পিঁপড়েরা আসার কথা। এসেওছিল।
অবিনাশ মিত্র বিলেত ফেরত। পাগল কিম্বা বাতিল বিজ্ঞানী। বয়স্ক। একলা মানুষ। আমাদের কেউ কেউ তাঁকে পিঁপড়েদের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। পাড়ার রেজিস্টার্ড বেকার আমরা, ক্লাবে ক্যারাম পেটাই। খুব পিঁপড়ে হয়েছে ক্লাবঘরে। মাঝে মধ্যে দুঃখ করে বলতেন, “মানুষেরা কী বোকা। এলিয়েনদের সঙ্গে কথা বলতে চায় রেডিও সিগন্যালে পাঁয়তারা মিশিয়ে। অথচ এই গ্রহেরই সমাজবিজ্ঞানী পিঁপড়েদের সাথে আলাপ জমাতে পারল না।”
নিজেদের মধ্যে চোখ মটকে বলতাম, “আপনি পেরেছেন?”
উদাস উত্তর দিতেন, “নইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদের সাথে গপ্পো করি কীভাবে?”
“পিঁপড়েদের ভাষা শিখেছেন বুঝি?”
ঠাট্টাটুকুকে পাত্তা না দিয়ে বলতেন, “মগজের ভাষা পড়তে পারলে অন্য ভাষা লাগে না হে।”
পড়াশুনো জানা টুকাই বলত, “ইয়ে, টেলিপ্যাথি? শুনেছিলাম যে ওদের বেলা ফেরোমন?”
রেগে যেতেন। “কেন, বেচারিদের কি মগজ নেই, না তার ভাষা থাকতে নেই?”
“আমাদের শেখাবেন?”
“আমার সব স্মৃতি মরার সময় ওদেরকে দিয়ে যাব। আমি অবিনাশ, অবিনশ্বর। ওদের কাছ থেকে সবটুকু জেনে নিও।”
টুকাইটা মহা ত্যাঁদড়। “আপনার এত বড়ো ব্রেন, ওই পুঁচকে পিঁপড়ের মাথার এতটা আঁটবে?”
আশ্বস্ত করতেন, “ওয়ান টিবি মেমারি অনেক পেন ড্রাইভে ভাগ ভাগ করে ভরে রাখা যায়। তেমনই অনেকের মাথায় দিয়ে যাব। ওরা রাজি হয়েছে।”
সেই অবিনাশের অসুখ করল মস্ত। আমরাই হাসপাতালে ভর্তি করালাম।
ডাক্তার বলল, “ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। যে ক’দিন আছে বাড়িতেই সেবাযত্ন কোরো।”
বাড়ির লোক বলতে অনাত্মীয় আমরা ক’জন। অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছিল। খালি বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়তেন। জড়ানো গলায় প্রলাপ, ‘পিঁপড়েরা আসবে।’
আমরাও জানতাম পিঁপড়ে আসবে। মড়ার গন্ধে গন্ধে পিঁপড়ে আসে।
তারা কিন্তু এল অবিনাশ মারা যাবার আগেই। পাড়ার ডাক্তার জবাব দিয়ে বেরিয়ে যাবার পরই পিঁপড়েরা এল। লাল কালো মখমলের ঢেউ, খোলা দরজা জানালা, অসংখ্য ছিদ্রপথে তারা ভিড় করে এল। অবিনাশের চারপাশে। সারিবদ্ধ। ওই জীবন্ত লাল কালো মখমল স্থির নয়। স্পন্দমান। পুরনোরা কিছুক্ষণ স্থির থেকে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তায় ফিরে যাচ্ছিল। নতুনেরা আসছিল শূন্যস্থানে। এমনিভাবে পুরো একটা দিন অবিনাশ পড়ে রইলেন পিঁপড়ে-সমুদ্রে। একসময় তারা সবাই ফিরে গেল।শ্বাস ঘন হল ক্রমশ। এত কষ্ট, অচেতন অবিনাশের ঠোঁটে কিন্তু পরম নিশ্চিন্তির হাসি। শ্বাসটুকুও বন্ধ হল একসময়।
অবিনাশ চলে গেলেন।
টুকাই বলেছে, “আসলে যাননি। স্মৃতি ট্রান্সফার করে গেছেন যাবার আগে। ছোটো ছোটো টুকরোয়। পিঁপড়েদের ছোটো ছোটো মগজে।”
আমরা ক্লাবঘরে ক্যারাম খেলার সময় পিঁপড়ে দেখলে আর আগের মতো টিপে মারি না। ওরা সবাই একসঙ্গে এখন অবিনাশ।