–ডাক্তারবাবু আমার কিন্তু দুটো প্রেসক্রিপশন লাগবে।
এ রকম অদ্ভুত দাবি শুনে অনিমেষ চোখ তুলে তাকালো।
ছেলেটি সাধারণ কিন্তু সপ্রতিভ। সুঠাম স্বাস্থ্য কিন্তু কোথায় একটা আকুলতা।
অনন্যা একটু মাথা নিচু করে বসে।
আপনাকে খুলেই বলি,–জয়ন্ত মুখ খুলল। অনন্যার একটা আগের জীবন ছিল এবং একটি ফুটফুটে বাচ্চাও আছে।
‘বাচ্চা টা নর্মাল ডেলিভারি না সিজার ‘—-অনিমেষের চিকিৎসক সুলভ প্রশ্ন।
ওটা নর্মাল ছিল, কিন্তু এটা আপনার প্রেসক্রিপশনে লেখা চলবে না। ওর এটা ফার্স্ট প্রেগনেন্সি বলেই লিখতে হবে।
–এ আবার হয় নাকি? আমাদের পুরনো হিস্ট্রি তো রাখতেই হবে।
–ঐ জন্যেই তো বলছিলাম ডাক্তারবাবু, আমার দুটো প্রেসক্রিপশন লাগবে, একটা আপনার আর একটা আমার।
এবার অনন্যা মুখ তুলে তাকালো। আসলে আমার ছেলের যখন মাত্র দু-বছর বয়স তখন একটা ট্রাক ওর বাবাকে ছিনিয়ে নেয়। অসহায় সেই অবস্থায় জয়ন্তদা পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার আর আবেশের সব দায়িত্ব নেয়। পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে আবেশকে ভর্তি করে আমার মুখোমুখি হয়েছিল। একান্ত স্বার্থপরের মতো আমিও ওকে হারাতে চাই নি।
জয়ন্ত যে কোনো দিন বিয়ে করবে মধুমিতা ভাবে নি। কতবার বিয়ের কথা বললেই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে, ধ্যুস্ আমাকে বাদ দাও।
দুই মেয়ে মারা যাবার পর এই ছেলে। সুপ্রতিম কোলে নিয়ে বলেছিল, এই হলো আমাদের বংশের উত্তরাধিকার।
কথাটা শুনলেই জয়ন্ত হাসে, তা তিনি তো বাপু উত্তরাধিকারকে তোমার কোলে ফেলে কেটে পড়লেন।
সত্যি সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও মধুমিতার চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। এ পাড়ায় তখন এলাকা দখলের রাজনৈতিক লড়াই। গুলি বোমা মুড়ি মিছরির সমতুল। সে রকমই এক সন্ধ্যায় কয়েকটি ছেলে খবর দিল অফিস ফেরতা সুপ্রতিম বোমায় আহত হয়ে হাসপাতালে।
চিরকালের অরাজনৈতিক সুপ্রতিম মিডিয়ার কল্যাণে এক বিতর্কিত নেতা হয়ে উঠল। মিডিয়ার আনাগোনা, টি ভি র ঘন্টা খানেক পেরিয়ে এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর ফোনালাপের পরেও সব প্রলোভন ছেড়ে বাংলার সীমান্তবর্তী এক স্কুলে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে এক চাকরি ও জয়ন্ত– এই নিয়েই এক নতুন সংগ্রামের শুরু।
দিন কেটে যায়। জয়ন্ত এখন নিজেও শিক্ষিত এক সজ্জন মানুষ। চাকরি স্থলেও প্রতিষ্ঠিত।
এখন তো মধুমিতার মনে আনন্দের ঝড়। অনন্যার গর্ভে ওদের উত্তরাধিকার।
–ডাক্তারবাবু ওর একটা ভালো করে ডায়েট চার্ট করে দিন তো। মেয়েটা কিছুই খেতে চায় না।
আজ মধুমিতা অনন্যাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে এসেছে।
ওর হাতে অনিমেষেরই দেওয়া –জয়ন্তর ভাষায় দু-নম্বর প্রেসক্রিপশন। অনন্যা প্রথম গর্ভবতী।ডাক্তারিভাষায় প্রাইমি- গ্রাভিডা।
জয়ন্তকে অনিমেষ বারবার বলেছিল, এ কথা লুকিয়ে রেখো না। বলে দাও মাকে।
ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল অনন্যা,–আর একটু সময় দিন ডাক্তারকাকু। ঠিক বলব। আসলে জয়ন্তর বাবা মারা যাবার পর ওঁর একাকী সংগ্রামের কথা যখন শুনি তখন ভেতরে কুঁকড়ে যাই।
অনিমেষ জানে স্নেহ ভালবাসা বিষম বস্তু। পেয়ে হারাতে কে চায়?
আজ অনন্যার ছুটি। চারদিন আগে নার্সিং হোমে একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে অনন্যা। আর গতকাল অনন্যা অনিমেষের দুটো হাত ধরে অনুনয় করেছে, কাকু, আমি আর পারছি না। আপনি মা-মণিকে জানিয়ে দিন।
জয়ন্তর চোখেও একই মিনতি।
তাই আজ অনিমেষ চেম্বারে বসে আছে মধুমিতার আসার অপেক্ষায়।এ সি টা একটু জোরেই চলছে।
এক বাক্স কাজু-বরফি হাতে মধুমিতা চেম্বারে ঢুকছে, আর কতো দেরি ছুটি হতে।
— বসুন ম্যাডাম, কিছু কথা আছে।
আগে বলুন অনন্যা ঠিক আছে তো!–উৎকন্ঠিত স্বর।
–না না,ও ঠিক আছে। একটা বিষয় আমি আপনার কাছে গোপন রেখেছিলাম,আজ জানিয়ে দিতে চাই।
–এটা কিন্তু ঠিক করেন নি। অনন্যা যে প্রথমবার প্রেগনেন্ট নয়, আপনার জানানো উচিত ছিল।
হতবাক অনিমেষ,আপনি জানেন?
ডাক্তারবাবু, আপনারা ডাক্তার ঠিক আছে। কিন্তু আমরাও তো ‘মা’ হয়েছি। অনন্যার দেখভাল তো আমিই করতাম, তাই প্রথম পোয়াতির লক্ষণগুলো ওর শরীরে আগে থেকেই দেখে আমি একটু চমকে উঠেছিলাম।
তাছাড়া পিতৃহারা সন্তানকে দূরে রাখার যন্ত্রণা মা আড়াল করতে পারে না।
–ডাক্তারবাবু পেমেন্ট কমপ্লিট। এবার নিয়ে যাই।–জয়ন্ত ঘরে ঢুকেছে।
হ্যাঁ,যাবো, তার আগে ওর দাদাকে নিয়ে আয়। দাদা ছাড়া বোন ঘরে ঢুকবে না।–মধুমিতার নিদান।
অবাক চোখে জয়ন্ত একবার অনিমেষ আর একবার ওর মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।
–চটপট কর বাবা। আমি কিন্তু বাড়ি গিয়ে সব গুছিয়ে রাখছি।
মধুমিতার গায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে আবেশ শুয়ে গল্প শুনছে। আর এক পাশে ঘুমন্ত বোন।
–আচ্ছা রাঙাদিদু, আমি তাহলে তোমার কে হলাম?
মধুমিতা আবেশকে আরো কাছে জড়িয়ে ধরল,–তুমি, তুমি হলে আমার উত্তরাধিকার।