অক্টোবরের বিকেল। পার্কে হাঁটতে গিয়ে বিজয়বাবুর মনে হল পার্কের বেঞ্চিতে বনমালীবাবু বসে আছেন। তার নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল।
ওনার কাছে এসে সে বলল, বনমালীবাবু আমি আপনার লেখার ভক্ত। কতদিন অপেক্ষা করে আছি আপনার সাথে কথা বলব বলে।
বনমালীবাবুর মুখের অভিব্যক্তি বিশেষ কিছু বদলালো না। তবে মনে হল তিনি হয়ত কিছুটা বিরক্তই হয়েছেন।
আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আপনাকে বিরক্ত করব না। এই মিনিট পাঁচেক।
তাঁকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে তারপাশে বসে পড়ল। উনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্যক্তিত্বহীনতা এবং ভদ্রতার কারণে তাকে কিছু বললেন না। তবে তাঁর মুখ দেখে মনে হল তিনি কিছুটা অবাকই হয়েছেন। এই বাংলাদেশের একটি-দুটি লোকেরাও যে তাঁকে লেখক হিসেবে চেনে এতে তিনি হতবাক হয়েছেন বললেও কম বলা হয়।
– আপনার ভাবাবেগে আচ্ছন্ন কবিতা আমাদের দিশেহারা করে রেখেছে। আপনার সেই সিংহল, বেবিলন, মিশরের ধূসরতা বাঙালিদের এমন বিবশ করে রেখেছে যে এত বছরেও আমরা সেই হেমন্তের কুয়াশা পার করতে পারলাম না।
– এটা কি আমার সফলতা না বাঙালিদের ব্যর্থতা?
– লোকে বলে আজ অবধি বাংলাদেশে দুজন মাত্র কবি জন্মেছেন।
– আর সমালোচকেরা কী বলেন?
– বলেন আপনার কবিতার শরীরে ইংরিজি কবিতার সুগন্ধ। আপনি ইউরোপীয় রোমান্স বাংলায় চুরি করে এনেছেন।
– চুরি কথাটা কি খুব গোলমেলে নয়?
– তারা আপনার সময়ের অন্য সকলের সম্পর্কেও একই কথা বলেন।
– অথচ তাঁরা চলে গেলেন আর আমি রইলাম। তাই কি? আপনার কথা শুনে তো তাই মনে হয়।
– আপনার কবিতার ভাবুকতা বাঙালিকে বশ করেছে অন্যদের জাঢ্য তাদের পছন্দ হয় নি।
– বুঝলাম। আমার কবিতার অসাড়তা কর্মবিমুখ বাঙালিদের যাপনের অংশ হয়ে উঠতে পেরেছে। পেটের অসুখে ভোগা কেরানি বাঙালির কোর্মা-কোপ্তায় অরুচি। তাই তো?
– না তা নয়। তবে বাঙালিরা আপনার পর অন্য কাউকে নিয়ে বা তার কবিতা নিয়ে ভাবাই বন্ধ করে দিয়েছে।
– আপনি কি লেখেন টেখেন? আপনি কি কবি?
– না মানে-
– না মানে একজন কবিই সম্ভবত অন্য এক কবিকে এমন রুচিসম্মতভাবে এমন স্নিগ্ধভাবে সুচারুভাবে জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ করতে পারে। বিশেষত তিনি যদি বাঙালি হন।
– আপনি এবার কিন্তু রেগে যাচ্ছেন।
– রাগ-অনুরাগের কাছাকাছিই আমি নেই। আমি অবাক হচ্ছি। আপনার সমকালীন কেউ আমাকে এতখানি ঈর্ষা করতে পারে এটা ভেবে আমি পুলকিত।
– আপনার উপন্যাস নিয়ে আমার বিস্তর অভিযোগ আছে।
– উপন্যাস? বলেন কি!
– আপনার মত এতখানি ব্যক্তিগত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর কেউ লেখেন নি বলেই আমার বিশ্বাস।
– সাহিত্য মাত্রই ব্যক্তিগত। এতে সংশয়ের কোনো জায়গাই নেই। যিনি নিজেকে গোপন করেন তাঁর সংযোগের ইচ্ছে নেই। তিনি আর যাই হোন সাহিত্যিক নন।
– তা বলে এত পাপ, এত মনস্তাপ কেন আপনার লেখায়? আপনার পুরুষ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে। সে যখন দারিদ্রে বেড়ার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে প্রসব করছে ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তখন স্ত্রীর পাশে না থেকে কলকাতার মেসে অকাজে লুকিয়ে থেকে শান্তি পায়। সে কী নায়ক? সে কী পুরুষ? সে মানুষ?
– সে একজন বিপন্ন মানুষ। সে তার প্রচুর সম্ভাবনা নিয়েও এই পৃথিবীর কাছে কিছু পায় নি। পৃথিবীকেও তার কিছু দেবার নেই।
– তা বলে এমন অসহ্য পুরুষকার, স্ত্রীর প্রতি এমন বঞ্চনা, অপ্রেমের প্রতি এমন প্রেম আপনিই বাংলা ভাষায় এনেছেন। আপনারা চরিত্ররা অনুকরণীয় নয়।
– আপনি কখনও দেখেছেন বর্ষার জল যখন খালবিল ডুবিয়ে মাটির বাড়ির উঠোন পর্যন্ত প্রায় চলে আসে, পচা পাটের গন্ধ অগণিত মশাদেরও বিভ্রান্ত করে দ্যায়- সেই রাতে মেঘ কেটে যদি কাস্তে চাঁদ আকাশে ওঠে- সেই নেশা, সেই জীবনের প্রতি অবর্ণনীয় ঘৃণা একটি মুহূর্তের জন্য নিজেকে কেমন অনির্বচনীয় করে তোলে, আপনি দেখেছেন?
– এই দারিদ্র আর পলায়নপ্রিয়তা, আপনার হতাশ জীবনের ডায়েরি আপনার উপন্যাসগুলো। যে স্বামী স্ত্রীর প্রতিনিয়ত মৃত্যু কামনা করে, যে স্বামী তার অন্য শালি বা অন্য আত্মীয়ার প্রতি অনুরক্ত- তিনি যতই তার মেধার দোহাই দিন, তীক্ষ্ণ অনুভূতির দোহাই দিন না কেন- এ পৃথিবী তাকে একেবারেই চায় না।
– এক অনুরক্ত মন, এক রূপমুগ্ধ চেতনা যে সারাজীবন শুধু একটা চাকরি আর একটা লেখার টেবিল চেয়েছিল আপনারা চিকেন কাটলেট আর হুইস্কির বোতল নিয়ে সাহিত্যসভায় বা ক্লাব হাউসে তাকে বোঝার চেষ্টা করেন। তাকে অপমানিত করেন। তাকে অপরাধী করেন। অশ্লীলতার দায়ে তার চাকরি কেড়ে নেন? অনৈতিকতার দায়ে তার ঘাড়ে বিকারগ্রস্ত পাপী দুরাচারী পুরুষের লজ্জা এঁকে দ্যান?
– আমি ক্ষমা চাইছি। বুঝতে পারছি আমি আপনাকে অপমান করে ফেলেছি।
– সে যাই হোক। এখন বলুন তো আপনি আমার কবিতা নয় কিছু পেলেন কিন্তু উপন্যাস? সে তো আমি ট্রাঙ্কবন্দী করে রেখেছি। আমার স্ত্রীও পর্যন্ত সে খবর রাখেন না। রাখার চেষ্টাও করেন না। আপনি কিভাবে তার সন্ধান পেলেন?
– একটিই শেষ প্রশ্ন আছে আমার। যদি মার্জনা করেন। লবঙ্গলতা কি আপনার প্রেমিকা? আপনার কবিতায় উপন্যাসে সবখানে তার কথা আছে।
কবি চোখ দুটো করুণ করে তাকালেন। এতক্ষণ আবেগের তাড়নায় তারা বেশ ক্লান্ত। তার চোখে একই সাথে ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং বিস্ময়। তিনি চোখ ফিরিয়ে পাশের লাইনের দিকে তাকালেন। লাইনগুলো কিছু দূরে এমনভাবে বেঁকে গেছে মনে হচ্ছে তারা যেন এক হয়ে মিলে গেছে।
মিশে গেছে কোন অনন্তের কুয়াশায়।