স্বাধীনতা দিবস নিয়ে ভাবতে বসলে যে কথাটা শুরুতেই স্বীকার করে নিতে হয়, এই বিশেষ দিনটা নিয়ে আমি কখনোই সেভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পড়িনি। নাহ্, সেই ছোটবেলাতেও না। ইশকুলে পতাকা উত্তোলন হতো, কোনও স্যার বা দিদিমণি কিছু না কিছু নিশ্চয়ই বলতেন, গান হতো দু-একখানা – অল্প কিছু খাবারও দিত কি, ঠিক মনে পড়ে না – কিন্তু পুরোটাই রুটিন মেনে। তার বেশি কিছু নয়।
গানের মধ্যে জনগণমন আর বন্দেমাতরম কম্পালসারি। আমাদের ছোটবেলা বলতে প্রাক-রহমান সুরের বন্দেমাতরম। কথাটথা বোঝার ব্যাপার নেই। স্রেফ সুরে সুরে মুখ লাগানো। তবে সুরখানা বড় মায়াবী ছিল।
দেশপ্রেম বলতে যে ব্যাপারটা, সেদিকটাও খুব একটা গুছিয়ে লালন করা হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের জীবনী অবশ্য পড়েছি অজস্র। নেতাজি তো বাংলা রচনায় খুবই ইম্পর্ট্যান্ট ছিলেন, তবে সে প্রয়োজন ছাড়াও পড়েছিলাম। একাধিক জীবনী। তাছাড়াও মাস্টারদা, প্রীতিলতা, বাঘা যতীন, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ক্ষুদিরাম প্রমুখ। বাঙালি ঘরে গান্ধীজি তেমন একটা দর পেতেন না তখন, নেহরু তো ননই। তবুও জেলে বসে মেয়েকে লেখা নেহরুর চিঠির সংগ্রহটা পড়েছিলাম, একাধিকবার।
ক্লাস সিক্স-সেভেন নাগাদ বাবা কিনে দিয়েছিল শহীদ স্মৃতি নামের একখানা বই। শিব বর্মার লেখা। ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু, যতীন দাস – এঁদের সামনাসামনি দেখেছিলেন যিনি, এমন মানুষের লেখা। বইটা বড় প্রিয় ছিল আমার।
তারপরও, হয়ত দুর্ভাগ্যজনকভাবেই, দেশের প্রতি আলাদা করে একটা বাঁধভাঙা আবেগ আমার মধ্যে জেগে ওঠেনি।
আমি শুধু জানতাম, এই দেশটা আমারই দেশ। এর ভালোমন্দ সব মিলিয়েই এটা আমার দেশ – আমি এই দেশটার অঙ্গ, দেশটাও আমার অংশ – সীমাবদ্ধতা যা কিছু থাকুক, সেসব মেনে নিয়েই দেশটা আমাকে বড় করেছে, আমাকে মেনে নিয়েছে – আমিও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই দেশটাকে নিজের মতো করে মেনে নেব।
ব্যাপারটা অনেকটা আমার সঙ্গে আমার মায়ের সম্পর্কের মতো। আমি জানি, আমার মা মাদাম কুরির মতো জিনিয়াস নয়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো গাইয়ে নয়, গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতো বিদুষী নয়, সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে নয় – কিন্তু হাজার এক্সচেঞ্জ অফার পেলেও উপরোক্ত কাউকে কি মা হিসেবে দেখতে চাইব? এমনকি পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, সেখানেও তো এই সীমাবদ্ধতা-সহ মানুষটিকেই তো মা হিসেবে আরও একবার চাইব, তাই না? এবং তারপরও মায়ের উপর কারণে-অকারণে রাগারাগি করব, গজগজ করব, চেঁচামেচি করব – করব, কেননা জানি, মা কিছুই মনে রেখে দেবে না।
তো এই হলো ঘটনা। দেশপ্রেম বা দেশ ঘিরে ভয়ানক আবেগ, এসব সেভাবে আমার মধ্যে নেই। শুধু একটা মেনে নেওয়া আর পারস্পরিক মানিয়ে নেওয়া জড়িয়ে নেওয়া আছে। এটা আমার দেশ। এই দেশটা আমার। দেশটা পৃথিবীর সেরা নয়, হয়ত – কিন্তু সে তো আমিও পৃথিবী কেন, পাড়ারও সেরা নই… এই দেশটা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকা বা বাঁচার স্বপ্নটুকুও দেখতে পারি না। [গৌরবের কথা কিনা বলতে পারি না, তবে শেষের এই কথাটুকু অন্তত আমার একখানা বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। সম্পর্ক বছরকয়েক এগোনোর পর জানা গেল, তার জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্ন, আমেরিকায় বাকি জীবন কাটানো (যে পথেই হোক, সে স্বপ্ন তার সফলও হয়েছে) – যাকে বলে, সেটল করা – আর আমার জীবন, চিরকালই, বেয়াড়া রকমের উচ্চাশা ও স্বপ্নহীন, অন্তত এমনধারা স্বপ্নের থেকে শতহস্ত দূরে তো বটেই। অতএব…]
তো স্বাধীনতা দিবস বলতেও আলাদা করে কিছু অনুভূতি হয় না। একটা ছুটির দিন, কাছ ও দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের শব্দ, গান, ঘোষণা ইত্যাদি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে পাঁঠার মাংসের সুবাস। সব মিলিয়েই…
অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক অশ্রুর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা – এটুকু জানি।
এবং এও জানি, চিটিংবাজির দায়ে জেলে যাবার পথে, ওহ্ লাভলি, নেতা বলে যান, নেতাজিকেও তো জেলে যেতে হয়েছিল… নিষ্কম্প কণ্ঠে এতখানি অর্বাচীনতাও স্বাধীনতা বই কি!
সভা ডেকে গলা তুলে প্রশ্ন তোলা – কেষ্টর কী দোষ ছিল, কেন ধরা হয়েছে ওকে – এমন সহজসরল শিশুসুলভ প্রশ্ন করতে পারা, সেও স্বাধীনতা বই কি! সেই ভাষণ শুনে যাঁরা হাততালি দিলেন, একপ্রকার স্বাধীনতা, অবশ্যই।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে পৌঁছে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে একঘরে করে ফেলে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গড়ার স্বপ্ন দেখা, সেও স্বাধীনতা, সম্ভবত।
চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ব-মাল ধরা পড়া চোরেদের সমর্থনে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল করতে পারা – স্বাধীনতা নিশ্চিতভাবেই।
দেশের সম্পদ, দেশের খাল-বিল-নদী-জঙ্গল বিক্রি করতে করতে বাড়ির ছাদে জাতীয় পতাকা তোলার নিদান – স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রকাশ, সন্দেহাতীতভাবে।
আগেই বললাম, আমি তো তেমন দেশপ্রেমিক নই – স্বাধীনতা দিবস নিয়ে চূড়ান্ত আবেগমথিত হওয়ার অভ্যেস আমার তো সেই ছেলেবেলা থেকেই নেই…
শুধু মনে হয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে লজ্জিত হতে পারাটাও তো স্বাধীনতা।
নেতা-নেত্রীদের মনে করিয়ে দিই, আমরা এবং তাঁরা, উভয়পক্ষই কিন্তু সত্যিসত্যি স্বাধীন। তাঁদের কাছ থেকে লজ্জা পাওয়ার স্বাধীনতা এখনও কেউ হরণ করে নেয়নি।
নিজেকেও, নিজেদেরও মনে করাই – দায় এড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা, অবশ্যই, আমাদের রয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা অবাধে প্রয়োগ হতে থাকলে একটু একটু করে বাকি স্বাধীনতাগুলো কমে আসতে থাকে।