কিভাবে সবচেয়ে বেশী লোক আত্মহত্যা করে? বিষ খেয়ে, জলে ডুবে, গায়ে আগুন লাগিয়ে, গলায় দড়ি দিয়ে অথবা উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে?
না, এর একটিও নয়। সবচেয়ে বেশী মানুষ যে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে রোজ আমাদের চোখের সামনেই আত্মহত্যা করছে সেই পদ্ধতির নাম ধূমপান।
ধূমপানের গৌরব পূর্ণ ইতিহাস বহুদিনের। রাজা- মহারাজাদের সোনা বসানো রুপোর গড়গড়া অথবা পুরনো বাংলা সিনেমায় ছবি বিশ্বাস বা পাহাড়ি সান্যালের হাতে রাজকীয় চুরুট আমাদের নস্টালজিয়ার মুখোমুখি দাঁড় করায়। পরীক্ষার আগের রাত জাগা, প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা, কলেজের প্রথম দিন, চাকরির প্রথম মাইনে এসবের সাথে অনেকেরই সিগারেটের সুখটানের স্মৃতি জুড়ে আছে। নিঃসঙ্গ বিকেলে অথবা চরম ব্যর্থতায় পরম বন্ধুর মত পাশে থাকে সে।
একজন ধূমপায়ী এরকম অসংখ্য যুক্তি দেখাতে পারে। কথাতেই আছে দুর্বৃত্তের ছলের অভাব আর নেশাড়ুর যুক্তির অভাব হয়না। তবে তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, সিগারেট যদি সত্যিই প্রকৃত বন্ধু হয়, তাহলে বন্ধুত্বের সুযোগে কেন সে বুককে ঝাঁঝরা করে দেয়? কেন বন্ধুকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে? এই কীরকম বন্ধুত্বের নমুনা?
এবার একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক অনেকের এই অবিস্মরণীয় বন্ধুটি কি বস্তু দিয়ে তৈরি? সিগারেট তৈরি হয় তামাক পাতা দিয়ে। তামাক দহনের ফলে তৈরি হয় অনেকগুলি বিষাক্ত পদার্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক পদার্থ তিনটি হ’ল- টার, নিকোটিন আর কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস।
টার দায়ী ধূমপান জনিত ক্যানসার গুলির জন্য। যার মধ্যে আছে ফুসফুসের ক্যানসার, মুখ গহ্বরের ক্যানসার, শ্বাসনালীর ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসার, অগ্নাশয়ের ক্যানসার, যকৃতের ক্যানসার, মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ুর ক্যানসার ইত্যাদি… ইত্যাদি…। এই সব ক্যানসার থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়- মৃত্যু।
নিকোটিন আর কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস হৃদপিণ্ডকে দুর্বল করে ফেলে। রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। রক্তকে রক্তনালীর মধ্যেই অনেক সময় জমিয়ে ফেলে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক অথবা স্ট্রোক হওয়াও বিচিত্র নয়।
এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থগুলি একত্রে শ্বাসনালীর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা একেবারে কমিয়ে দেয়। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের অবাধ বিচরণ হয়ে দাঁড়ায় শ্বাসনালী আর ফুসফুস। টি বি, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া ইত্যাদি অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।
এছাড়াও ঘরে কেউ ধূমপান করলে বাচ্চাদের উপরে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। একে ইংরাজিতে বলে প্যাসিভ স্মোকিং।পরবর্তী কালে তাদের ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের অসুখের সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। কমদামী সিগারেট না খেয়ে দামী ফিল্টার যুক্ত সিগারেট খেলে মানসিক সান্ত্বনা ছাড়া আর কোনও লাভ হয়না। কারণ প্রধান ক্ষতিকারক পদার্থ তিনটি টার, নিকোটিন আর কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস কোনোটিই ফিল্টারে আটকায়না। বিড়ি খেলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশী।
সরকার অবশ্য একেবারে বসে নেই। লোক দেখানো অনেক পদক্ষেপই সরকারের তরফে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সালে সিগারেট এক্ট পাশ হয়, যা ১৯৭৬ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে চালু হয়। তারিখটা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন এটা সরকারের তরফে একটা এপ্রিল ফুল ছিল। এই আইনে তামাকজাত দ্রব্য তৈরি, প্রচার ও বিক্রয়ের উপর কিছু বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়। স্থির হয় প্যাকেটের গায়ে ইংরাজিতে লেখা থাকবে “সিগারেট স্মোকিং ইজ ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ।” আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ যেখানে মাতৃ ভাষাতে ঠিকমতো নাম সই করতে পারেনা, সেখানে ইংরাজিতে লেখা সাবধান বাণী একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরবর্তীতে লেখার সাথে ছবি দেওয়ার নিয়ম হয়েছে। সেই ছবির আকৃতিও ক্রমশ বাড়ছে। বদ্ধ জায়গা যেমন সিনেমা হল, হাসপাতাল, যানবাহন, রেলস্টেশন ইত্যাদি জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। ধূমপায়ীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে ধূমপান ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সরকার কেন তামাকজাত দ্রব্য বা মদের মত অন্যান্য নেশার দ্রব্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ করছে না, সেটা বোঝা এমন কিছু কঠিন নয়। কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়া যায় এই দ্রব্যগুলি থেকে। তাতে বেশ কিছু মানুষ মরলে মরুক। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বোঝানোর পাশাপাশি সরকারের উপর লাগাতার চাপ তৈরি করতে হবে তামাকজাত দ্রব্য নিষিদ্ধ করার জন্য।
সবশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মায়ার খেলা নাটকের একটি গান প্যারোডি করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
আমি জেনে শুনে ধূম করেছি পান
প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছি টান
যতই শুষী তারে ততই দহি
আপন রোগ ভোগ নীরবে সহি
তবু পারিনাগো ছাড়িতে তারে
লইগো বুক ভরে অনল বাণ
আমি জেনে শুনে ধূম করেছি পান
যতই কাশি দিয়ে দহন করে
ততই বাড়ে তৃষা তাহার তরে
বক্ষ ভরে তারে যতই যাচি
ততই প্রাণে করে অশনি দান
আমি জেনে শুনে ধূম করেছি পান।।
©️ ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বেশ কয়েকবছর (৬/৭) ধরেই সিগারেট এবং বিড়ি দুটোই খাচ্ছি…বয়স ২৯ বছর…মেইল
১) কি কি পরীক্ষা করালে জানতে পারব উপরোক্ত রোগগুলোর থাবা বসিয়েছে কিনা
২) ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া টেস্টগুলো করা সম্ভব প্রাইভেট টেস্টিং সেন্টার থেকে?
৩) মোটামুটি কি রকম খরচা টেস্টগুলো করাতে?
৪) রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর এখানে দিলে কি আপনি কি দেখে দেবেন গণ্ডগোল কতটা শুরু হয়েছে?