ডা সুব্রত গোস্বামীকে সবার দেখাদেখি আমিও টাকোদা বলেই বলি বটে, কিন্তু আমি তাঁকে খুবই কম চিনতাম। মুখোমুখি দেখা হয়েছে এক কি দু’বার। কথা হয়েছে আদতে তিনটি কি চারটি বাক্য।
কিন্তু, মুশকিল হলো, টাকোদাকে আমি খুবই ভালো করে চিনতাম। সামনা-সামনি না হলেও, বাকিদের মুখে শুনে।
তাঁর সম্পর্কে খুবই বিস্তারিতভাবে যার কাছে জেনেছি, সে হলো কাঞ্চনদা। ডা কাঞ্চন মুখার্জি – ডাক্তারকুলে আমার সবচাইতে প্রিয় কয়েকজন মানুষের মধ্যে একজন। তো কাঞ্চনদার মুখে শুনতে শুনতেই আমার মধ্যেও যেন টাকোদার প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গেছিল। ভালোবাসা, আর খানিক বিস্ময়ও। আজ তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমিও শোকগ্রস্ত।
কিন্তু আজ টাকোদা বা তাঁর মৃত্যু নিয়ে নয়, কথা বলব একখানা বই নিয়ে।
তো কাঞ্চনদা একদিন বলল, একটু ব্যস্ততার মধ্যে আছে, কেননা অনুপদার (অনুপ ধর) সঙ্গে বসে দুজনে মিলে একটা বই লিখছে। শুনেই ভালো লাগল। কেননা, কাঞ্চনদা যেমন সুন্দর বলে, তেমনই সুন্দর লেখে। কিন্তু লিখতে তার বড় আলস্য। কিন্তু ব্যস্ততা কেন? না, বইটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।
শেষের কথাটা শুনে খটকা লাগল। তাড়াতাড়ি কেন? জানলাম, টাকোদাকে নিয়ে বই। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বইয়ের কাজ হচ্ছে। টাকোদার শরীরের যা অবস্থা, তাতে সবই অনিশ্চিত। টাকোদা যদি অন্তত বইটা দেখে যেতে পারে…
খারাপ লাগল। মোটর নিউরন ডিজিজ। নিরাময়যোগ্য নয় তো বটেই, এমনকি অবস্থার অধোগতি আটকে রাখাটাও সহজ নয়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি টাকোদার মত মানুষ চলে যাবে!! কাঞ্চনদা বলল, জানি না, হয়ত অত তাড়াতাড়ি তেমন কিছু ঘটবে না, কিন্তু মন বলছে…
তো বই হল। প্রকাশিত হল। অনুষ্ঠানে টাকোদা এসেছিলেন। হুইল চেয়ারে বসে থেমে থেমে কয়েকটা কথাও বলেছিলেন। এত মানুষ ভিড় করে তাঁকে নিয়ে বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছেন, দেখে টাকোদার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল একটা সলজ্জ খুশির ভাব।
বইটা কেমন?
কাঞ্চনদার গদ্য অত্যন্ত তরতরে। সঙ্গে অনুপদা। কাজেই, এ বই যে অত্যন্ত সুখপাঠ্য হবে, তাতে অবাক হইনি। টাকোদার জীবনও সবাইকে জানানোর মত। আচারনিষ্ঠ গোস্বামীবাড়ির একটি ছেলের বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার গল্প, মেডিকেল কলেজের বাম ছাত্র আন্দোলনের গল্প – আর তারও আগে, একজন মানুষের, এক অসামান্য মানুষের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার গল্প, আরও অনেক মানুষের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প।
একইসঙ্গে এক অসামান্য ডাক্তারেরও গল্প। যিনি জীবনের শেষ ভাগে এই রাজ্যে ব্যথা-যন্ত্রণার চিকিৎসার অন্যতম পুরোধা হয়ে উঠবেন – পেইন ম্যানেজমেন্টকে ডাক্তারিবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন – দেশের পূর্বাঞ্চলে তার উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের উৎকর্ষকেন্দ্র তৈরি করবেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও মানবিকতা এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা – এই দুই ততখানি-সুলভ-নয় এমন গুণের মিশেল ঘটিয়ে গড়ে তুলতে পারবেন এমন কিছু, যা এক নিঃশব্দ বিপ্লবের চাইতে কম কিছু নয়।
বইটা পড়ে নিজের মুগ্ধতার কথা কাঞ্চনদাকে আগেও জানিয়েছিলাম (কিন্তু সে নিয়ে আগে কিছু লিখিনি), কিন্তু সঙ্গে কিছু অনুযোগও ছিল।
যে সমস্ত উপসর্গের জন্য মানুষ ডাক্তারের কাছে আসে, ব্যথা-যন্ত্রণা তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। এবং এ এমন উপসর্গ, যার উপশম না করতে পারলে রোগের চিকিৎসাও অনেকসময়ই অর্থহীন হয়ে যায়। কিন্তু এমন অনেক অসুখই থাকে, যার নিরাময় তো দূর, অনেক উপসর্গের উপশমও সবসময় সম্ভব হয় না। তবু, তেমন ক্ষেত্রেও, ব্যথা-যন্ত্রণার উপশমে যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হয়। পেইন ম্যানেজমেন্ট-এর বিশেষজ্ঞদের কাছে নিশ্চিতভাবেই এমন অনেক অনেএএক মানুষ যান, অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতা ও উপশমের-অযোগ্য উপসর্গ যাঁদের উত্তরোত্তর হতাশ করে তোলে। তিলে তিলে নিশ্চিত মরে যাচ্ছেন যাঁরা, সেই যাত্রাপথের বিভিন্ন মুহূর্তে, ফাঁপা আশার বুলি না শুনিয়ে রোগীর মনোবল জোগাতে পারা, কাজটা চিকিৎসকের পক্ষে সহজ নয়।
আর যে চিকিৎসক এত বছর ধরে তেমন মনোবল জুগিয়ে এলেন, নিজের ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতির উদয় হলে, সেসব ক্ষেত্রে সেই চিকিৎসকটি কীভাবে ভাবেন?
এক আশ্চর্য যাত্রাপথের শেষের মুখে দাঁড়িয়ে, এমনকি ষাট অব্দি পৌঁছাতে না পারা টাকোদা কীভাবে আসন্ন অনিবার্যতাকে দেখছিল? কেন কাঞ্চনদা সে কথা জিজ্ঞেস করল না?
কাঞ্চনদা আমার অভিযোগ মেনে নিয়েছিল। বলেছিল, দ্যাখ, কথাটা তো আমার মাথায় এসেছিল বটেই। জিজ্ঞেসও করেছি বারকয়েক। কিন্তু জানিস তো, এই দিকে কথাটা যতবারই নিয়ে যেতে চেয়েছি, বুঝতে পেরেছি, একটা যেন বাধার দেওয়াল আমাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। একবার স্পষ্ট ভাষায় জিজ্ঞেসও করলাম। বলল, না, এ নিয়ে আলাচনা করতে পারার মত মানসিক প্রস্তুতি আমার এখনও হয়নি। মানে, ও নিজে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত – কেননা, এটা যে অনিবার্য, এবং খুব বেশিদিন বাকি নেই, এটুকু ও অবশ্যই জানে – কিন্তু সে নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য প্রস্তুত নয়। বুঝতে পেরেছি, যে, এই বেরিয়ার-টা আমরা ভাঙতে পারিনি। ভাঙার চেষ্টা করা উচিত ছিল কিনা, সেটাও নিশ্চিত করে বুঝতে পারিনি। লেখক হিসেবে হয়ত কাজটা উচিত ছিল – কেননা, এমন চিকিৎসকের সেই মুহূর্তের ভাবনাটা ডকুমেন্টেড থাকলে সত্যিই ভালো হত। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধা – এক অর্থে ভাই ও শিষ্যও – হিসেবে ভাঙার চেষ্টা করতে মন সায় দেয়নি। হয়ত আরও একটু সময় দিলে, আরও অনেক বার একটু একটু করে কথা বলতে বলতে এই দেওয়ালটা ভাঙা যেত – বা ফাটল ধরিয়ে সেই ফাটলের ফাঁক দিয়ে কিছু কথা জানা যেত – কিন্তু, তুই তো জানিসই, আমাদের হাতে আর কতদিন আছে, সেটাই তো বুঝতে পারছিলাম না। তাড়ায় ছিলাম।
কাঞ্চনদাকে বলেছিলাম, ঠিক আছে। বইটা হয়ে রইল। টাকোদার সঙ্গে আরও কথা বলতে থাকো। পরের সংস্করণে এই প্রসঙ্গটা জুড়লে বইটা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে।
না। তা আর হল না।
বই প্রকাশ হয়েছিল, একুশে ফেব্রুয়ারি। এ বছরেই। আর আজ টাকোদা মারা গেল। সাড়ে চার মাস। কাঞ্চনদা ঠিকই বুঝেছিল। হাতে বেশি সময় ছিল না।
যেকোনও মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়ার মতোই, কাঞ্চনদা-অনুপদার ‘অবেদন’ বইখানাও রইল – খুঁত সহ, খানিক অপূর্ণতার অনুভূতি নিয়েই।
তেমনই থাকুক না। যা রইল, তা তো কম কিছু নয়। কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে গিয়ে যা পেলাম, তা হারাব কেন? এক উজ্জ্বল মানুষ, যিনি তখনও অব্দি নিজের আসন্ন মৃত্যু নিয়ে আলোচনার জন্য তৈরি নন, তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনার সুযোগ তো কম কিছু নয়। সেটুকুই রইল, চেটেপুটে নেওয়ার জন্য। শেখার জন্য।
অবেদন
কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় ও অনুপ ধর
প্রণতি প্রকাশনী
বই পেতে চাইলে, ফোন/হোয়াটসঅ্যাপ করুন 8100042650 নম্বরে