আমাদের সুন্দর পৃথিবীর সমস্ত মানুষ প্রায় এক বছর অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয় জীবন যাপন করছেন। সব উৎসব, আনন্দ, জমায়েত এই বছরের জন্য সলিল সমাধি দিতে হয়েছে। কোরোনার বিরুদ্ধে আমরা জয়ী হলে আবার সব আনন্দ ফিরে আসবে।
এই অতিমারীর সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুব প্রচলিত শব্দসমূহের সাথে পরিচিত হলেন কিন্তু সাধারণ লোকজন হয়তো এই প্রথম বার শব্দগুলোর সম্বন্ধে জানতে পারলেন। আইসোলেশন সম্বন্ধে হয়তো আমরা এই কোরোনাকালে জানতে পারলাম। ১৪ দিন আইসোলেশন এর পরে টেস্টিং রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তবেই ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
কখনো শুনেছেন ২৬ বছরের দীর্ঘ আইসোলেশন এর ঘটনা?
আজকে ইতিহাসের পাতা থেকে এক ২৬ বছরের আমৃত্যু আইসোলেশনের ঘটনা তুলে ধরছি।
আয়ারল্যান্ডের একটা ছোট্ট গ্রাম কুকসটোনে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন মেরি মালন। কুকসটোনের প্রায় প্রতিটি পরিবার চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জীবন যাপণ করতো. মেরির পরিবারও ব্যতিক্রম ছিলো না. চরম অর্থসঙ্কটের সম্মুখীন হইয়ে কিশোরী মেরি ১৮৮৩ সালে নিজের এক মাসির সঙ্গে কাজের সন্ধানে সুদূর নিউ ইয়র্ক শহরে পাড়ি দিলো।
পরিচারিকার কাজ কিছু দিন করার পর মেরি রাঁধুনির কাজ পেলো. মেরির তৈরী পীচ আইস ক্রিম সকলের মন জয় করতো. অচিরেই মেরি অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের রাঁধুনি হ্যে উঠলো. কিন্তু কিছু দিন পরেই দেখা গেলো পরিবারের সব সদস্যরা তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা এবং ডায়ারিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্মুখীন। আক্রান্তদের নমুনা টেস্টিং করে দেখা গেলো তারা সবাই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে। মেরি তখন অন্য বাড়িতে কাজ খুঁজে নিলো।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দুর্ভাগ্য এখানেও মেরির সঙ্গে পৌঁছে যেত. নতুন মনিবের পরিবারের সদস্যরাও একই ভাবে আক্রান্ত হলো. মেরি আবারো অন্য বাড়িতে কাজ খুঁজলো। কিন্তু নিজের নাম পাল্টে কাজ করতে লাগলো. প্রতিবারে নিজের নাম পাল্টে মেরি বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারের রাঁধুনির কাজ করতো. মারির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলেও মারির শরীরে অসুস্থতার কোনো লক্ষণ ছিলো না।
১৯০৬ সালে অত্যন্ত স্বনামধন্য বিত্তশালী চার্লস ওয়ারেন নিজের পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে ওয়েস্টার বে আইল্যান্ড গেলেন. ওখানে থিওডোর রুজভেল্টের বিলাসবহুল বাংলো ভাড়া নিলেন এবং ৬ সদস্যের পরিবারটি আনন্দে ছুটি কাটাতে লাগলো। পরিবারের রান্না দায়িত্ব পেলো মেরি. পীচ আইস ক্রিম এখানেও খুব প্রশংসা পেলো. কিন্তু কিছু দিন পরেই পরিবারের সকল সদস্য টাইফয়েডে আক্রান্ত হলো।
তখনকার সময় এটা জানা ছিল যে টাইফয়েড রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া স্যালমনেলা টাইফি নোংরা পরিবেশে ঘিঞ্জি এলাকায় জন্মায়. কিন্তু সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিলাসবহুল বাড়িতে কি করে এই জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে বোঝা গেলো না।
ইতিমধ্যে টাইফয়েড এ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে. মেরি অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে চলে গেছে. থিওডোর রুজভেল্ট নিজের বাড়িতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা মানতে পারলেন না. উনি এক জন স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত করলেন প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের জন্য. এই কাজের দায়িত্ব পেলেন বিখ্যাত স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার জর্জ সোপর।
বাড়িটি নিরীক্ষণ করে জর্জ কোনো কিচ্ছু অস্বাভাবিক দেখতে পেলেন না। টাইফয়েড জীবাণুর জন্মানো এবং বেড়ে ওঠার কোনো অনুকূল পরিবেশ বাড়িটিতে পাওয়া গেলো না। জর্জ তখন সেই সময়কার টাইফয়েড আক্রান্ত অন্য বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে তথ্য সংগ্রহ করলেন। কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পেলেন না। .কিন্তু একটা বিষয় জর্জের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো যে সব জায়গায়ই বাড়ির সদস্যরা আক্রান্ত হলেও বাড়ির রাঁধুনিরা আক্রান্ত হয়নি. তখন জর্জ সেই সব বাড়িতে কাজ করা রাঁধুনিদের খোঁজ করলেন।
বলাবাহুল্য যে জর্জ রাঁধুনিদের খুঁজে পেলেন না. কারণ আলাদা আলাদা নাম নিয়ে মেরি সেই সকল বাড়িতে কাজ করতো. কিন্তু বুদ্ধিমান জর্জকে মেরি বেশিদিন ফাঁকি দিতে পারেনি। জর্জ তখন মেরিকে নমুনা টেস্টিং করানোর জন্য অনুরোধ করেন. কিন্তু অশিক্ষিত মেরি কারণ বুঝতে না পেরে জর্জকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করলো। পুলিশ মেরিকে বন্দি করে হাসপাতাল নিয়ে গেলো নমুনা টেস্টিং করাতে।
টেস্টিং রিপোর্টে জানা গেলো মেরি হচ্ছে টাইফয়েড জীবাণুর এসিম্পটোমেটিক বাহক. এই ধরণের বাহক রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু নিজের শরীরে বহন করে কিন্তু নিজেরা আক্রান্ত হয় না।
টাইফয়েডের এসিম্পটোমেটিক বাহক মেরির আগে কখনো কেউ জানা যায়নি. মেরিকে ১৯০৬ সালে আইসোলেশনে পাঠানো হলো। হাসপাতাল থেকে মেরিকে বলা হলো তার গলব্লাডারের মধ্যে জীবাণুগুলো পাওয়া গেছে. গলব্লাডারে ব্যাকটেরিয়া অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে। সেই জন্য মেরিকে অনুরোধ করা হলো অপারেশন করে তার গলব্লাডার বাদ দিতে। মেরি রাজি হলো না উপরোন্ত কোর্টে মামলা করলো।
মেরির উকিল কোর্টে প্রমাণ করলেন যে সে যে জীবাণুর বাহক সেই সম্বন্ধে মেরির কিছু জানা ছিলো না এবং রান্না করা খাবারের উচ্চ তাপমাত্রায় জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। কোর্ট যুক্তি মেনে নিলো এবং ধারণা করা হলো যে মেরির তৈরী পীচ আইস ক্রিম হয়তো রোগের কারণ।
১৯১০ সালে মেরি শর্তসাপেক্ষ জামিন পেলো এবং মুচলেকা দিয়ে জানালো যে সে আর রাঁধুনির কাজ করবে না। ছাড়া পাওয়ার কিছু দিন পর মেরি আবার নাম পাল্টে লুকিয়ে একটা হোটেলে রাঁধুনির কাজ আরম্ভ করলো। আবার এলাকায় টাইফয়েড দেখা দিলো। স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতি এবার সবার সামনে এলো। স্বাস্থ্য বিভাগ মেরির ওপর কোনো নজরদারি করেনি যার ফলস্বরূপ আবার সেখানে টাইফয়েড দেখা দিলো।
এবার আর মেরিকে ছাড়া হলো না. মেরিকে আইসোলেশনে পাঠানো হলো। দীর্ঘ ২৬ বছর আইসোলেশনে কাটিয়ে ১১ নভেম্বর ১৯৩৮ সালে মেরি মারা গেলো। আমৃত্যু আইসোলেশনের বিরল ঘটনা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলো।