অসিতবাবু চেম্বারে রোগী দেখিতে দেখিতে বুকের বামদিকে হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করিলেন। তিনি স্বীয় অভিজ্ঞতা হইতে বুঝিলেন, সময় আর বিশেষ নাই। ডাক আসিয়াছে। এই মুহূর্তে ধরাধাম ত্যাগ করিতে হইবে।
তবু প্রতিবর্ত ক্রিয়াবশতঃ সম্মুখের ড্রয়ারে সযত্নে রক্ষিত সর্বিট্রেট এবং অ্যাস্পিরিন নামক দুইখানি প্রাণদায়ী ঔষধ মুখে ফেলিয়া দিলেন। কিন্তু নিয়তি দেবী অন্যরূপ ভাবিয়াছিলেন। ঔষধের বড়ি দুখানি চিবাইবার পূর্বেই তাঁহার মুখগহ্বর হইতে ফেনা বাহির হইয়া আসিল। তিনি সম্মুখের টেবিলের উপর লুটাইয়া পড়িলেন।
কর্মচারীগণের ছুটাছুটি, রোগীদের কোলাহল, বিহ্বলতা, ট্রলির ঘষটানি, অ্যাম্বুল্যান্সের অভ্রভেদী হুটার ইত্যাদিতে হাসপাতালের কোলাহল কিঞ্চিত বৃদ্ধি পাইল।
বেসরকারী হাসপাতাল। আউটডোরের ঘরগুলিতে চিকিৎসকগণ ও বাহিরে রোগী ও তাহাদের সঙ্গীগণ অবস্থান করিতেছেন। দু-চারিজন চিকিৎসক দ্বার হইতে মুখ বাড়াইয়া পরিস্থিতি উপলব্ধি করিয়া আবার দ্বার রুদ্ধ করিয়া রোগীর চিকিৎসায় মনোনিবেশ করিলেন। ত্রিকালদর্শী ঋষিদের ন্যায় তাহাদের মুখের ভাব ব্যত্যয়হীন।
অকুস্থল যদি হাসপাতাল না হইয়া আদালত হইত, নিদেনপক্ষে ব্যাঙ্ক বা সরকারী অফিস বা অন্য কোনো কর্মস্থল হইত- তাহা হইলে তুমুল হইচই বাধিয়া কর্মস্থলের সকল কর্মকান্ড মূলতুবি হইয়া যাইত। কিন্তু হাসপাতালে তাহা সম্ভব নহে। প্রথমতঃ রোগীর চিকিৎসায় অবহেলা করা চলে না। দ্বিতীয়তঃ, চিকিৎসকে-চিকিৎসকে সচারাচর তেমন সৎভাবও থাকে না। পরিশেষে, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনা চিকিৎসকগণের কাছে এতই সাধারণ ও তুচ্ছ যে চিকিৎসকের মননে তাহা তেমন উদ্বেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করে না।
অপেক্ষমান রোগী ও তাহার পরিজনেরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিঞ্চিৎ হতবুদ্ধি হইয়া গেল। তবে তাহাদের চিন্তার বিষয় এই যে- ‘পূর্ব হইতে জমা করা ডাক্তারবাবুর ফী কি উপায়ে ফেরৎ পাওয়া যাইবে। ফী কম নহে!’ অথবা ‘সম মানের অন্য কোনো চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কি উপায়ে পাওয়া যাইবে’ ইত্যাদি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খবর পাইয়া ‘ শোকসভা কবে হইবে’, ‘তাহাতে কত খরচ হইবে’ ‘স্পনসরশিপ মিলিবে কি না’, ‘ডাক্তারবাবুর বদলী রূপে কাহাকে কি উপায়ে পাওয়া যাইবে’ ইত্যাদি লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
তবে অসিতবাবু ততক্ষণে এই সকল পার্থিব বিষয়ের উর্দ্ধে চলিয়া গিয়াছেন। তিনি টেবিলে লুটাইয়া পড়িবার মুহূর্ত মধ্যে পরলোকের দ্বাররক্ষকের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন।
(ক্রমশঃ)
ছবি: অন্তর্জাল