হতে পারে আমরা বুদ্ধিতে একটু মাটো। তাই বলে সবাই হ্যাটা করবে? আরে, জানিস যদি ব্যাপারটা কী, বলে দে না! তা নয়, সারা সময় ধরে পুজো মণ্ডপের বাইরে গুজব… গুজগুজ ফুসফুস।
পাড়ার উদীয়মান দাদা বল্টুদা, গতকাল নবমী থেকে অর্ডার করে রেখেছে আমাকে। শুধু আমাকে না, বটু হরি শান্ত পিনাকী এই রকমের যে কজন ইয়ে আছি ভানু চ্যাটার্জির মোড়ে আড্ডা মারা পাবলিক, সবাইকে বলে রেখেছে, আজ সকাল সাড়ে দশটা থেকে ‘আমরা সবাই’ ক্লাবের মণ্ডপ লাগোয়া যে রাস্তাটা, সেখানে ভিড় করে দাঁড়াতে হবে। এত ভিড় করতে হবে যেন রাস্তা পুরো আটকে যায়।
এমনিতে পথ অবরোধ নিষিদ্ধ। তবে কিনা জনতার আবেগের বন্যায় রাস্তা আটকানো হলে কারওর কিচ্ছুটি বলার নেই। এও এক ধরণের ম্যান মেড বন্যা। বন্যা হলে রাস্তা আটকাতেই পারে। পারে না?
কিন্তু কেন? রাস্তা কেন আটকানো হবে?
এই কেনর উত্তর দুটো। এক নম্বর কারণটা বল্টুদা জানে। দাপুটে অমরদা মানে অমর মল্লিক চেয়েছে বলে। এর আগে যে বার চেয়েছিল সে বার ভিড় তত টাইট মানে নিশ্ছিদ্র করা যায়নি বলে একটা অ্যাম্বুলেন্স পাস করে গেছিল। আর গেছিল বলেই অ্যাম্বুলেন্সে শোয়া বামাচরণ পাল হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছিল। সেই বামাচরণ মানে আমাদের দলকে ভোট না দেওয়া বামাচরণ বেঁচে ফিরে এই চ্যাটার্জির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ছোঃ’!
যদিও এত সাহসের শাস্তি বামার ইয়েতে ঠুসে দিয়েছে বল্টুদার মাথার ওপরে থাকা অমর মল্লিক, কিন্তু সেই অমর মল্লিক বল্টুদাকেও উপযুক্ত সাজা দিতে ছাড়েনি।
এবারও সেই অমর মল্লিকের অর্ডার।
তাই বল্টুদার এবারের জিগির, মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন। আমরা রাস্তা এমন আটকান আটকাব যে আস্ত গাড়ি তো দূরের কথা, একটা পিঁপড়েও যেন না গলতে পারে। পারবে না সে ব্যাপারে গ্যারান্টি।
বল্টুদা চাপ খেয়েছে। কাজেই রাস্তা নিশ্ছিদ্র বন্ধ করতে হবে! তো এই গেল একটা কেনর উত্তর।
এবার দ্বিতীয় কেনর উত্তরটা। আদৌ কেন বল্টুদা চাপ খেল? কী ঘটবে আজ? বল্টুদাকে জিজ্ঞেস করে লাভ হল না। সে কিছুই জানে না।
কড়া স্বভাবের অমর মল্লিককে আমরা প্রশ্ন করতে সাহস পাই না।
তবু জিজ্ঞেস করলাম। আজ কিন্তু ফুরফুরে মেজাজে ছিল। উত্তর দিল সেই মেজাজেই।– আরে, পূজোর উদ্বোধনে তো ওনাকে আনতে পারিনি। বাধ্য হয়ে সেটা ফাল্গুনি নস্করকে দিয়ে করাতে হল। অনেক চেষ্টায় আজ দশমীর সকালে সেই তিনিই আসবেন! তাই ভিড় করতে হবে। ভিড় না দেখলে উনি রেগে যান, জানিস তো?
— উনি আসবেন? বাপ রে! কেন আসবেন দাদা?
— আরেহ্, কেন আবার! উদ্বোধন করতে আসবেন।
ব্যাপক চমকিত হলাম! দশমীর দিন সকালে আবার কীসের উদ্বোধন! বিসর্জনেরও কী বলে ওই উদ্বোধন লাগবে নাকি? ইউনেস্কো কি অর্ডার দিয়েছে সে রকম?
আশ্বস্ত করল অমর মল্লিক– না রে না, বিসর্জনের না! আগামী বছরের পুজোর উদ্বোধন করে দেবেন উনি এই বছরের দশমীতে। মহালয়ার আগে ফিতে কাটেন বলে বিরোধীরা খুব হ্যা হ্যা হাসি দেয় তো। এবার থেকে আরও আগে… বছর খানেক আগেই উদ্বোধন চালু করবেন উনি। ইউনেস্কো আর গিনেসের বাপ অবধি চমকে যাবে।
— কিন্তু তাতে লাভ কী?
— বাঃ রে, বুঝলি না? লাভই লাভ তো! উনি বলেছেন পুজো মানেই অর্থনীতির উন্নতি, ঠিক কি না?
আমরা সমস্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই’!
— কথা সেটাই। এবার থেকে সারা বছর ধরে চলমান পুজো মানে সারা বছর ধরে অর্থনীতি চলমান। চা বিক্রি, ঘুগনি বিক্রি। প্রচুর অর্থনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার।
তারপর ধর প্যান্ডেলগুলো সারাবছর থাকবে। রোদে ঝড়ে জলে থাকবে সেগুলো। সেগুলোর রিপেয়ার। ইউনেস্কো বলেছে হেরিটেজ। তা সেই হেরিটেজ স্ট্রাকচারের রিপেয়ার তো করতেই হবে। হবে না? সারা বছর কাজ হবে। একশ দিনের কাজ না, একেবারে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের কাজ… হই হই উন্নয়ন, বুঝলি তো?