শেষ নাহি যে…
সান্তালেখোলার বনবাংলোয় এক ঝড়ঝঞ্ঝাকুল মধ্যরাত্রি। টিনের চালে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দ আর মেঘগর্জনে ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। বাইরে গহন অন্ধকারে মুষলধারা, চকিতে চকিতে বিদ্যুৎচমক। ঘনঘোর রাত্রিতে সব ভয় ভুলে কিসের অমোঘ টানে সে কটেজের বাইরে চলে আসে। বৃষ্টিভেজা মাঠের উপর দিয়ে সেই নিশির ডাকে এগিয়ে যায় মূল দুয়ারের দিকে। লোহার দরজা পার হলেই সামনে ঝোলাসেতু অবধি পায়ে চলা পথ, ডাইনে বর্ষারাতের উদ্দাম পাহাড়ী খোলা, দুইপাশে নিকষ নিবিড় অরণ্য। পথের পাশে বেঞ্চের উপরে একটা এত্তবড় সাদা-নীল বস্তা পড়ে আছে না? কিসের বস্তা ওটা? ওহ্ মা গো, এরকম ব্যাগ ত সে আগে অনেকবার দেখেছে, কোভিড হাসপাতালে তার সামনেই যখন বডি প্যাকিং করত রবীন নামের সেই ছেলেটা। সেই জিনিস এখানে, এই ঝড়জলের রাতে! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ওই তো, ব্যাগের চেনটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে, যেন ধুয়ে যাচ্ছে উপরের আবরণ। একজন মানুষ ভিতর থেকে উঠে দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে। হাতা গোটানো স্ট্রাইপ শার্ট। একেআর? একেআর!! শক্ত হাতে লোহার দরজা আঁকড়ে ধরে নন্দিনী। পা কাঁপছে তার। দশদিক জুড়ে অবিরাম প্রলয়। মানুষটি একবার ঘুরে তাকালেন বর্ষণসিক্ত স্থাণুবৎ নন্দিনীর দিকে। যেন কোন্ দূর থেকে বর্ষায় গলতে থাকা অস্ফুটস্বরে আলতো হেসে বললেন – “আমি কিন্তু স-অ-ব বুঝতে পারতাম। এ হয় না। মনোজিতকে খেয়াল রেখো। ও তোমায় খুব ভালোবাসে।” একছুটে এগোতে গেল নন্দিনী – কিন্তু তালাবন্ধ লোহার দরজায় যেন গেঁথে যায় সে। রক্ত ঝরতে থাকে সর্বাঙ্গে, জলের ধারায় মিশে যায় সে যন্ত্রণাময় ক্ষরণ। ধীর নিশ্চিত পদক্ষেপে, কতক যেন হাওয়ায় ভেসে, উন্মত্ত নদী পার হয়ে, গহন বনের ধার ধরে গভীর কোন্ অন্ধকারে মিলিয়ে যান ডাঃ অরুণকান্তি রায়। শুকনো গলায় চিৎকার করে ওঠে নন্দিনী – “ডাক্তারবাবু, একটু শুনে যান….।”
“ওই, কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গোঁ গোঁ করছ?” – স্বামীর আকুল ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙে নন্দিনীর। বাইরে আলোময় আকাশ, মাথার উপরে পাখা ঘুরছে, সে রয়েছে ব্রহ্মপুরে তার শোওয়ার ঘরে। গতকাল পয়লা জুলাই ছিল – ডাক্তার দিবসে সোশাল সাইটে কোভিডে মৃত চিকিৎসকদের মাঝে একেআরের ছবি, তার নিজের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আর একেআরের মৃত্যুর একমাস পূর্ণ – সব মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে নন্দিনী স্বপ্নে দেখল একেআরকে – এই প্রথম।
পরের ছ’মাসে সে ধীরে ধীরে তার শোক সইয়ে নেওয়ার লড়াই করেছে, না পারলে নিদেনপক্ষে অন্যের কাছ থেকে গোপন রেখেছে। অবশেষে মনোজিতের ভালোবাসার দাবিতে ডাঃ দেবলীনা মিত্রকে দেখাতে গিয়েছে – যে সময় থেকে অকিঞ্চিৎকর কাহিনী শুরু হয়েছিল – ডিসেম্বর, দু হাজার একুশ।
কিছুদিন পরেই কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ এল – ওমিক্রন। স্কুলের পড়াশোনা অতএব তখনও বন্ধ। নিরালা দুপুরে নন্দিনী পুরানো ফাইল বার করে ডাঃ অরুণকান্তি রায়ের প্রেসক্রিপশন পড়ে, তাতে হাত বুলিয়ে দেখে। বেচারা কাগজগুলি রোজই ভেজে। ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে সে আবার যত্ন করে তুলে রাখে। শূন্য ঝুলবারান্দায় বসে থাকে সময়ে অসময়ে। দু তিনটি ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বাংলার অখ্যাত প্রাচীন মন্দির নিয়ে ওঁর লেখাগুলিও বারবার পড়ে নন্দিনী। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু একজন চিকিৎসক যিনি অল্পবয়সে ইতিহাসবিদ হতে চেয়েছিলেন। সহজ ভাষায় ছোট ছোট লেখা, যাত্রাপথ ও স্থানীর জনপদের বর্ণনা সমেত। বোঝাই যায়, সপ্তাহান্তের অবসরে কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে মূলত লোকশ্রুতির উপরে ভরসা করে শখের ইতিহাসচর্চা। ঝরঝরে লেখনী, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সবক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটিমুক্ত নয়। পড়তে পড়তে অজান্তেই কখন একেআরের গোপন বিরহী সত্তার মধ্যে থেকে প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ উঁকি দেয় – ‘উঁহু, এই বিষয়টা আরেকটু বিস্তারে আলোচনা করলে আরও ভালো হত, এই মন্দিরের সময়কালে ত বাংলায় তুর্কী শাসন শুরু হয়নি’…।
এইসব ভাবতে ভাবতেই নন্দিনী একদিন দেবশ্রীদির নম্বর খোঁজে। আছে, আছে। ডঃ দেবশ্রী ঘোষাল। স্কটিশ চার্চের সিনিয়র ছিলেন। এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক। কয়েকবছর আগে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে নূতন করে আলাপ। অনেক দ্বিধা কাটিয়ে অবশেষে ফোনটা একদিন করেই ফেলে।
“দিদি, নন্দিনী বলছি। এক বছরের জুনিয়র। চিনতে পারছ? কেমন আছ?”
“হ্যাঁরে! খুব পারছি। তুই কেমন আছিস রে? মনোজিৎ ভালো আছে? তোর ছেলে না মেয়ে – সব ঠিক আছে? গ্রুপে দেখেছিলাম তোর বেশ বাজে রকমের করোনা হয়েছিল। এখন ভালো ত রে?” – উষ্ণ প্রত্যুত্তর আসে ফোনের ওপার থেকে।
“দিদি, আমি পিএইচডি করব। করা যাবে? এখন ত অনেক নূতন নিয়ম-টিয়ম হয়ে গেছে শুনি। যদি করা যায়, কি উপায় আছে বলো।”
“যাবে। একটু পড়াশোনা করতে হবে। ইউনিভার্সিটির একটা পরীক্ষা দিতে হবে। তুই পারবি। তোর যে এতকাল বাদে সদিচ্ছা হল এটাই আসল কথা। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েও ত মাস্টার্সের পরে আর এগোলি না।”
“করা যাবে! বলো কিভাবে এগোতে হবে?” – আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নন্দিনী।
“একদিন একটু কষ্ট করে ডিপার্টমেন্টে আয়। আলিপুরে। আড্ডা মারতে মারতে সব বলব। যতটা পারি গাইড করে দেব আমার সাধ্যমত। আরও অনেকে আছেন। নিশ্চয় হবে।”
পাঁচটি পর্ব ধরে অতীত ও বর্তমানে যাতায়াতের পালা এখানেই শেষ। গল্পে সময়যানে চড়া অবৈধ নয়। সে রথ চালিয়ে পিছনে যেমন, সামনেও এগোনো চলে। তবে কল্পবিজ্ঞান-টিজ্ঞান হল গিয়ে অনেক বড় ব্যাপার, আমাদের এ কাহিনী নেহাতই এক আটপৌরে এক মেয়ের শোক থেকে উত্তরণের ভাবী কল্পগাথা। বিরহে বিলীন হয়েও প্রণয়পাত্রের আরব্ধ কাজে নিজেকে নিয়োগ করে এ এক অন্যরকম বিরহবাস।
জুলাই, দু হাজার বত্রিশ। আজ থেকে দশ বছর পরে। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাঘর। ডঃ নন্দিনী সরকারের প্রথম বই ‘দ্য মিডিভাল টেম্পলস্ অব আনডিভাইডেড বেঙ্গলঃ আ জার্নি থ্রু হিস্ট্রি’ – র প্রকাশ অনুষ্ঠান৷ শুরুতে ঘোষক মহাশয় পুস্তক ও লেখক পরিচয়ে জানালেন – “স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়ে প্রায় দু দশক বিরতির পরে, একদিকে জননী ও স্ত্রী এবং অন্যদিকে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যযুগীয় মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট অর্জন করেন নন্দিনী দেবী। এখানেই তাঁর যাত্রা থেমে যেতে পারত। তিনি কিন্তু অন্যরকম ভাবলেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ সম্মতি ও সহায়তা নিয়ে এবারে তিনি ওপার বাংলার কয়েকশ মন্দিরের ইতিহাস মন্থন করে তুলে আনলেন সমসময়ের সমাজ, অর্থনীতি, লোকবিশ্বাস, বিভেদ ও সম্প্রীতির ইতিবৃত্ত । এই অনলস পরিশ্রম ও মেধামণ্ডিত গবেষণার ফল দুটি খন্ডে বিভাজিত আজকের এই বই। আমরা নিশ্চিত একদিন তাঁর প্রয়াস এই বিষয়ে একটি আকরগ্রন্থের স্বীকৃতি পাবে।” সাধুবাদে উচ্চকিত হয়ে ওঠেন উপস্থিত মুষ্টিমেয় বুধমণ্ডলী।
সামনের সারিতে বসে ক্যালিফোর্নিয়াতে ছেলেকে লাইভ স্ট্রিমিং পাঠাচ্ছিল মনোজিৎ। প্রকাশ অনুষ্ঠান শেষ হতে নেমে এল নন্দিনী। দু বছর আগেই পঞ্চাশোত্তীর্ণা। জ্ঞানে, আত্মবিশ্বাসে, সফলতায় উজ্জ্বল। মনোজিতের পাশে বসে বইয়ের মোড়কটি খোলে সে। তারপরে হাতে তুলে দেয়। পিকু যাতে দেখতে পায়, সেই মতো বাঁ হাতে ফোনটি ধরে ডান হাতে বাঁধাই মলাট সরিয়ে উৎসর্গপত্রে পৌঁছায় মনোজিৎ৷ ঝাপসা চোখে দেখে – ‘ডেডিকেটেড টু শ্রী মনোজিৎ সরকার। মাই আনসাঙ হিরো’।
সমাপ্ত