ হয়ত একটু উপকার পাবে! গর্বের সাথে ভাবুন না। ভাবুন। ভাবতে শিখুন– এই দুনিয়াতে আমার আপনার মতো মানুষের প্রয়োজন । খুব প্রয়োজন। ”
হয়নি এসব কথা! হ্যাঁ! হয়নি? হয়নি? হয়নি ? হয়নি?
Then?
আমি যে এই লেখা লিখলাম, এটা হয়ত আমাদের মধ্যে তৃতীয়জনের ভালো লাগলো না। তো সেই তৃতীয়কেই বলি, আমি মাইরি পারছি না! পারছি না। মাইরি। উনি তো বলেছিলনই… আপনিও বলেছিলেন মনে আছে তো!– “লেখার কাছাকাছি থাকুন”
বলেননি! আপনারা! বলুন!
কথা বলুন। কথা বলুন। কথা বলুন। সব্বাই। সব উগরে দিন। কিন্তু বেঁচে থাকুন প্লিজ!
প্লিজ নাঃ!, প্লিজ…
থাকুন। বেঁচে!
হাত জোড় করছি। পায়ে পড়ি। আপনাদের। বেঁচে থাকুন না! প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
আর শুনুন, ওহে চলে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক, শুনুন কান দিয়ে, আপনি বলেছিলেন, আপনিই খোদ বলেছিলেন আমাকে,” খামোখা লিখবেন না।”
আমি খামোখা লিখিনি। বিশ্বাস করুন। এই যে অঝোর কাঁদছি, সেই কান্নার দোহাই, খামোখা না।
শব্দ আমাদের একমাত্র আশ্রয়। বাক্য…আমাদের একমাত্র কবচ কুন্ডল।
শুধু… কী করে ভুলি বলুন তো, আমার সবচাইতে দরকারের দিনে আপনিই খোঁজ নিয়েছিলেন রোজ।
আর আমি খোঁজ করব বলেও ….করিনি। সাত দিন হয়ে গেল আজ।
এই যে এত লেখা রয়ে গেল আপনার…রয়ে গেল আমার কাছে… এই ভার বহন করব কী রূপে!
(আমি আর না লিখে পারছিলাম না। আমার ফেসবুকে আহা উহু কুড়িয়ে খ্যাত হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।
লিখলাম, কারন না লিখলে মরে যেতাম। মরে যেত আমার রোগীরা। যাদের মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারছি না খবর শোনা ইস্তক।
এবং
আমি পোস্ট করতাম না। লিখলেও।
করলাম। একটাই কারন। আমি ভুলতে দেখেছি। সব্বাই সব ভুলে যায়। দশ দিন, দশ মাস বা দশ বছর লাগে ম্যাক্সিমাম। ভুলতে হলে।
কিন্তু আমি যে আমি ভুলতে চাই না। আমি ফেসবুক মেমোরিজ এ দেখতে চাই এই পোস্ট। আমৃত্যু।
আঘাত করতে চাই, নিজেকেই যে, আমি
আমি ফোন করিনি।)
ক্ষমা করবেন শ্রীজাতা। আমি মাইরি পারছি না আর। পারছি না।
রোগী দেখতে পারছি না তো! It’s fucking disgusting.