সব হাসপাতালেরই কিছু পোষা পেশেন্ট থাকে। এরমধ্যে কিছু পাগল, কিছু পোড়া রোগী, শেষ অবস্থায় চলে আসা কয়েকজন আর হাড়ের ব্যামো নিয়ে শয্যাশায়ী কিছু মানুষ থাকবেই। যে হাসপাতালে ছিটেল, নাছোড়বান্দা রোগী নেই সেই হাসপাতাল হাসপাতাল পদবাচ্য নয়। কিছু কিছু রোগী আবার কম্বোপ্যাক, একটা রোগের সঙ্গে আরেকটা রোগ ফ্রি বাগিয়ে বসে থাকে। বেচারিদের পুজোর সময়েও হাসপাতালে কাটাতে হয়।
ঘটনাটা বেশ কয়েকবছর আগের। যে হাসপাতালটির কথা বলছি সেটি একেবারে বড়ো রাস্তার ধারে। তিনতলার জানালা থেকে পরিষ্কার রাস্তা দেখা যায়। আর তিনতলাতেই অর্থোপেডিক ওয়ার্ড। পা ভাঙা রোগীদের বেশকিছু দিন ভর্তি থাকতে হতো বলে তারা ঠিক ভালো বেডগুলো ম্যানেজ করে নিতো। (হোস্টেলের সিনিয়রদের যেমন দেখা যায় আরকি। অবশ্য জানালা দিয়ে কোনো জুনিয়র পেশেন্টকে ফেলে দেবার ঘটনা শোনা যায়নি।) একজন ডাক্তার তো জানালার দিকের অংশকে পা-হাড় বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। পুজোর দিনগুলোয় পাহাড় অংশের ডিমান্ড বেশ বেড়ে যেতো। মন্ডপে ঠাকুর যাওয়া থেকে শুরু করে পুজোর সময়ে রাস্তার মানুষ দেখা, দশমীর দিন বিসর্জনযাত্রা দেখা সবই চলতো জানালা দিয়ে। অন্যান্য বেড থেকে রোগী এসে ভিড় করতো সবচেয়ে ভালো জানালায়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে ভাঙাচোরা মানুষগুলোরই ক্ষতি। একজন পায়ে বসানো প্লেট ভেঙে বসলো। একটু ক্ষ্যাপা টাইপের মানুষ। হুড়োহুড়ির কথা বেমালুম চেপে গিয়ে ডাক্তারকে পরদিন হম্বিতম্বি – আপনি নির্ঘাত বাজার থেকে কাচের প্লেট কিনে আমার পায়ে বসিয়েছিলেন। বিরক্ত ডাক্তার বলেছিল – হ্যাঁ, এবার তোমার মাথার ক্র্যাকটায় প্লেটের সঙ্গে পাওয়া কাপটা বসিয়ে দেবো।
আমার এক ভ্রাতৃপ্রতিম আলোকচিত্রী পুজোর ঠিক আগে কোমরের হাড় ভেঙেছিলেন। ফোটো তুলতে গিয়েই। পুজো বরবাদ। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও কাশফুলের ছবি তোলা হয়নি সেবছর। তাদের ছবি খবরেরকাগজে ছাপা হয়নি বলে কাশফুলগুলোর নাকি খুব মন খারাপ ছিল সেবার।
পুজোর সর্বজনীন গন্ধটাও পাওয়া অর্থোপেডিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে। সদ্য ডাক্তারি পাস করেছি। আর জি কর হাসপাতালের হাড়ের ওয়ার্ড তখন ছিল পুরনো এক বিল্ডিংয়ে। ইন্টার্নশিপে সব ডিপার্টমেন্টে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করতে হয়। রাত ভোরের দিকে ঢলছে। সেই ভোররাতে কলবুক পেয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনলাম রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলা। তারপরই সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে “বাজলো তোমার আলোর বেণু”। মহালয়া এসে গেল? দ্রুত ওয়ার্ডে ঢুকে রেডিওটার খোঁজ করি। একজন মুসলিম ভদ্রলোক রেডিও শুনছেন। আরও বেশ কিছু রোগী তাঁর বেডে বসে আছে। প্রথমবার বুঝলাম কিছু জিনিস ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে শুধু বাঙালির।
পুড়ে যাওয়া রোগীরা কখন যে খারাপ দিকে বাঁক নেবে বলা খুব মুশকিল। মধ্য চল্লিশের এক মহিলা ষাট শতাংশের মতো পুড়ে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন রাউন্ডে জিজ্ঞেস করতেন পূজার সময় বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা। তাঁদের গ্রামে সবাই মিলে বড়ো একটা দুর্গা পুজো করে। পুজোর যোগাড়যন্ত্রের দায়িত্ব বেশ কিছুটা তাঁকে সামলাতে হয়। তিনি না থাকলে পুরুতঠাকুর খুব অসন্তুষ্ট হবে। ডাক্তারি হিসাবও বলতো যে পুজোর ঠিক আগেই ছেড়ে দেওয়া যাবে সেই রোগীকে। দিব্যি সেরে উঠতে উঠতে হঠাৎ করে সেপটাসিমিয়া। সারা দেহে ছড়িয়ে যায় ইনফেকশন। ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলায় ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হলো। সেদিন মন্ডপে মন্ডপে বোধন হচ্ছে। মেয়ে যে বাড়ি ফিরছে।
পুজোর ঠিক আগে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দও দেখা যায়। পারুলের তো বাড়ি ফেরার কথা ছিলনা। নাড়ি ছিঁড়ে গেছে, পেটে তিন লিটারের মতো পুঁজে ভর্তি। অপারেশন টেবিলে যখন তোলা হয় তখন শেষ অবস্থা। ওর স্বামী রোগা পাতলা একটা বাচ্চা ছেলে। হাই রিস্ক কন্সেন্ট দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ কিনে দেওয়া -যখনই ডেকেছি তখনই হাজির। একদিন কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি -“তুমি কি বাড়ি যাওনা বাপু?” মৃদু হাসে। জানতে পারি যে সে ছোটো একটা চাকরি করতো। দীর্ঘ একমাস সে হাসপাতালেই পড়ে আছে। কাজে না যাওয়ায় তার চাকরিটি গেছে। পারুল এসব কিছুই জানতোনা। তার একটাই দুশ্চিন্তা- পুজোর সময় শাড়ি পরবে কিকরে, পেট দিয়ে যে পায়খানার রাস্তা করা! ভিজিটিং আওয়ারে স্বামীকে সেকথা বলেছিল বোধহয়। ছুটির দিন হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে হাজির ছেলেটি। বাড়ির লোকজনের চোখ এড়িয়ে সিসিইউতে ঢুকে পারুলের হাতে তুলে দেয় পুজোর গিফট। শালোয়ার কামিজ পরলে জায়গাটা ঢাকা থাকবে। ঝলমল করে ওঠে পারুলের মুখ। স্বামীস্ত্রীর গোপন ভালবাসার স্বাক্ষী থেকে যায় এই কাবাব মে হাড্ডি ডাক্তার।
গত পুজোয় একদম অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হলো। চতুর্থী বা পঞ্চমী। একজন বয়স্কা মহিলা বেশ রাত করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তেমন কিছু হয়নি বলে নার্সদিদিরাও আর ডাক্তারকে ডেকে পাঠাননি। সকালে গিয়ে তাঁর সেরকম রোগও খুঁজে পাওয়া গেলনা। একটা কাটা দাগ আছে বটে, তবে সেটা বেশ পুরনো এবং প্রায় সেরে এসেছে। তিনিও কেন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জানেননা। বাড়ির লোক উপস্থিত নেই। সুতরাং ছুটি দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এদিকে অন্য সমস্যা। বাড়ির লোকেরা যে দুটি ফোন নাম্বার হাসপাতালকে দিয়েছে তার একটি সুইচড অফ এবং অন্যটির কোনো অস্তিত্ব নেই। ভদ্রমহিলাকে দেখলে বোঝা যায় যে বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ। যেটুকু কথা বলছেন তাতে শিক্ষা এবং রুচির ছাপ স্পষ্ট। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী পুলিশকে জানিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কাগজপত্র যখন তৈরি করা হচ্ছে তখন ধীর পায়ে ভদ্রমহিলা নার্সিংস্টেশনে হাজির। প্রথমেই অনুরোধ করলেন যে পুলিশকে যেন কিছু জানানো না হয়। তাঁকে ছেলে ও বৌমা না বললেও কিছু কথা তাঁর কানে এসেছে। ওরা সপরিবারে ( স্বামী স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান, জায়গা বড়ই কম) বাইরে বেড়াতে গেছে। মাকে নিয়ে যাওয়া মানে আনন্দটাই মাটি। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে রাখলে নানা কথা উঠবে। বৃদ্ধাশ্রমে রাখলে আবার অফিস কলিগেরা পেছনে নচিকেতার গান শোনাবে। সুতরাং হাসপাতালে কদিন গ্যারেজ করে রাখা যাক। ফুডিং লজিং ফ্রি। ফিরে এসে সময়মতো ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেই হবে। কে বলে বাঙালির বুদ্ধি কমে যাচ্ছে?
ভদ্রমহিলা চুপ করে জড়োসড়ো হয়ে বেডে বসে থাকতেন। ডাক্তার রাউন্ডে গেলে বড়ো লজ্জিত হয়ে পড়তেন। বরং হাসপাতালের লোকজন তাঁর অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করতো।
দশমীর দিন এক ট্রেনি সিস্টার প্রণাম করে বলে “পরেরবার ঠিক সময় ঘর থেকে চলে এসো মাসিমা।”
চোখ ছলছল করে ওঠে বৃদ্ধার। “আমার তো ঘর নেই।”
নীলকন্ঠ পাখি উড়ে যায়। অনেকদূরে একটা নিজস্ব ঘর আছে মানুষটার। সেখানে যেদিন পাখিটি পৌছবে সেদিন তাঁর ঘরে ফেরার ডাক আসবে।
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার মধ্যে উড়তে থাকা পাখিটার দিকে বোধহয় তাকিয়ে থাকতেন তিনি।