যিষ্ণু দাস, ডঃ অভিজিত বিনায়ক ব্যানার্জী, রেশমান হুসেইন ও ডাঃ অভিজিত চৌধুরী বীরভূমের লাভপুর, ইলামবাজার ও সাঁইথিয়া ব্লকের ২০৩-টি গ্রামের ৩০৪ জন অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবক (ইনফর্ম্যাল হেলথকেয়ার প্রোভাইডার বা হাতুড়ে চিকিৎসক) ৭২ দিন প্রশিক্ষন দিয়ে কতটা উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যায় তা নিয়ে একটা সমীক্ষা চালান। ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনে ২০১৬ সালের ৭-ই অক্টোবর তাঁদের ‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব ট্রেনিং ইনফর্ম্যাল হেলথকেয়ার প্রোভাইডার্স ইন ইন্ডিয়া: আ র্যান্ডমাইজড্ কন্ট্রোলড্ ট্রায়াল’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষণাতে দেখা যায় যাঁরা প্রশিক্ষণ নিলেন না তাঁদের চেয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্তরা ১৪ শতাংশ উন্নত চিকিৎসা দিতে পারছেন। ছোট স্যাম্পল সাইজের এই গবেষণাটিতে অনেকগুলো অনুমান আছে, পক্ষপাত আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, যেগুলো গবেষকরা নিজেরাই উল্লেখ করেছেন। উপসংহারে তাঁরা লিখছেন, ‘প্রশিক্ষণ দিয়ে অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবক দিয়ে রোগের সঠিক চিকিৎসা কিছুটা নিশ্চিত করা গেলেও অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ প্রেসক্রাইব করার প্রবণতা কমানো যায়নি। সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর যে সমস্যা, তার সমাধানের একটা কার্যকরী, স্বল্পমেয়াদী কৌশল হতে পারে অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের এ’ধরণের প্রশিক্ষণ।’
গবেষণাটির নক্সা খুবই ভালো সন্দেহ নেই, যদিও কোন পিয়ার-রিভিউ নেই এখনো অব্দি। গবেষকরা লিখছেন, ‘এমবিবিএসে মেডিক্যাল কলেজে পাঁচ বছর পড়াশোনা কখনই এই ৭২ দিনের প্রশিক্ষণের সমতুল নয়, তবুও বলা যায় যে ঐ ২০৩-টি গ্রামের জন্য ১১-টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১১ জন এমবিবিএস ডাক্তার রাখতে যা খরচ, সেই পয়সায় ওখানকার সব অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবক প্রশিক্ষণ হয়ে যাবে।’ গবেষকরা দাবী করেছেন তাঁদের কোন স্বার্থের সংঘাত নেই এই গবেষণাতে। চার গবেষকের প্রথমজন বিশ্বব্যাঙ্কে কর্মরত। প্রসঙ্গতঃ, এই গবেষণার যাবতীয় খরচ বহন করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক, ন্যাশনাল হেলথ মিশন ও একটি বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানী বলেও উল্লেখ করেছেন তাঁরা। আমাদের বোঝা দরকার কেন এই সংস্থাগুলো এধরণের গবেষণায় পয়সা ঢালে? কি চায় ওরা?
বুঝতে গেলে যেতে হবে গভীরে। মেডিসিনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে শাসকশ্রেণী তাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, তবে ফরাসী বিপ্লব ও ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের পর অর্থাৎ পৃথিবীতে পূঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মেডিসিনকে ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতা বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে। বিশ্বের নানা প্রান্তের তাবড় তাবড় গবেষকরা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে ইউরোপীয় ক্ষমতাধর দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বে তাদের উপনিবেশের জাল বিস্তারে মেডিসিনকে কাজে লাগিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশের দেশীয় যেসব চিকিৎসাব্যবস্থাগুলো বিদ্যমান ছিল, ঔপনিবেশিকরা সুকৌশলে সেগুলোর বিকাশের পথে অন্তরায় হয়েছে উপনিবেশের জনগণের উপর তাদের নিজেদের ‘কলোনিয়াল মেডিসিন’ চাপিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে। এমনকি ভারতসহ অন্যান্য সাবেক উপনিবেশগুলোতে ইউরোপীয় মেডিসিন চর্চার প্রতিষ্ঠান, পাঠক্রম, শিক্ষনশৈলী সবকিছুকেই তারা তাদের নিজেদের স্বার্থবাহী ছাঁচে ঢেলে তৈরী করেছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, তার সামাজিক অস্তিত্ব এসব ছেঁটে ফেলে শুধুমাত্র একটা শরীর হিসেবে, শরীরকে শুধু কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমাহারে গঠিত বস্তু হিসেবে দেখে তার উপর মেডিসিনের প্রয়োগ ঘটাতে শেখানো হল। টেক্সট বইগুলো আজো অধিকাংশই ইউরোপীয় বা আমেরিকান। আজকের দিনেও আমাদের দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নানা বিরল রোগের চিকিৎসা শেখানো হলেও সর্পদংশনের চিকিৎসা শেখানো হয় না, অথচ এর জন্য এদেশে প্রতি বছর বহু মানুষ মারা যান।
কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রথম প্রমাণ করলেন যে রোগবালাই ও অসুস্থতার মুখ্য কারণ হল দারিদ্র ও শোষণ, তার সমাজব্যবস্থা, যা এই পূঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অবদান। ১৮৪৫-এ এঙ্গেলস ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের কলে-কারখানায় শ্রমিকরা কিরকম দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন, মহিলা ও শিশুদের অবর্ণনীয় অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণসহ লিখলেন ‘কন্ডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। ১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে আক্ষেপের সুরে তাঁরা লিখলেন সমাজে যাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের চোখে দেখা হত সেই বিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের এঁদেরকেও কিভাবে পূঁজিবাদ তার মজুরীভোগী শ্রমজীবীতে পরিণত করেছে। দাস ক্যাপিটালে মার্ক্স অঙ্ক কষে দেখালেন কিভাবে পূঁজি মালিকের হাতে পূঞ্জীভূত হয়, আর যারা নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপন্ন করে পূঁজিপতিদের মুনাফার সুযোগ করে দেয়, তারা ক্রমশঃ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে গিয়ে অপুষ্টি, অজ্ঞতা, পাশবিকতা, শারিরীক ও নৈতিক অধঃপতন এবং দাসত্বের শিকার হয়। তাঁরা কারখানার ডাক্তারদের রিপোর্ট, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট ইত্যাদি উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে খাদ্যাভাব, খারাপ আবাসন, সঠিক স্যানিটেশনের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পোষাক-পরিচ্ছদ, শিল্প-দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদি থেকেই যাবতীয় অসুস্থতা ও রোগভোগের উদ্ভব। রোগের মূল কারণ যখন এগুলো, তখন রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসারও লক্ষ্য হওয়া উচিত এগুলোই। দারিদ্রমোচন, উপযুক্ত স্যানিটেশন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনমাফিক খাদ্যের যোগান, মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের অবসান – রোগ সারানো মেডিসিনের আশু লক্ষ্য হলেও, মূল লক্ষ্য এগুলো।
সোভিয়েত রাশিয়ায় তাই শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখলের পরেই প্রবর্তিত হল মা্র্ক্সীয় ধারণায় রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার নীতি বা ‘সোশ্যালাইজড্ মেডিসিন’। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শ্রমিক-কৃষকদের সপরিবার স্বাস্থ্যবীমা, যার নিয়ন্ত্রণ রইল তাদেরই হাতে। রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই প্রথম জনগণের স্বাস্থ্য জনগণের নিরাপদ হাতে গেল, চিকিৎসকের ভূমিকা যেখানে সহযোগী সোশ্যাল ফিজিশিয়ানের। চীনেও বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে ঢেলে সাজানো হল স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বিপ্লবের দেড় দশক পর মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে থেকে শিক্ষিত, চৌখস যুবক-যুবতীদের বেছে নিয়ে তাদের ছ’মাস থেকে দু’বছর টানা প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করা হল চৌদ্দ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর একটা বাহিনী, যাদের গ্রামের মানুষ খালিপদ ডাক্তার বলত। কিউবায় বিপ্লবের পর চে গেভারার নেতৃত্বে বদলে ফেলা হল স্বাস্থ্যব্যবস্থার খোলনলচে। রেভল্যূশনারী মেডিসিন প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে চীনের আদলে গ্রামগঞ্জের শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে শিক্ষিত অংশকে বেছে এনে নতুন মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি করা হল, মেডিক্যাল কারিকুলাম বাড়িয়ে সাতবছরের করা হল, সিলেবাসে জোর দেওয়া হল প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে। পাঠ শেষে তাদের গ্রামে গ্রামে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার খুলে পাঠানো হল এইসব সোশ্যাল ফিজিশিয়ানদের। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোকেও চমকে দিয়ে তারা দেশের স্বাস্থ্যসূচকগুলোকে টেনে তুলে দিল ঈর্ষনীয় স্তরে।
আমাদের দেশের প্রথম হেলথ সার্ভে অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটি গঠিত হল ১৯৪৩ সালে, আইসিএস অফিসার স্যর যোসেফ উইলিয়াম বোরের সভাপতিত্বে। কমিটিতে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়সহ সারাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ছিলেন, ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ১৯৪৬-এ কমিটি রিপোর্ট পেশ করল। ৫৪১ পৃষ্ঠার বিস্তারিত রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার সোশ্যালাইজড্ মেডিসিন মডেলের অনুসরণে এদেশেও মেডিক্যাল শিক্ষাকে পুনর্গঠিত করে সোশ্যাল ফিজিসিয়ান বাহিনী তৈরী করে তাদের নেতৃত্বে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচীতে জোর দিয়ে একটা শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হল। পরবর্তীকালে গঠিত আরো নানা কমিটির নানা সুপারিশের মাঝে চিকিৎসক ও জনগণের মাঝে সেতুবন্ধনের উদ্দেশ্যে মাল্টিপার্পাস হেলথ ওয়ার্কার নিয়োগের সুপারিশও এল।
১৯৭৮-এ আলমা আটা মহাসম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যের ডাক দিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর থেকে একমেরু বিশ্বে পূঁজিবাদ আরো আগ্রাসী হয়ে উদার অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরতেই তাদের তিন সংস্থা বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ ও ওয়র্ল্ড ট্রেড অর্গ্যানাইজেশন তৃতীয় দুনিয়াকে বাধ্য করল তাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে মুনাফা লোটার জন্য খুলে দিতে। শুরু হল বেলাগাম বেসরকারীকরণ।
১৯৮৩-তে ভারতের প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে যে অভিমুখ ছিল, ২০০২-এর স্বাস্থ্যনীতিতে তা আমূল বদলে গেল, খুলে গেল বেসরকারীকরণের রাস্তা। ২০১৭-র স্বাস্থ্যনীতিতে আরো খুল্লামখুল্লা বেসরকারীকরণের পক্ষে সওয়াল করা হল। সরকারী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগের বদলে জনগণের করের টাকায় বেসরকারী বীমাকোম্পানীকে মোটা টাকা প্রিমিয়াম দেবার রাস্তা বেছে নিল সরকার।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশে কর্পোরেট হাসপাতালের দাপাদাপি শুরু হয়েছে গত তিন দশকে। তবে গত দেড় দশকে বেসরকারীকরণ অন্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। প্রতি ৪০ হাজার জনসংখ্যা পিছু একটা করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও প্রতি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’জন করে চিকিৎসক নিয়োগের কথা বলেছিল বোর কমিটি ১৯৪৩ সালে। গত কয়েক দশকে নতুন কোন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে চিকিৎসকের সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রতি দুই বা তিনটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পিছু একজনে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসকের সংখ্যা। অথচ এক একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গড়ে লক্ষাধিক মানুষকে পরিষেবা দেয়। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে প্রতি হাজারে দেশে ১২.৩৭ জন অসুস্থ হতেন, বাড়তে বাড়তে ২০১৪-তে সেই সংখ্যাটা ৯৭.৮-এ দাঁড়িয়েছে, এখন শতাধিক হবে নিশ্চিত বলা যায়। এই হিসেব সাধারণতঃ ১৫ দিনের হয়। অর্থাৎ প্রতি ১৫ দিনে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় দশ হাজার অসুস্থ হলে দৈনিক প্রায় সাত হাজার। এই সাত হাজারের মধ্যে ক’জন আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন! যে ক’জন আসেন, তাঁদের ভিড় সামলাতে হিমশিম ডাক্তারবাবু গড়ে ১.৭৪ মিনিট ব্যয় করতে পারেন রোগী পিছু (ডঃ অভিজিত বিনায়ক ব্যানার্জীদের ঐ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে)।
প্রতি হাজারে অসুস্থতার হার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, কিন্তু রোগ প্রতিরোধে অর্থবরাদ্দ বাড়ছে না। বিশ্বব্যাঙ্কের ২০১৬-র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৪-এ মোট সরকারী বরাদ্দের ৪ শতাংশ খরচ হত জনস্বাস্থ্যে, ২০১৪-তে তা ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তির অনুপাত ২০০৪-এ ছিল ১৬.৭ শতাংশ, ২০১৪-তে বেড়ে হল ২২.৮ শতাংশ।
একদিকে জেলায় জেলায় পরিকাঠামোবিহীন মেডিক্যাল কলেজ খোলা হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। একদিকে ঝাঁ-চকচকে সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল নির্মান, অন্যদিকে সেখানে যন্ত্রপাতির অভাবে সার্জেনরা সার্জারি করতে পারেন না। একদিকে জিডিপি-র মাত্র এক শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ, অন্যদিকে তার থেকে মোটা অঙ্ক বেরিয়ে যাবে আয়ুষ্মান ভারত বা স্বাস্থ্যসাথীর বীমার প্রিমিয়াম দিতে। একদিকে নব্যচিকিৎসকরা পাশ করে বেরিয়ে চাকরী পাবে না, অন্যদিকে বলা হবে ডাক্তারের অভাব। একদিকে পে কমিশন চিকিৎসকদের নন্-প্র্যাক্টিসিং অ্যালাউন্স কমিয়ে তার উর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হবে, অন্যদিকে প্র্যাক্টিসিং নার্সের কথা বলা হবে। এগুলো আপাতভাবে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এই সমস্ত কিছু একসূত্রে বাঁধা, লক্ষ্য একটাই – বেসরকারীকরণ। রোগ প্রতিরোধে লোকসান বেসরকারী হাসপাতালের, ক্লিনিকের, ওষুধ কোম্পানির। তাই লাটে তুলে দিতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আনুষ্ঠানিকভাবে না তুলতে পারলে কার্যকরীভাবে তাকে তুলে দিতে হবে, ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিতে হবে – নয়া উদারনীতির ধারক-বাহক বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ-এর অলিখিত নির্দেশ।
এরাজ্যে সরকারী হাসপাতালে নতুন চিকিৎসক নিয়োগের জন্য মেডিক্যাল কলেজে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিতে বলেছিলাম আমরা, নেওয়া হয়নি। উল্টে স্বজনপোষণ করে নেতা-মন্ত্রীদের আত্মীয়দের এক একজনকে ১২-১৩ টি পদে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। বেতনে কোপ বসানো হয়েছে, প্রোমোশনে গড়িমসি ও স্বজনপোষণ, কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত বাসস্থানের অভাব, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকোচন, নিগ্রহের ঘটনায় শাসকদলের মদত, সরকারের উদাসীনতা, ঐচ্ছিক অবসরের অধিকার হরণ, অবসরের সময়সীমা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা, আমলাতন্ত্রের ছড়ি ঘোরানো – এইসবই ডাক্তারের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির কৌশল। কিন্তু তাহলে পাড়ায় পাড়ায় নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলার আগ্রহ কেন?
ফিরে যাই ১৮৪৮-এ। কমিউনিস্ট ইস্তেহারে লেখা হল, ‘মানুষের যেসব বৃত্তিকে মানুষ এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিষ্ময়ের চোখে দেখে এসেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞাণী – সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরীভোগী শ্রমজীবী রূপে।’ চিকিৎসক কর্পোরেট পূঁজির মজুরীভোগী শ্রমজীবীতে পরিণত হলে মার্ক্সের দাস ক্যাপিটালের ২৫ নম্বর অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছদে বর্ণিত উদ্বৃত্ত শ্রমজীবি উৎপাদনের সূত্রাবলী তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তো হবেই। ক্রমবিকাশমান কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে শুধু ডাক্তার সরবরাহ করলেই করলে চলবে না, পূঁজির নিয়ম মেনে মজুত বেকার ডাক্তারবাহিনীও প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে কর্পোরেট হাসপাতালের আরো, আরো মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে তাদের কম মজুরীতে আরো শোষণ করা যায়, বিজনেস টার্গেট পূরণ করবার নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে সহজেই তাকে ছাঁটাই করা যায়, ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ পলিসি সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায়। শুধু চিকিৎসক নয়, নার্স, টেকনিশিয়ান সবার ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।
যদিও এই গবেষণাপত্রটির সঙ্গে নোবেল প্রাইজের কোন সম্পর্কই নেই, তবু চিকিৎসকের কৃত্রিম অভাব মেটাতে স্বাভাবিকভাবেই নোবেলবিজয়ীর গবেষণাকে ঢাল করা হচ্ছে। সঙ্গে একটা বামপন্থীদের চেয়েও বেশী বামপন্থার বিভ্রান্তি তৈরীর জন্য চীনের খালিপদ ডাক্তারের উদাহরণ টানা হচ্ছে। উদার অর্থনৈতিক পূঁজিবাদী জমানায় উন্নয়নমূলক ধারণায় অনেক বদল এসেছে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও তাঁর অনুসারী অর্থনীতিবিদদের হাত ধরে। অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, এস্থার দাফলো-রা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কত কম সরকারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কত বেশী সক্ষমতা মানুষকে দেওয়া যায় তার প্রেসক্রিপশন দিলেন। তবে এই অর্থনৈতিক দর্শন সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে দেখার কথা বলে না, মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানের কোন দিশা দেখায় না। আর সেজন্যই পূঁজিবাদী দুনিয়া এই দর্শনকেই অন্তিম সমাধানের রাস্তা হিসেবে দেখাতে চায়, তাঁদের তোল্লাই দেয়। আর চীনে খালিপদ ডাক্তার নিয়োগ ও কিউবায় সোশ্যাল ফিজিসিয়ান তৈরীর সঙ্গে এদেশের অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের প্রশিক্ষণের কোন তুলনাই চলে না, কারণ সেখানে একটা নির্দিষ্ট স্তর অব্দি লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েদের বাছাই করে পূর্ণসময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন ক্যাডার তৈরী করা হয়েছিল। নোবেলজয়ীর গবেষণার তথ্য বলছে ঐ ৩০৪ জন অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের ৬২ শতাংশ মাধ্যমিক অব্দি পড়াশোনা করেছে, বাকীরা তার কম। সরকারী নির্দেশে অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণী অব্দি পড়েছেন এমন সংখ্যা প্রচুর। এঁদের অনেকেই পৈতৃক সূত্রে এই পেশায় এসেছেন। অনেকেই আগে ওষুধের দোকানে কাজ করতেন, কেউ কেউ পাশ করা ডাক্তারদের কম্পাউন্ডার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। এঁদের অনেকেই অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ সবরকম ওষুধের পাশাপাশি জলপোড়া, তাবিজ-মাদুলিও দিয়ে থাকেন।
২০০৯ সালে এরাজ্যে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বিধানসভায় একটি বিল এনেছিলেন যেখানে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়েদের তিনবছরের নতুন ডিপ্লোমা কোর্স পড়িয়ে ‘ব্যাচেলর অব রুরাল মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি” ডিগ্রী দিয়ে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর প্রস্তাব ছিল। রাজ্য বিধানসভায় বিল পেশের প্রতিবাদে আজকের শাসক দল ওয়াক আউট করেছিল। তারও আগে কেন্দ্রীয় সরকার অনুরূপ একটি বিল আনে লোকসভায়। দুটি বিলেরই শেষতক ঠাঁই হয় আইনসভার ‘সিলেক্ট কমিটি’ নামক ঠান্ডাঘরে। রাজ্যে সেদিনের বিরোধী, আজকের শাসক। সেদিন যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরাই আজ নার্স প্র্যাক্টিসনার্সের কথা বলছেন, অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে জোড়ার কথা বলছেন। নার্স প্র্যাক্টিশনার্স ১৯৬০ সাল থেকে আমেরিকায় চালু আছে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং বেশ কয়েকটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশেও চালু আছে। পশ্চিমবঙ্গে আগেও চালু করার চেষ্টা হয়েছিল। কোর্স-কারিকুলাম সেভাবে সাজিয়ে, তাঁরা কতদূর অব্দি চিকিৎসা দিতে পারবেন সেসব নিয়ম-রীতি-বিধি সমস্ত পাকাপোক্ত ভাবে বেঁধে করলে তা ভালোই। তবে তাঁরা চিকিৎসকের বিকল্প নয় কখনই। অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের প্রশিক্ষণ দেবার উদ্দেশ্য যদি তাদের হাতে রোগীদের ক্ষতি কমানো হয়, তাহলে ভালো কথা। প্রশিক্ষণ দেওয়াই উচিত। নাইজিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি সাব-সাহারান দেশ, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেও এরকম অনেক গবেষণায় দেখা গেছে এধরণের প্রশিক্ষণে ক্ষতির সম্ভাবনা কমে কিছুটা। কিন্তু তাদের গায়ে সরকারী শিলমোহর দেবার অর্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা লাটে তুলে গ্রামের গরীবগুর্বোগুলোকে বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোমের দিকে ঠেলে দেওয়া।
এই মুহূর্তে প্রতি গ্রামে ও শহরে এক হাজার জনসংখ্যা পিছু একজন করে আশাকর্মী রয়েছেন, যাঁরা অন্ততঃপক্ষে মাধ্যমিক পাশ বা ফেল। তাঁদের দফায় দফায় দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এক হাজার জনসংখ্যা পিছু একজন করে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী রয়েছেন, তাঁরাও নানা ভাবে প্রশিক্ষিত। প্রয়োজনে তাঁদের আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। তাঁরা স্বল্প সাম্মানিকে অভূতপূর্ব পরিষেবা দেন নিজ নিজ এলাকায় রাতবিরেতে। তাঁদের দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতি কোন নজর নেই সরকারের। এছাড়াও প্রতি পাঁচ হাজার জনসংখ্যায় একজন করে কমিউনিটি হেলথ নার্স রয়েছেন, যাঁদের দেড় বছর নার্সিং ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, যাঁরা প্রসব অব্দি করাতে পারেন। তাঁরাও খুবই স্বল্প বেতনের স্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মী। আবার অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবকদের প্রায় প্রত্যেকেই পুরুষ, কিন্তু আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, কমিউনিটি হেলথ নার্স – এঁরা সকলেই মহিলা। এইসব মহিলাদের আর্থিক বঞ্চনা দূর করে, আরো ক্ষমতায়িত করে, আরো প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগানোর বদলে এঁদের থেকে কম শিক্ষিত একদল পুরুষ অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবককে সরকারী শিলমোহর দেবার উদ্যোগ পিছিয়ে পড়া পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবেরও প্রতিফলন।
আমাদের দেশে অপ্রচলিত স্বাস্থ্যসেবক একটা বাস্তবতা ঠিকই, কিন্তু এরকম পশ্চাদপদ বাস্তবতা অনেক আছে। তার অর্থ এই নয় যে সেগুলোকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমাদের দেশে ও রাজ্যে বহু গাঁয়ের মোড়ল ইত্যাদি আছে যাঁদের দীর্ঘদিন যাবৎ খাপ-পঞ্চায়েত চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে উকিলের খরচ নেই, দ্রুত বিচার হয়। দেশে বিচারক প্রয়োজনের তুলনায় কম, যেটুকু আছে তা শহরকেন্দ্রিক, লক্ষ লক্ষ মামলা দীর্ঘসূত্রিতায় ঝুলে আছে। গাঁয়ে-গঞ্জে এইসব মোড়লদের গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু খুব ভালো। সময়ে ন্যায়বিচার পাওয়াও তো মানুষের প্রাথমিক অধিকার; তা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্বও বটে। তাহলে কি এবার মোড়লদের ছ’-আট মাসের প্রশিক্ষণের পর অপ্রচলিত বিচারক তকমা দিয়ে কোর্টে নিয়োগ করা হবে? এঁদের উপর র্যান্ডমাইজড্ কন্ট্রোলড্ ট্রায়াল চালিয়ে এটা প্রমাণ করা কঠিন হবে না যে প্রশিক্ষণ পেলে তাদের বিচারের দক্ষতা ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং সেই প্রশিক্ষণের খরচও আইন পাশ করা আইনজ্ঞদের বেতনের তুলনায় সামান্যই হবে।
কিন্তু প্রশ্নটা হল কান্ডজ্ঞানের এবং দৃষ্টিভঙ্গীর।
চমৎকার লেখা।
দারুন লেখা।