ক’দিন ধরেই ভীষণ গায়ে-হাতে ব্যথা হচ্ছিল। খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না একদম। অতটা পাত্তা দিই নি। শেষ একমাসে ডিউটির চাপটাও বেশ বেড়েছিল। ভেবেছিলাম ঘুমের অভাব আর ডিউটির চাপেই গায়ে ব্যথা। এসব ডাক্তারদের জীবনে খুব মামুলি ব্যাপার। ডাক্তারি করতে এসে এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাবতে বসলে চলে না। কিন্তু ব্যথাটা কমলো না। গত রোববার থেকে বুঝতে পারলাম নাকেও গন্ধ একটু কম পাচ্ছি যেন! নাকের সামনে সাবান, স্পিরিট, চা-পাতা এমনকি বডি-স্প্রে রেখেও যখন গন্ধ পেলাম না তখন থেকে সন্দেহ শুরু হ’ল। অবশেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নাগাদ জ্বর এলো, একশো তিন! সাথে বমি ভাব, মাথা ঘোরানো। এরপরে আর সন্দেহের কিছু থাকে না। পরের দিন টেস্ট হ’ল এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘পজিটিভ’।
একটি সরকারি কোভিড হাসপাতালে সেদিনই ভর্তি হয়ে গেলাম। খবর পেয়েই সিনিয়র দাদারা দায়িত্ব নিয়ে ভর্তি, অ্যাম্বুলেন্স সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমাকে কোনও ব্যাপারে মাথা-ই ঘামাতে হয় নি। অবশ্য, সবার জন্যই সরকারি তরফে ফোনে যোগাযোগ করে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হচ্ছে।
অ্যাম্বুলেন্সের বদ্ধ জায়গার মধ্যে একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পুরো ব্যাপারটা মিটে যায়। প্রথম রাতে ডক্টরস’ কেবিন খালি পাওয়া যায় নি। জেনারেল ওয়ার্ডেই রাত্রিবাস। আহা! ‘জেনারেল ওয়ার্ড’ বলে নাক শিঁটকোবেন না যেন.. এই হাসপাতালের ‘জেনারেল ওয়ার্ড’ বহু কর্পোরেট হাসপাতালকে গুনে গুনে খান পাঁচেক গোল দেবে। এসি ওয়ার্ড, দামী বেড, পরিষ্কার চাদর, পাশে ড্রয়ার সহ র্যাক। বেডগুলোর মাঝে ছ’ফুটের বেশি দূরত্ব বজায় রাখা। সিল করা পানীয় জলের বোতল, কৌটোয় সাজানো খাবার, দু-বেলা চা। সাথে স্টাফেদের আন্তরিক ব্যবহার। নিজের কথা বলছি ভেবে বাঁকা হাসি দেবেন না। সবার কথা ভেবেই বলছি। যেহেতু সাথে বাড়ির লোক কেউ নেই তাই বয়স্কদের বকেঝকে নিজেদের হাতে করে খাইয়ে দেওয়া, সময়মতো ওষুধ-জল পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি সবটাই অত্যন্ত দক্ষতা আর মানবিকতার সাথে তাঁরা করে চলেছেন। নিয়মিত জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তাররা দেখভাল করছেন। সবটাই ওই পিপিই-র অসহ্য কষ্ট নিয়ে। প্রাথমিক অব্যবস্থা কাটিয়ে সরকার কোভিড নিয়ে যে রকম ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছেন তাতে তাঁদের অকুন্ঠ প্রশংসা প্রাপ্য। এখনো অনেক অভাব, অনেক অভিযোগ আছে জানি। তবু, এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা যতখানি করেছেন সেটাও অনেক।
যাক গে, সেসব কথা। ওয়ার্ডের কথায় ফিরি। সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড মানেই এক অদ্ভুত মিলনমেলা। কাল অব্দি যারা সম্পূর্ণ অচেনা ছিলো তারা-ই আজ কেমন পিসি-মাসি-ভাইপো-জ্যাঠা-দাদু-ভাই-বোন হয়ে গেছে। আমার পাশের বেডের দাদুর বয়স আশি-পঁচাশি হবে। পেচ্ছাব-পায়খানা সব বিছানাতেই। দাদু মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠছে.. ওরে রতন, আমাকে এরা বাঁচতে দিবে নি রে… ও বাবু, এলি রে? আসবি নি? ধুস শালা! ভারতমাতা কী জয়!
বলে হাত মুঠো করে ওপর দিকে ছড়িয়ে দিয়ে নার্সিং স্টাফেদের হাঁক..ও মা.. আমাকে একটু জল দে না রে মা..
জল দিতেই দাদুর পরবর্তী বায়না.. – আর পায়েস দিবি নি? কাল কিন্তু চিকেন বিরিয়ানি দিবি..
ওয়ার্ড ততক্ষণে দাদুর কান্ডকারখানায় জমজমাট হয়ে উঠেছে। অন্যান্য বেডগুলোতেও বেশ নিজেদের মধ্যে গল্পের আসর বসেছে। একটা হাফ-দেওয়ালের ওদিকে মাসি-পিসিদের গল্প বসেছে। সেসব গল্পে রান্নার রেসিপি, শাশুড়ি-বৌমার পাঁচালী, আচারের বয়াম, নাতির দুষ্টুমি.. আরও কী নেই!
ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে বিশাল বিশাল কাঁচের জানলা। আটতলার ওয়ার্ড থেকে রাতের কোলকাতাকে কী মোহময়ী লাগছে! পজিটিভ আসার পর থেকে যেসব দুশ্চিন্তা ছিল সেগুলো ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে.. পরের কিউবিকলের জেঠু সবাইকে ডেকে ডেকে নাতনির গান শোনাচ্ছেন। দাদু একলা আছে বলে নাতনি গান রেকর্ড করে দাদুর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। নাতনি আধো আধো গলায় গাইছে.. “জাগো, তুমি জাগো.. জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী..”
নাতনির গানে ভরে উঠছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান- হাসপাতাল। পাশ থেকে কেউ বলে উঠলেন– বড় মায়া গো.. কেউ কি ছেড়ে যেতে চায়? যত বয়স বাড়ছে আরও বেশি করে মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি। কতদিন আমার মেয়েটার মুখ দেখি নি..
মনে পড়ে যাচ্ছে, কোলকাতা আসার আগেরদিন রাতে আরশিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম.. জানো তো, কাল বাবা হাসপাতালে চলে যাবে..
আরশি আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল.. তুমি কোতাও যেও না। আমার ছাথে খেলু করো, আমাকে হাম্পু খাও, শেয়ালের গল্প বলো..
তবু চলে আসতেই হয়।
বাইরে তখন হাল্কা বৃষ্টি নেমেছে। আমি চাদরটা কান অব্দি জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ি। চাদরের তলায় মায়ার ওম। শরীর জুড়ে আধো আধো কথার দল পাহারা বসায়.. ‘বাবা, বেচি করে জল খাবে’, ‘পায়ে উসুদ লাগালে না তো?’
মারীর সাধ্য কি সে পাহারা টপকে আমার গায়ে আঁচড় কাটে?
“Prithibir sarboshreshtha tirthasthan Hospital”?????
খুব সুন্দর লিখেছ। বড় মন ছোঁয়া।
বর্ণনা খুব ভালো লাগলো।