সত্যি বলতে বড্ড অনিচ্ছুক, অপেশাদার ডাক্তারি জীবন আমার। বড্ড নিরামিষ এবং বিবর্ণ হয়ে ওঠা তাই যেন সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র। অবশ্য খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এসবেই- বহুকাল হলো। অনভ্যস্ত হবার সাহস হারিয়ে ফেলেছি বহুকাল হলো। কোথাও যাবার নেই জেনে এই পেশাতেই পড়ে আছি।
একটা কথা খুব মনে হয় এখন- বেঁচে আছি কেন?
মৃত্যুর চেয়ে কোন বিকল্প পথ নেই- এই ভেবে?
হয়তো বা।
কোথাও রং এর বাহার দেখলেই ভয় লাগে আজকাল, হোক সে ফুলের কিংবা দলের! ছোপ ছোপ দাগ না থাকলেই সন্দেহ হয়- এই রং মোটেই বেশিদিনের নয়!
যে গল্প বলার জন্য অধিকার নেই আমার বা আমাদের, সেই গল্পগুলো যখন ঘাড়ের উপর এসে পড়ে, তাকে পড়তেই হয় খানিকটা হলেও। মানুষের ই তো গল্প সে সব। গল্প বলার মতো করে তাই
বলে যাই- শোনা, দেখা সত্যিকারের সেই সব ঘটনা গুলো।
জানি, এগুলো সব সময় ঠিক নয়, কারো কারো বড্ড ব্যক্তিগত জীবনের কথা উঠে আসে। ছুঁয়ে যায়। চোখে জল আনে। ভিজিয়ে দেয় ভেতরে ভেতরে। আমরা ভিজতে থাকি। আবার কাঠফাটা পরিবেশের রোদে শুকাতে থাকি ধীরে ধীরে।
কিন্ত নিংড়ে ফেলতে পারি না প্রায়ই। কেন?
আমার কেন জানি না- বারবার মনে হয়, খানিকটা নিংড়ে ফেলা জরুরি। আর একটু তাড়াতাড়ি শুকাতে হবে আমাকে, আমাদের। আর একটু তাড়াতাড়ি শুকিয়ে ফেলতে হবে জল, রক্ত।
সেই যে কবে শিখেছি- জল জমলেই জমবে জীবাণু আর মশা। রক্ত জমলে তো আরো ভয়ঙ্কর- বেশিরভাগ জীবাণুর খাদ্য হয়ে ওঠে সেই রক্ত! যেন কালচার মিডিয়া!
মাঝে মাঝে চেষ্টা করি, ভাবি নিজের মতন করে নিংড়ে ফেলবো এসব। তাই যা ইচ্ছে খুশি লিখে ফেলি। না হলে সত্যিই পারা যায় না। মারাত্মক একটা জমাট স্যাঁতসেঁতে ভাব নিয়ে আমার খুব সমস্যা হয় পরের দিন ডাক্তারি করতে বা পরের রোগী দেখতে।
মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আলোচনা করি। রাতে ঘুমের মধ্যে শিউরে উঠি। ঘরের মানুষ বলে- বড্ড ভুলভাল বকছি। প্রায়ই রোগীকে এটা ওটা বলছি। রেগে যাচ্ছি। জানি না, এটা সত্যিই ডাক্তারির মতো খোট্টার পেশায় খাপ খায় কিনা!
আমার মনে হয়- কোন একটা মানসিক সমস্যা আমাকে গ্রাস করছে ক্রমশঃ। ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছি কি রোজ?
বলে ফেলা ভালো, এতো মানুষের দুঃখ নিতে পারছি না আমি আর। কেন কেউ আসে না একটা সুখের খবর দিতে? কেন কেউ এসে বলে না- ডাক্তার বাবু, আমি আপনার কাছে রোগের কথা বলতে আসিনি! এসেছি একটু খানি সুখের গল্প করতে! কেন আসবে না? কেন??
আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব থেকে অপরিচিত- কেউ যখনই ফোন করে, নিরামিষ গলার স্বরে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছি, আমার ভেতরে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। এবং সন্দেহকে সত্যি করে পরক্ষণেই চলে আসে কারো না কারো শারীরিক সমস্যার কথা!
কি যে যন্ত্রণা এসব! এই এক ধারা চলছে ডাক্তারি পড়া শুরু করার পর থেকেই!!
আমি কি সত্যিই তবে ডাক্তার হয়ে উঠতে পারিনি?
জানি না, একটা জীবন কালে ডাক্তার হয়ে উঠতে পারবো কিনা।
যাইহোক, আজ একটু নিংড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো ।
ঘটনাটি ঘটেছে ছয় মাস আগে। একটা বছর চৌদ্দর মেয়ে। নাম লিখবো? থাক। তারচেয়ে একটা নাম দিই তার- তন্বী। আর কিছু বলবো না তার পরিচয়।
সে এসেছিল তার মা এর সাথে। সমস্যা খুব কমন। মেনস্ট্রুয়েশনের সময় খুব ব্যথা। প্রায় সবারই হয় এটা। কারো কারো খুব বেশি। অসহ্য ব্যথা নিয়ে এসেছিল পরীক্ষা করাতে। দেখে বলেছিলাম- একটা টিউমার আছে ডান দিকের ওভারিতে। ডার্ময়েড বলি আমরা। খুব কমনই বলা যায়। অনেক রোগী পেয়েছি এমন।
মা এবং মেয়ে টিউমার শুনে পুরো চুপসে গিয়েছিল। বললাম- অত ঘাবড়ে যাওয়ার দরকার নেই। অতটা খারাপ টিউমার নয়। গাইনি ডাক্তারের কাছে যাও। অপারেশন করে নিলে ভালো হয়েও যেতে পারো।
তার তিন মাস এসেছিল ফের পরীক্ষা করাতে। এবং অদ্ভুতভাবে মেয়েটির ব্যথা হচ্ছিল না আর! শেষ দু’মাস একদম ভালো ছিল। তাই খবর দিতে এসেছিল। যদিও থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু বলার মত নয়, কিন্ত চোখের ভাষায় সেদিন দেখেছিলাম- মা এবং মেয়ে দু’জনেই খুব খুশি হয়েছে।
জানি না সেটা আমাকে বলার দরকার ছিল কিনা।
কিন্ত যেই না বলে গেল, মনটা খুশিতে ভরে উঠল।
সে দিন সারাদিন খুশি মনে ডাক্তারি করেছি। মনে মনে বলেছি- ওদের ভালো হোক।
কাকে বললাম, জানি না।
এই এক দোষ হয়েছে আমার। এটা বেশিদিনের নয়। এমনিতে ধর্ম ভগবান এসবে মারাত্মক অ্যালার্জি আমার। প্রায়ই কঠিন কঠিন সমস্যা নিয়ে আসে রোগীরা। আর আমি বিড়বিড় করি- এর রোগটা যেন বুঝতে পারি! আমাকে যে পয়সা দেবে!! ফের ভাবি- এটা কি রকমের চাহিদা?
সুস্থ আছে, রিপোর্ট নর্মাল আছে- এটাই তো স্বাভাবিক চাওয়া হতে হবে! তা না করে …
নিজেকেই গালি দিই।
তারপর রোগী দেখি। যদ্দুর বুঝি, বলে দিই।
নর্মাল খুব কমই হয়। আর যাঁদের সমস্যা পাই, তাদের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করি- ভালো হোক। ভালো হোক।
কিন্ত কার কাছে এই প্রার্থনা? আমি হেসে ফেলি ।
বিরক্ত হই। উত্তর পাই না।
আমার ফাটা কপাল। এমনিতেই বেশিক্ষণ সুখ টেকে না। এই খানিক রোদ, এই অঝোর বৃষ্টি।
এই গতকালই মেয়েটি এসেছিল ফের। তৃতীয় বার! একজন রোগী একজন ডাক্তারের কাছে তৃতীয় বার এসেছে যখন, তখন বোঝা যায়, কিছু তো বলার আছে! বিশ্বাস তৈরি হয়েছে খানিকটা হয়তো।
নতুন বা পুরানো সমস্যার কথা বলার মত মনে হয়েছে ডাক্তারকে। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।
এবং মেয়েটি ফের মাকে নিয়ে এসেছে। যেমনটা খুব কমন আমাদের দেশে। আমি অন্য রোগী দেখছিলাম। পেছনে একটা মেয়ে কাঁদছে দেখে চোখ ফেরালাম। বললাম- কি হলো?
যেহেতু এখন মাস্ক পড়া সবাই, আমি মেয়েটিকে চিনতে পারিনি প্রথমে। তাড়াতাড়ি টেবিলের রোগীকে দেখে নিয়ে বললাম- একে তোলো।
মেয়েটি বিছানায় শুয়ে প্রথমেই বললো- ডাক্তার বাবু, আমি তন্বী।
এতোক্ষণে আমার সেই খুশি হওয়া দিনের কথা মনে পড়ে গেল। বললাম – হা। বলো। আবার কি সমস্যা?
মেয়ে চুপ। মেয়ের মা পেছন থেকে বললো- ব্যাথা ডাক্তার বাবু।
আমি তন্বীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম – কোথায় কেমন ব্যাথা এখন ?
মেয়ে চুপ। দেখলাম, আড়চোখে মা এর দিকে তাকিয়ে। মাও আর কিছু বলছে না।
এমন সময় আমরা সাধারণত মা এর কাছে থেকে সব ডিটেইলস পাই। কিন্ত এবারে মা যে চুপ।
বললাম- সমস্যা কি?
আমার কেন জানি না সন্দেহ হলো- মেয়ে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে।
মাকে বললাম- আপনি বাইরে যান।
সহকারী মেয়েটিকে বললাম- তুমি জিজ্ঞেস করো তো কি সমস্যা ওর!
মাকে বাইরে যেতে দেখে তন্বী নিজেই মুখ খোলে।
– আমার কিচ্ছু হয়নি ডাক্তার বাবু!
আমার চমকের শুরু। ধমকের সুরে বললাম- মানে?? তাহলে আমার কাছে এসেছো কেন?
তন্বী ভড়কে গেল খানিকটা। কি জানি কি আশা করে এসেছে আমার কাছে!
তন্বীর মা যে বললো- আমাকেই দেখাতে হবে বলে আগে থেকে জেনে এসেছে আমি এসেছি কিনা!
তন্বী কাঁদছে। চোখের জল এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে দেখে বুঝলাম- এ জল আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিল বেরোনোর জন্য!
বললাম- কি হলো সেটা বলো? তুমি তো মনে হয় পড়াশোনাও করো। তো বলে ফেল কি সমস্যা?
তন্বী খানিকটা আশ্বস্ত হলো। চোখ মুছে বললো- আমার বিয়ে।
আমার যা বোঝার বুঝে নিলাম। এ দেশে এখনো এসব জলভাত! কিন্ত এ মেয়ে যে …
বললাম- তাতে আমি কি করবো?
বলেই নিজেকে একটা আস্ত বোকা মনে হলো। বছর চৌদ্দর একটা মেয়ের বিয়ে, অথচ আমার বা আমাদের কিছু করার নেই, এই লজ্জাটুকুও কি পেতে পারতাম না??? তাতে কি লাগতো?
খানিকটা ভারী হলো মন। বুঝলাম, আমার ভেতরটা ভিজতে শুরু করেছে। আর থামবে না এবার। ছদ্ম কাঠিন্য ভেঙ্গে চুরমার।
তন্বী একটু সময় নিয়ে বললো- ডাক্তার বাবু, আপনি বলেন আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?
বাপ মা এ জোর করে বিয়ে দেবে। আমি তো পড়তে চাই । বিয়ের পর কি আর পড়া যায়?
ডাক্তার হলে কেন জানি না, অসহায় হওয়া, ক্রমাগত অসহ্য অসহায় অবস্থা মানিয়ে নেয়ার জন্য ট্রেনিং হয়ে যায় আপনা থেকেই!!
তবু …
বললাম- বাবা মাকে বলো যে পড়াশোনা করবে!
যত সহজে বলে ফেললাম, তত সহজে বলে ফেলে যে মেয়েটি ছাড় পাবে না, সে আমি বেশ জানি। নানা রকম অশিক্ষা কুশিক্ষা কুসংস্কার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পড়ে এইসব তন্বীরা।
না, একটাও তাদের সপক্ষে যায় না! বড় বড় জ্ঞানবাণী বিতরণ করা মানুষেরাও বুঝতে পারেন না যে, এই একজন তন্বীকে বাঁচানো মানে হাজার হাজার তন্বীকে বাঁচিয়ে রাখা! প্রকল্পের গালগল্প দিয়ে যে কাজের কাজ হয় না, সেটা কেউ বলবে না!
তন্বী আশাহত। তবু বললো- সে আর হবে না। সব ঠিক হয়ে গেছে।
এবার আমার ভেতরটা ভিজে চপচপ করছে। আর কি বলবো? ইচ্ছে তো করছে চিৎকার করে বলে ফেলি- তন্বী, তুই চল, তোকে আমি নিয়ে রেখে আসি অন্য কোথাও। অন্য কোন একটা দেশে। অন্য কোন সমাজে!
বললাম- ওঠো। আমার সত্যিই কিছু করার নেই।
তন্বী চৌদ্দ বছরের মেয়ে। কতটা কি বোঝে জানি না। কিন্ত এই বয়সে বিয়েটা যে ঠিক নয়, এটা বোঝে। আর হতাশ হয়, আমাদের মত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কাছে, কোন তন্বীর জন্য কোন সাহায্যকারী হাত নেই!
হাত অবশ হয়ে আসে। মগজে বীভৎস সব দৃশ্য ভেসে ওঠে। তন্বী- চতুর্দশী তন্বী … চলেছে বউ হয়ে … বড় বড় উৎসব … পেট পূজা … সামাজিকতা … তারপর একদিন হেঁসেলের অন্ধকার কালি ঝুল মেখে অসময়ে মা হয়ে যাবে!
তন্বী অসময়ে অকারণে রক্তাল্পতার শিকার হবে। বেঁচে থাকবে বৃদ্ধা হয়ে। মরে যাবে যৌবনেই হয়তো! হয়তো রেখে যাবে আরো এক বা একাধিক তন্বীকে! এই সমাজ নামক শেয়ালের কাছে মোরগ বর্গা দেয়ার মত!!
তন্বী নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি সহকারীকে বললাম- নর্মাল রিপোর্ট করে দাও। ও হ্যাঁ , ওর ডানদিকের ওভারিটা নেই। অপারেশন হয়েছে। লিখে দাও।
তন্বী হঠাৎ করে খানিকটা অনুরোধের সুরে বলে- ডাক্তার বাবু, আমার বাম দিকে একটা টিউমার লিখে দিতে পারেন না?
আমি বুঝলাম, বড্ড বাচ্চা বাচ্চা চাহিদা এসব।
যেটা অসম্ভব।
কিন্ত মনে হলো- তন্বী এই চিন্তা করেই এসেছে। ডাক্তারকে বলে একটা সমস্যা যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো বিয়েটা ….
ততক্ষণে আমি আর নিতে পারছিলাম না। রুমের আবছা আলোয় তাকালাম তন্বীর দিকে। কাঁদছে?
সে কি করবে আর? তার চৌদ্দ বছরের জীবনে এমন সমস্যার সমাধান কি করে খুঁজে পাবে সে??
কে দেবে তাকে??
আমি? ডাক্তার হয়ে এতোবড় মিথ্যা কথা আমি কি করে লিখবো? সম্ভব নয় কোনভাবেই!রেডিওলজিতে এমনিতেই সবকিছু ডকুমেন্ট করতে হয়। তার উপর টিউমার বললে তো তার ডিটেইলস লিখতে হবে। ছবি দিতে হবে। মুখে বলে দিলে তো হবে না!
আমার কাছে সেটা জীবন মরণ সমস্যা। সারাজীবনের মত লাইসেন্স বাতিল হতে পারে!
অতএব এই অসম্ভব চিন্তা করতেই পারলাম না!
অথচ আমার খুব মনে হচ্ছিল- এমন একটা মিছামিছি টিউমার যদি থাকতো, যেটাতে তন্বীর কোন সমস্যা হবে না, অথচ ভয় পেয়ে কেউ তাকে বিয়ে করবে না !! তারপর কয়েক বছর বাদে একদিন সেটা হাপিস হয়ে যাবে! যদি এমন হতো যে, আমার লেখায় সেটা লিখলেই ঝামেলা মিটে যেত!!
বললাম- তন্বী, তুমি বাচ্চা মেয়ে। বুঝবে না। এটা লেখা যায় না।
তন্বী বুঝতে পারলো- আমি পারবো না।
হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। কেন এলো সেটা জানি না। তবু এলো। বললাম- তন্বী, তুমি একটা কাজ করতে পারো। যদিও সেটা লেখা থাকবে না আমার রিপোর্টে।
বছর চৌদ্দর মেয়ে কি ক’দিন ধরে এইসব বিয়ে বিয়ে শুনে খানিকটা বড় হয়ে গেছে? বয়স বেড়ে গেছে? তাই মনে হলো।
সে তড়িৎ দু’হাত সামনে এসে বললো- বলুন না ডাক্তার বাবু। কি করবো? সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে খড়কুটো খুঁজে পেয়েছে যেন।
বললাম- তুমি বাবা মা বা অন্য কাউকে দিয়ে ছেলের বাড়িতে খবর দাও যে, তোমার একটা ওভারি বাদ দেয়া আছে। বাচ্চা হবার চান্স কমে যায় খানিকটা তাতে। এটা তোমার রিপোর্টে লেখাও আছে। অপারেশনের কাগজেও লেখা আছে । চাইলেই দেখিয়ে দিও।
আমি দেখলাম, এতে যদি সাপও মরে আর লাঠি ও না ভাঙে, তাহলে এই তন্বী মেয়েটা হয়তো বেঁচে যাবে কিছু বছরের জন্য।
তন্বী অবাক হলো। বললো- তাই হয় নাকি?
বললাম- হ্যাঁ হয়। এটা যে কোন ডাক্তারই বলে দিতে পারে। বলবে ও।
তন্বীর মুখে আলো আসছে ফিরে। দুঃখের ঢেউ দূরে সরে যাচ্ছে। সে যেন খুব কাছেই দেখতে পাচ্ছে একটা দ্বীপ। সেখানে আলো জ্বলছে। সেখানে হয়তো সে উঠতে পারবে সাঁতরে। হয়তো সেই দ্বীপে সে একটা সংসার, সমাজ, দেশ খুঁজে পাবে। সে হয়তো সেখানেই খুঁজে পাবে তার একান্ত আপনজন।
রুমের আবছা আলো ক্রমশঃ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তন্বী বললো- ধন্যবাদ ডাক্তার।
চৌদ্দ বছরের মেয়ের মুখে ধন্যবাদ শুনে খুশি হতে পারলাম না। তবু উপর উপর হাসলাম। কাঁদলামও! ভেতরে।
মনে মনে বললাম- তন্বী, তুমি মেডিকেল সায়েন্স পড়তে না পারো ক্ষতি নেই, কিন্ত মেডিকেল সায়েন্সের এই কারিকুরিটুকু ব্যবহার করে বেঁচে থাকো। ভালো থাকো তোমার সেই অলীক দ্বীপ রাজ্যের রানী হয়ে। আমার বা আমাদের যদি কখনো সময় হয় এই সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার, আমরাও যেন সেই দ্বীপের বাসিন্দা হতে পারি।
তন্বী চলে গেছে।
সেই কাল থেকে আমার প্রার্থনা চলছে অবিরাম – তন্বীরা যেন যেমন চায় তেমন করে থাকতে পারে।
আমার মতো নাস্তিকের এই অসম্ভব প্রার্থনা কার কাছে? কেউ শুনছে কি?
জানি না।
অসহায় । বড়ো অসহায় । পঁচিশ বছর বয়সের বৃদ্ধা এসে কাঁদে । হতাশায় ভোগে সেই চার সন্তানের জননী । মরে যেতে ইচ্ছে হয় । মুসলিম কন্যাকে বুকে নিয়ে কাঁদি ।