রাত বিরেতে emergency-তে আপনি ভরসা ,সকালে হলেই কিন্তু চিত্র আলাদা । তাই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার একটু আলাদা তো বটেই।
শুরু করি।
সাগরদীঘিতে আউটডোরের শেষে আমার চেম্বারে আড্ডা বসতো সব ডাক্তারদের। ওরা হাসি ঠাট্টা মজা করলেও আমি অনেক সময়তেই হয় মোবাইল নিয়ে খুট খুট করছি, নয়তো কখনো বা ওদের কিছু প্রশ্নের উত্তরের কিন্তু বিরক্ত সহকারে রিপ্লাই করছি।
বাড়িতে গিয়ে সোমার কাছে খেতাম উদুম বকা।তোর মধ্যে ভদ্রতা ,শিষ্টাচার দিন দিন কমে যাচ্ছে! আমি নিজেই লজ্জা পাই তোর ব্যবহারে। তোর কি কাউন্সেলিং লাগবে?
অনেক জুনিয়র এমনকি পরিচিত মহলে এটাও রটে যায় ও খুব অল্পেই রেগে যায়, খুব টেনশন করে।
সব কিছু ব্যাখ্যা দিতে চাইতাম না।
তখনও আলাদা করে জিএম বাংলো তৈরি হয়নি। জিএম স্যার থাকতেন আমাদের বিল্ডিং এরই দোতলায়।
আমাদের বাড়ি ছিল “আদর্শ হিন্দু হোটেল” মার্কা। সব সময় লোক আসছে, যাচ্ছে। জিএম স্যার-দের বাড়িতে একটা প্রাইভেসি থাকা উচিত। সেটা সম্ভব হতো না।
অনেক সময়তেই ব্যক্তিগত স্তরে জিএম স্যার বলতেন: কি কাল তো ভালই বাড়িতে পার্টি চলছিল!
খুব অস্বস্তি হতো নিজের।
একদিন এক পূর্ব পরিচিত জিএম (কোলাঘাট থেকেই পরিচিত) সকাল সকাল ফোন দোতলা থেকে। দীপঙ্কর, একটু উপরে আসতে পারবে?
কি হলো!
গলা কিরকম ভাঙ্গা, উৎকণ্ঠায় ভরা, একটু এসো না
উপরে গেলাম।
গিয়ে দেখি স্যার ডাইনিং টেবিলের সামনে একটা টুলে বসে আছেন দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে।
কি হয়েছে আপনার?
ভোরের দিকে বাথরুমে যেতে গিয়ে হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন ওঠার মত শক্তি ছিল না। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় যাই।
ওইসময় ডাকেননি কেন?
ফোন খুঁজে ফোন করার মতো অবস্থায় ছিলাম না।
নীচে নেমে bp, stetho নিয়ে এসে চেক করে বললাম, কলকাতায় পাঠাচ্ছি, সব টেস্ট করে আগে ডায়াগনোসিস-এ পৌঁছতে হবে। আপনি জিএম। কিছু হয়ে গেলে আমি বিপদে পরে যাবো।
উনি সরাসরি বললেন, সম্ভব নয় আজ কলকাতায় যাওয়া। দুপুরে ভিসি আছে। এখান থেকেই অ্যাটেন্ড করতে হবে।
আগে তো আপনি বাঁচবেন?
ধুর, তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করতে চাইলে চলে যাও, আমি নিজেই সামলে নেবো। কাউকে জানাতে চাই না বলেই তো তোমাকে ডাকলাম। নিচে ডাক্তার থাকে তাই তো এই বিল্ডিং নেওয়া আমার।
শুনুন, আমি হাসপাতালের ল্যাবের ছেলেটাকে ডাকছি। ও রক্ত নিয়ে যাক। লালদীঘি ডায়াগনস্টিক সেন্টার মুর্শিদাবাদে ফোন করছি। MRI, EEG, ECG সব করবো। তারপর ডিসিশন নেবো। (এখানে জানিয়ে রাখি বহরমপুরে লালদীঘি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কলকাতা থেকে সব বড়ো বড়ো ডাক্তার আসে। পিনাকপানি ভট্টাচার্য অবধি যান।কিন্তু অস্বাভাবিক চাপ থাকে)। ফোন করলাম ওদের মার্কেটিং এর ছেলেটাকে। নিজের কিছু সুনাম আছে অন্য কারণে বলে ওরা সহজে না বলতে পারে না আমাকে।
ও বললো, জানি না স্যার এভাবে প্রিবুকিং না থাকলে কটা টেস্ট করিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ডাক্তার নিজেই হয়তো করিয়ে দিতে পারেন। কিছু দোষ যে আপনার নেই সেটা সবাই জানে।
সৌম্যকে ডেকে নিলাম। সঙ্গে বিশ্বজিৎ। টেস্ট হলো সব। চিকিৎসা এখানেই শুরু হলো বড়ো কিছু না পাওয়ায়।
বৌদিকে ফোন করে বললাম, এবার অনেক হলো কলকাতায় থাকা আপনার। স্যারের জন্য এবার এখানে চলে আসুন।
স্যারের বৃদ্ধা মা যে আমার সঙ্গে থাকে। অনেক রোগ ওনার। ডাক্তারের অধীনে আছেন।
আমার উপর ভরসা করতে পারেন। তবে স্যারের জন্য এখানে থাকা জরুরি। এবং এরপর জোর করেই ওনাকে ছুটি আদায় করে কলকাতায় বড়ো কোনো নিউরোলজিস্টকে দেখিয়ে নেবেন।
হ্যাঁ পরবর্তী কালে নিউরোলজিস্ট একই রকমের ওষুধ রেখে দিয়েছিলেন যা এখানে ওনাকে দেওয়া হয়েছিল। উনি ট্রান্সফার হয়ে চলে যাবার পরে যিনি আসলেন তিনি আগে সাগরদীঘিতে DGM হিসেবে ছিলেন। তখন ঘরোয়া পার্টিতে আমরা ডাক পেতাম। অচ্ছুৎ হইনি তখনও। সেই সূত্রে পরিচিতি ছিল।
তিনি যখন জিএম হিসেবে এলেন একদিন বাড়ির দলিলের মত গুচ্ছ গুচ্ছ কাগজ, প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির।
যত জানতে চাই এখন সমস্যাটা কি? উনি সব বড়ো বড়ো ডাক্তারদের নাম ,প্রেসক্রিপশন বার করেন।
শেষ অবধি বাধ্য হয়ে বললাম, দুটো উপায় আছে স্যার। এক আমি আপনার ওষুধগুলো টুকে দিচ্ছি। যেগুলো পাওয়া যাবে এখান থেকে দিয়ে দিচ্ছি। দুই আপনি কলকাতায় গিয়ে ওনাদের দেখিয়ে আসুন।
উনি বোধহয় বুঝতে পারলেন একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছি।
তুমি কিছু টেস্ট করতে চাইলে করাতে পারো। তবে আমি খুব ব্যস্ত। টেকনিশিয়ানকে বলো বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে।
এটুকু তো করাই যায় স্যার। তাহলে এই টেস্টগুলো একটু করে নিন আগে।
ল্যাবের ছেলেটিকে বললাম স্যাম্পল টেনে নিজেরা এবং বাইরের আউটসোর্সিং দুজায়গায়তেই পাঠাবি একই টেস্টের জন্য। উনি বিশ্বাস করতে নাও চাইতে পারেন এখানকার রিপোর্ট।
সুগার ফাস্টিং ৪০০, পি পি ৬০০, বাইরেও প্রায় এক। ওনার ওজন ৯০ কেজি তো হবেই। প্রেসারের ওষুধ চলে।
বললাম কলকাতায় চলে যান। আপনার ডাক্তার দেখান গিয়ে।
বললেন, জিএম-এর চাপ জানো না হে। তুমি আছো কি করতে?
এতো বড়ো ডাক্তার আমি নই স্যার।
আরে ঘাবড়ে গেলে হবে! হাসপাতাল, ডাক্তার আছে কি করতে?
শুরু হলো চিকিৎসা..। এখানকার ওষুধ দিয়ে।সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকি এই না কিছু হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই নানারকম টেস্ট যা এখানে সম্ভব করিয়ে রাখি।
একা থাকতেন। পার্টি করতেন। এক্সারসাইজ, ডায়েট এসবের কোনো নিয়ম মানতেন না। ওষুধের জন্য একটু পেটের সমস্যা শুরু হয়। ওনার কোমরেও বিশাল সমস্যা ছিল। আসলে ওবেসিটি-র কোনো মা বাপ ছিল না।
একদিন কলকাতায় প্রিয় বন্ধুকে ফোন করি যে আইসিসি ইউ র ইনচার্জ। সবটা শুনে বলে: তুই কি শালা পাগল হয়ে গেছিস? কি দরকার ওই রুগী ওখানে রেখে? কোনদিন হার্ট অ্যাটাকে পুট করে মরে যাবে, কেস খাবি তুই। বল এসব চিকিৎসা এভাবে হয় না!??
এর উপর উনি সব ভুলে যেতেন প্রায়। মাঝে মাঝেই মেসেজ করে কোন ওষুধ কখন খেতে হবে লিখে পাঠাতে হতো।
ওষুধ শেষ হলে তুলে বাড়ি দিয়ে আসতাম।
ওনার Mrs অধ্যাপিকা ছিলেন। অনুরোধ করেছিলাম এখানে এসে ওনার সঙ্গে থাকতে।
উনি বললেন কি করে আসবো। আমিও চাকরি করি। ব্যস্ত মানুষ। তুমি তো আছো।
তিন মাসের মধ্যে ওনার সুগার নরমাল হয়ে যায় ওষুধের জন্য, আর তারপরেই উনি কলকাতায় বদলি হয়ে যান।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
তারপরে কলকাতার ডাক্তারের ওষুধ পত্র, ইনভেস্টিগেশন আবার করে সব উনি হোয়াটস অ্যাপ করতেন। প্রায় একই ওষুধ সব চলতো। আমি বুড়ো আঙ্গুল দেখাতাম। অবসরের পর উনি সব পাঠাতেন, না আর লাইক দিতাম না।
উনি এখন অবসরকালীন জীবন কাটাচ্ছেন।
আমার যে ছুটি হয় নি এখনো।
আর ওই তিন মাস যে রাতের ঘুম ছিল না আমার!!!!!