করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চিকিৎসার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। একদিকে করোনার ভয়ংকর ছোবল, তার ওপরে হাসপাতালে অক্সিজেন, বেডের অভাব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি প্রায় নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। পরে অবশ্য তড়িঘড়ি প্রায় প্রতিটি বড় সরকারি হাসপাতালে নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হয়। বিভিন্ন জায়গায় কিছু স্বেচ্ছাসেবী মানুষ বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন। বিভিন্ন ধরনের শ্বাসকষ্টের রোগীদের প্রায়শই অক্সিজেন দেওয়ার দরকার হয়, সবাই জানেন। কীভাবে অক্সিজেন আবিষ্কার হ’ল আর কেমন করে চিকিৎসার দুনিয়ায় সে আবিষ্কার পা রাখলো, আজ সেই গল্প শোনাবো।
****
প্রাচুর্যের বিচারে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের পরেই অক্সিজেনের স্থান। অক্সিজেন আবিষ্কার খুব বেশিদিনের পুরোনো ঘটনা নয়। ১৭৭১ সালে জার্মান-সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শিলা মারকিউরিক অক্সাইড, সিলভার কার্বোনেট এবং ম্যাগনেশিয়াম নাইট্রেটের মিশ্রণ উত্তপ্ত করে এক নতুন ধরনের গ্যাসের সন্ধান পান। যাকে তিনি জ্বলনশীল বায়ু বা ‘ফায়ার এয়ার’ নামে অভিহিত করেন। ভদ্রলোক খানিক প্রচারবিমুখ ছিলেন। আবিষ্কারের চার বছর পরে ১৭৭৫ সালে তাঁর প্রবন্ধ ‘কেমিক্যাল ট্রিটিজ অন ফায়ার অ্যান্ড এয়ার’ প্রকাশিত হ’লে লোকে তাঁর আবিষ্কারের ব্যাপারে জানতে পারে। তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশের আগেই ১৭৭৪ সালে জোশেফ প্রিস্টলি নামে এক ধর্মতত্ত্ব ও রসায়নবিদ একইরকম উপায়ে এই গ্যাস তৈরি করেন। প্রিস্টলি নিজের সদ্যোজাত আবিষ্কার প্রচারে দেরি করেন নি। লোকমুখে বহুদিন অব্দি প্রিস্টলি-ই অক্সিজেনের আবিষ্কর্তা হয়ে থেকে যান। তিনি দেখেছিলেন এই অদ্ভুত গ্যাসের প্রভাবে মোমবাতি আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলে ওঠে। প্রিস্টলি ফ্লোজিস্টন থিওরিতে (Phlogiston theory) বিশ্বাসী ছিলেন। এই তত্ত্বানুযায়ী জ্বলনশীল বস্তু আগুনে পোড়ার সময় কিছু অদৃশ্য শক্তি বাতাসে মিশিয়ে দেয়। সেই শক্তি কোনোভাবে সরিয়ে নিলে Dephlogisticated air পড়ে থাকে। তিনি মনে করেন, এই নতুন গ্যাস সেরকমই কিছু। এর সাথে কিছু আধ্যাত্মিক ব্যাপার জুড়ে তিনি পরিবেশন করেন। তিনি বলেন, এই নতুন গ্যাস অমিত শক্তিধর। এই গ্যাসের প্রভাবে জীবনীশক্তি দ্রুত বেড়ে যায়। তারপর হাউইবাজির মতো দ্রুত ফুরিয়েও যায়।
বিজ্ঞানী ল্যাভঁয়সিয়ে এই গ্যাসের নাম দিলেন অক্সিজেন। ‘অক্সিস’ কথার মানে তীক্ষ্ণ, ‘জেনেস’ মানে আনয়নকারী। তীক্ষ্ণতার ব্যাপারটা অ্যাসিডের অম্ল স্বাদ থেকে নেওয়া হয়েছিল। ল্যাভঁয়সিয়ের ধারণা ছিল সমস্ত অ্যাসিডে এই অক্সিজেন থাকে। পরে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় কিন্তু নামটা থেকে যায়।
চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে অক্সিজেনের ব্যবহার শুরুর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা নেন ডা. থমাস বেডোস এবং জেমস ওয়াট। ১৭৯৮ সালে ইংল্যান্ডে নিউম্যাটিক ইন্সটিটিউট অফ ব্রিস্টল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা অক্সিজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড দিয়ে হাঁপানি ও হার্ট ফেলিওর-এর চিকিৎসা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ইংল্যান্ডের টাইফাস রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যে এই হাসপাতালে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা ও গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। বদলে সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা শুরু করা হয়। বরাবরই কিছু হুজুগে মানুষ থাকেন যাঁরা চিকিৎসাসংক্রান্ত কোন নতুন উপকরণের সন্ধান পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যথেচ্ছাচার শুরু করেন। অক্সিজেন বোতলে ভরে টনিক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলো। দাম ছিল চোখ কপালে তোলার মতই। চামড়ার তলায়, পেচ্ছাবের রাস্তায়, পেটের মধ্যে এমনকি পায়খানার রাস্তা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া শুরু হয়। অক্সিজেন যে শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমেই দিতে হবে সেটা বুঝতে বহু বছর লেগে যায়।
১৮৬৮ সালে প্রথমবার অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। ১৮৮৫ সালে ডা. জর্জ হল্ট জ্যাপেল নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অক্সিজেনের ব্যবহার শুরু করেন। তখন থেকেই ধীরে ধীরে বোঝা যায় অক্সিজেনের প্রকৃত উপকার পেতে সেটা একটানা ব্যবহার করতে হবে। মাঝে মাঝে অল্প অল্প করে গন্ধ শুকানোর মতো অক্সিজেন দিলে খুব একটা লাভ হয় না। মাঝে মাঝে অক্সিজেন দেওয়া যেন অনেকটা এরকম- “Bringing a drowning man to the surface occasionally”
১৯১১ সালে বিজ্ঞানী হ্যালডেন অক্সিজেনের অভাব জনিত লক্ষণগুলি বর্ণনা করেন। অক্সিজেন মাস্ক-এর আবিষ্কার তাঁর হাত ধরেই। অক্সিজেন এর উপকারিতা ভালোভাবে বোঝা গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। কিছু যুদ্ধপিপাসু মানুষ তখন উন্মাদের মত ধ্বংসের খেলায় মেতেছে। বিষাক্ত গ্যাস বোম ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষাক্ত ফসজিন গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী। পাহাড়ের উপর থেকে গ্যাস বোম ছুঁড়ে দিলে নিচে বিষাক্ত সাদা ধোঁয়া মেঘের মতো ছড়িয়ে যায়। পাহাড়ের তলায় শত্রুপক্ষের ক্যাম্পগুলি ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। প্রথমে অল্প কাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ঘণ্টাখানেকের বেশি থাকলে ফুসফুসে জল জমতে শুরু করে। তারপর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। ১৯১৬-১৭ সালে ১৭০০০ সৈনিক এই বিষের কবলে পড়েন। অক্সিজেন দিয়ে তাঁদের অনেকের সফলভাবে চিকিৎসা করা হয়।
১৯০৭ সালে বিজ্ঞানী আরবাথনট লেন অক্সিজেন বহনকারী রাবার টিউব তৈরি করেন। অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটা সমস্যা হচ্ছিল। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ফুসফুসে জল জমা রোগীদের মুখ দিয়ে প্রচুর গ্যাঁজলা আর থুতু বেরিয়ে এসে মাস্কে জমা হচ্ছিল। ফলে ভালোভাবে অক্সিজেন দেওয়া যাচ্ছিল না। তিনি ছোট দুটো নলওলা ন্যাজাল প্রং তৈরি করলেন। এটা নাকের মধ্যে অল্প ঢুকিয়ে সহজেই অক্সিজেন দেওয়া গেল।
এরপর বিজ্ঞান তার নিজের ছন্দে দ্রুত এগিয়ে চলল। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রার অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হ’ল। সবাইকে একশো শতাংশ অক্সিজেন দেওয়ার দরকার হয় না। তাছাড়া অক্সিজেনেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য তৈরি হল মিটার মাস্ক। সাধারণ বাতাসের সাথে অক্সিজেন বিভিন্ন মাত্রায় মিশিয়ে রোগীকে দেওয়া সম্ভব হ’ল। ধীরে ধীরে আরও অসংখ্য ধরনের মাস্ক ও অক্সিজেন দেওয়ার যন্ত্র বাজারজাত হ’ল। এলো ভেন্টিলেটর। বোঝা যাচ্ছিলো শুধু অক্সিজেন দিয়ে সব রোগের চিকিৎসা করা যায় না। বায়বীয় পদার্থের চাপ ও আয়তন নিয়ে বিভিন্ন সুচারু হিসেব মাথায় রেখে ভেন্টিলেটর ব্যবহার শুরু হ’ল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বপ্নের থেকেও দ্রুত উন্নতি হয়েছে। শ্বাসনালীতে নল ঢোকানো, বুকে চাপ দিয়ে হৃৎপিণ্ড সচল রাখা, অ্যাড্রিনালিন, ভেন্টিলেটর, স্যালাইন, অগুনতি ইঞ্জেকশন… সব কেমন যন্ত্রের মতো করে ফেলতে হয়। ফুসফুসের একদম শেষে যে থলির মতো অ্যালভিওলাস তাকে বাইরে থেকে দেখা যায় না। তবু কেমন অঙ্কের নিয়মে তাকে ফুলিয়ে রাখা যায়। এ কি স্বপ্নের থেকে কম কিছু? চোখের সামনে ভেসে ওঠেন অনেক, অনেক বছর আগের কোনও এক বিজ্ঞানসাধক। পরীক্ষাগারের অন্ধকারে এক কোণে বসে তিনি খুঁজে চলেছেন কোনও এক অপার রহস্যের উৎসধারা।
আচমকা ভেন্টিলেটরের অ্যালার্ম ঘোর ভেঙে দেয়। পাঁচ নম্বরের স্যাচুরেশন কমছে…
ছবিঃ গুগল