পূর্বপ্রকাশিতের পর
নবজাত সোভিয়েত রাষ্ট্র
১৯১৭-র নভেম্বর মাসে ক্ষমতা দখলের কয়েকদিনের মধ্যে তৈরি হল নতুন “কম্প্রেহেন্সিভ স্যানিটারি লেজিসলেশন”। এখানে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হল – বাণিজ্যিক এবং শিল্পাঞ্চলের উদ্যোগগুলোতে ও নাগরিকের বাসস্থানে পরিচ্ছন্ন পেয় জলের ব্যবস্থা, স্যানিটারি পর্যবেক্ষণ, জাতীয় স্তরে নতুন খালের খনন করবে সরকার। সালমন কেশভজি ব্লাইন্ড স্পটঃ হাউ নিওলিবারালিজম ইনফিল্ট্রেটেড গ্লোবাল হেলথ-এ জানাচ্ছেন – “বলশেভিকদের স্বাক্ষরিত অন্যতম প্রথম ডিক্রি ‘কম্প্রেহেন্সিভ স্যানিটারি লেজিসলেশন’-এ শিল্পাঞ্চল এবং বাসস্থানে পরিচ্ছন্ন জল ও ময়লা পরিষ্কারের কথা বলা হয়েছিল।” (পৃঃ ২৮)
বিপ্লবের পরে ১৯১৭ সালেই তৈরি হল “অল-রাশিয়া কংগ্রেস অফ নার্সেস ইউনিয়ন”। ১৯১৮ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে এর শাখার সংখ্যা হল ৫৬, সদস্য সংখ্যা ১৮,০০০। ১৯১৮ সালে জন্ম নিলো “কমিশারিয়েট অফ পাব্লিক হেলথ”। নিকোলাই আলেক্সান্দ্রোভিচ সেমাশকো এক বৈপ্লবিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রথম পিপল’স কমিশার অফ পাব্লিক হেলথ, অর্থাৎ, রাশিয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রধান ব্যক্তি নির্বাচিত হলেন। উল্লেখযোগ্য হল, এ সময়ে বলশেভিক রাশিয়ার নাম ছিল রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডেরেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিক। ১৯২২ সালে জন্ম নেয় USSR। একটি কেন্দ্রীভূত, জনমুখী, সমস্ত স্তরের জনতার জন্য ফ্রি, নিজস্ব খরচ-বিহীন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা জন্ম নিলো। কেন কেন্দ্রীভুত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল? সেমাশকো তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন – “আমাদের সবকিছুই আক্ষরিক অর্থে শূণ্য থেকে গড়ে তুলতে হয়েছে। এখন আমাদের ৩৯৭,৪৯৬টি বেড রয়েছে রোগীদের জন্য এবং ২৩২টি পরিপূর্ণভাবে সুসজ্জিত ট্রেন আছে। আমরা স্নানের ট্রেন, লন্ড্রি ট্রেন, হাসপাতাল ট্রেন চালু করেছি যা ইউরোপের যেকোন মিলিটারি সংগঠনগুলো করতে পারলে গর্বিত হবে। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সুসংগঠিত প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত এবং কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব।”
ত্রিমুখী আক্রমণে নবজাত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়েছিল। ১৯১৮-২০ পর্যন্ত চললো গৃহযুদ্ধ, এর সাথে শুরু হল মহামারি এবং দুর্ভিক্ষ ১৯১৮-২২ অবধি। এস জি হোয়েটক্রফট তাঁর গবেষণাপত্র “ফেমিন অ্যান্ড এপিডেমিক ক্রাইসিস ইন রাশিয়া, ১৯১৮-১৯২ঃ দ্য কেস অফ সারাতোভ” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন – দুর্ভিক্ষ এবং রোগের ফলে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ এই তিন বছরে প্রায় ৪০ লক্ষ অসামরিক বা সাধারণ মানুষ মারা যায়। আবার ১৯২১-এর শেষ তিন মাস থেকে ১৯২২-এর প্রথম ৬ মাসে দেশজুড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ।
১৯১৭-১৯২২ পর্যন্ত পরিস্থিতির ভয়াবহতা গভীরভাবে আরও ভালো করে অনুভব করা যায় চিকিৎসক উইলিয়াম ন্যাটের ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ কিস্তিতে প্রকাশিত “এ রিভিউ অফ মেডিক্যাল এডুকেশন ইন সোভিয়েত রাশিয়া” এবং “এ মেডিক্যাল রিভিউ অফ সোভিয়েত রাশিয়া” শীর্ষক প্রবন্ধগুলিতে। আভ্যন্তরীন সংকটে পর্যুদস্ত নবজাত সোভিয়েত রাশিয়ায় এমন অবস্থা ছিল যে নামী চিকিৎসক-অধ্যাপকেরা বেলচা হাতে বরফ পরিষ্কার করেছেন, দৈনিক ১/৪-১ পাউন্ড কালো রুটি, আলু এবং হেরিং মাছের জন্য লাইন দিয়েছেন, এবং দ্রুতপদে হেঁটে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আরেকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেছেন রোগী দেখার জন্য। এমনকি নোবেলজয়ী (১৯০৪) বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী পাভলভও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ন্যাট লিখছেন – “১৯২৫-এর সেপ্টেম্বর অব্দিও গবেষকেরা তাদের নিজেদের মাস মাইনের অর্ধাংশ দিয়ে ল্যাবরেটরির কাগজপত্র কিনছেন। এবং অনেক অধ্যাপক তাঁদের মাইনের একাংশ দিয়ে ল্যাবরেটরিকে সচল রেখেছেন।” পাভলভ তাঁর “কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স” নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী বইয়ের প্রতি ৮,০০০ শব্দের জন্য ২৫ রুবল করে পেতেন।
এরকম এক অসম্ভব প্রতিকূল, শক্ত এবং অভাবিতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বা কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করেছিল একের পরে এক মানুষ-কেন্দ্রিক কর্মসূচী। তার মধ্যে প্রধান কর্মসূচী ছিল জনস্বাস্থ্যকে ঘিরে। এই দুই কর্মসূচীর ভরকেন্দ্রে ছিল রুশ ভূখণ্ডের সমস্ত স্তরের, জাতের (রাশিয়াতে সেসময়ে ১৭৫টি জাতিসত্তা ছিল), এবং ধর্মের মানুষের অসীম গুরুত্ব। এবং অবশ্যই অগ্রাধিকার ছিল শ্রমিক এবং যারা কারখানায় বা জমিতে শ্রম দিয়ে দেশের জন্য সম্পদ তৈরি করছে, দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে সেরকম সমস্ত মানুষের। এদের তৈরি সম্পদ ব্যয় করা হয়েছে এদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে। রাষ্ট্র নিজে এ দায়িত্ব নিয়েছে শুধু নয়, একে প্রসারিত করেছে।
১৯২০ সালে শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম “রেস্ট হোম” তৈরি হল। এরপরে ১৯২৫ সালে ইয়াল্টায় কৃষকদের জন্য তৈরি হল “রেস্ট হোম”। এ সুযোগ-সুবিধে পৃথিবীর অন্য কোন দেশে তখন একটি অকল্পনীয় ভাবনা ছিল, কারণ অন্য সমস্ত দেশেই এদের শ্রম আত্মসাৎ করে ব্যক্তিগত মুনাফা এবং সম্পদের পাহাড় তৈরি হয়। কিন্তু রাশিয়ার যাত্রাবিন্দুই ছিল এদের শ্রমকে অর্গলমুক্ত করে দেশের মানুষের মাঝে সুষম বন্টন করা এবং সার্বিক শ্রীবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো। সিজারিস্ট তাঁর মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৪৭) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন – “রুশ বিপ্লবের নির্দিষ্ট সাফল্যতে – প্রায়শই যে অনস্বীকার্যকে অস্বীকার করা হয় – বহু দেশের শাসকশ্রেণীকে এতদূর ভীত হয়েছিল যে তারা সমাজতন্ত্রকে ঠেকানোর জন্য ফ্যাসিবাদকে গ্রহণ করেছিল। ইতিহাস এই কঠোর যুক্তিকে অনুসরণ করেছ।” (পৃঃ viii, নজরটান লেখকের)
ভ্লাদিভস্টক এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যে একটি অ্যান্টি-টাইফাস ট্রেন চালানো শুরু হল। এই ট্রেনে ৩৫০ জন রোগীকে রেখে চিকিৎসা করা যেত। ৩৫ বগির এই ট্রেনে স্নান করার, জামা-কাপড় ছাড়ার, অপারেশনের যন্ত্রপাতি এবং গায়ের জামা-কাপড় স্টেরিলাইজ করার বন্দোবস্ত ছিলো, ফুটন্ত জলের ব্যবস্থা ছিলো, একটি ট্যাংকার, ক্ষৌরকারদের জন্য আলাদা বগি সমেত ডাক্তার, বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসাকর্মী এবং সহায়ক কর্মীদের থাকার সমস্ত ব্যবস্থাও ছিলো। মনে রাখতে হবে এ সময়টি ছিল তীব্র, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারির এক মরণ-বাঁচন অধ্যায়। কিন্তু এরকম ট্রেনেও সংক্রমণে ৯০ জনের মধ্যে ৪০ জন অব্দি মারা গিয়েছে। সামান্য সাবান, গ্লাভস, মাইক্রোস্কোপ, জীবানুনাশক, কম্বল বা বিছানার চাদরের সরবরহারও সবসময় ছিলনা। একটি বিছানায় ৩ জন রোগীও থাকতে বাধ্য হত।
১৯১৯-এর জুনে লেনিন একটি ডিক্রি সই করলেন। এই ডিক্রিতে বাচ্চাদের খাওয়ানোর আলাদা ব্যবস্থা করা হল। শিশুদের খাবার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল, বয়ঃসীমা ১৬ বছর পর্যন্ত। ১৯১৮-১৯২২ সাল ছিল “ভয়াবহ ক্ষুধার বছর”। দৈনিক ক্যালরির পরিমাণ ১৪০০ ক্যালরির নীচে চলে যায়। ১৯২১ সালে “নিউ ইকনোমিক পলিসি” গ্রহণ করার পরে কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
পূর্বোল্লেখিত ভ্লাদিমির রেশেৎনিকভ-এর “দ্য হিস্টরি অফ পাব্লিক হেলথকেয়ার ইন রাশিয়া” প্রবন্ধে বলা হল – “জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বলশেভিকদের নিষ্ঠা দেখে ডাক্তার এবং নার্সেরাও পিপল’স হেলথকেয়ার কমিশারিয়েট-এর সমর্থনে এগিয়ে এলেন। ১৯১৮ থেকে ১৯২২-এর মধ্যে ১৬টি মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি খোলা হল এবং উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা ফ্রি এবং উন্মুক্ত হল RSFSR-এর সমস্ত রুশ নাগরিকের জন্য। সমস্ত মেডিক্যাল পেশাজীবীরা বাধ্যতামূলক সার্ভিস দেওয়া শুরু করলেন ১৯১৮ থেকে। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ৮ম কংগ্রেসে (১৮-২৩ মার্চ, ১৯১৯) সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য এবং বিকশিত হবার স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করলো। নতুন যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থা জন্ম নিলো সেগুলো এরকম – আশু চিকিৎসা এবং প্রিভেনশনের জন্য বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কেন্দ্র, শিশুদের খাওয়ানোর কেন্দ্র, ডে নার্সারি, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অরগানাইজেশন, চাইল্ড হেলথকেয়ার অরগানাইজেশন, জনস্বাস্থ্যের শিক্ষার জন্য আলাদা বিশেষ কেন্দ্র।” জনস্বাস্থ্যের বোধ এবং শিক্ষার বিকাশের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেওয়া, লিফলেট বিলি করা, রেডিওতে প্রচার করা এবং সিনেমা দেখানো – যাবতীয় পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে।
এসময়ে মেডিক্যাল শিক্ষাক্রম ছিল – প্রথম দু’বছরে শিখবে কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি, অ্যানাটমি, হিস্টোলজি, ফিজিওলজি এবং ফিজিওলকিক্যাল কেমিস্ট্রি (ল্যাবরেটরি এবং প্র্যাক্টিক্যাল সহ)। ৪র্থ এবং ৫ম বছরে ক্লিনিক্যাল শিক্ষা অর্জন করবে। ১৯১৭-১৯২০ পর্যন্ত গবেষক-অধ্যাপক-শিক্ষকদের কোন মাইনে দেওয়া যায়নি, বাসস্থান এবং রেশন ছাড়া। ১৯২১ থেকে স্বল্প মাইনে (সেসময়ের হিসেবে মাসে ৩ পাউন্ডের কিছু বেশি) দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু নতুন দুনিয়া গড়ার জন্য গবেষক-অধ্যাপক-শিক্ষকেরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে গেছেন।
কেন্দ্রীভূত কিন্তু জনসমাজের গভীর পর্যন্ত প্রসারিত জনস্বাস্থ্যের এবং স্বাস্থ্যের উদ্যোগের ভরকেন্দ্র করা হল ‘ডিসট্রিক্ট প্রিন্সিপ্লস”-কে। বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্টে ভাগ করা হল সমগ্র পরিচালনার বিষয়টিকে। এই সমগ্র উদ্যোগের ফলে রাশিয়ার প্রিভেন্টিভ স্ট্র্যাটেজি এবং স্যানিটারি পদক্ষেপ যে আলোড়ন তৈরি করেছিল তা কিছু বিশেষজ্ঞের চোখ এড়ায়নি। জার্মানির অস্কার ভোগট এবং লিপম্যান ১৯২৪-এ স্বচক্ষে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল দেখেছিলেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে একটি সুবৃহৎ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৮ সালে মস্কোতে “ব্রেইন ইন্সটিটিউট” তৈরিতেও তিনি সাহায্য করেন।
পূর্বোক্ত রেড মেডিসিন-এ বলা হল – “সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম দেশ যে একটি সম্পূর্ণ সংগঠন গঠন করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। এই সংগঠনের ডিজাইন হল রাশিয়ার ভূখন্ডে বাস করা প্রতিটি মানুষ, নারী এবং শিশুকে একইসাথে প্রিভেন্টিভ এবং কিউরেটিভ সুরক্ষা পৌঁছে দেওয়া।” (পৃঃ vii) এঁদের পর্যবেক্ষণে – “১৯৩১ সালের মধ্যে দরিদ্রতর জনসমষ্টির জন্য রাশিয়ায় ৭২৪,০০০ বেড তৈরি হয়েছিল সেরে ওঠার কেন্দ্র এবং স্যানাটরিয়ামগুলোতে।” এঁদের চোখে ধরা পড়েছিল – পুঁজিবাদী দেশগুলোর এবং রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি মূলগত প্রভেদ হচ্ছে রাশিয়ায় প্রতিটি ডাক্তার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং প্রাইভেট প্র্যাক্টিস রয়েছে যৎসামান্য। (পৃঃ ২১৮) বিপ্লবের আগে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ২৬,০০০। ১৯৩৩ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৬,০০০। এঁরা আমেরিকা এবং রাশিয়ার মেডিক্যাল কেয়ারের একটি প্রতিতুলনা করেছিলেন মোট ১০টি পয়েন্টে। (পৃঃ ২৭১-২৭৫) একমাত্র ডেন্টিস্টদের সংখ্যা আমেরিকায় বেশি এবং দাঁতের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই আমেরিকার ঔকর্ষ খুঁজে পাননি। বরঞ্চ, ব্যক্তিগত মুনাফা-কেন্দ্রিক আমেরিকার যে মেডিক্যাল কেয়ার ব্যবস্থা সেখানে রোগীকে মানুষের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে চিকিৎসা হয় না এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন। এঁদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৭-র আগে রাশিয়াতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ২৬,০০০। ১৯৩১-এ সে সংখ্যা হয় ৭৬,০০০। এঁদের বক্তব্য অনুসারে – “সোভিয়েত মেডিসিনের আরেকটি পথনির্দেশক নীতি হল যে নতুন সার্ভিস বিশেষভাবে প্রযুক্ত হয়েছে সমস্ত শিল্পশ্রমিক এবং কৃষকদের দরিদ্রতম অংশের পরিবারের জন্য।” (পৃঃ ২৬৮, নজরটান মূল লেখায়) ১৯৩১-এর মধ্যে দরিদ্রতর মানুষের জন্য বিভিন্ন “কনভ্যালেসেন্ট হোমস” এবং স্যানাটরিয়ামে ৭২৪,০০০ শয্যার ব্যবস্থা ছিল। (পৃঃ ২৬৯) প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করা চিকিৎসকের সংখ্যা ১০%-এর বেশি ছিলনা। (পৃঃ ২৭০)
এখানে উল্লেখযোগ্য ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এর ইতিহাস। আমার ধারণা অংশত সোশ্যালিস্ট মেডিসিনের প্রভাব, অংশত ইউরোপের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিঘাত, অংশত ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ – এসবের সম্মিলিত যোগফলে এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের জন্ম। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের প্রতিটি বাড়িতে একটি লিফলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। লিফলেটে বলা হয়েছিল –
“আপনার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস শুরু হবে ৫ জুলাই। এটা কি? কিভাবে আপনি পাবেন? এই সার্ভিস আপনাকে সমস্ত মেডিক্যাল, ডেন্টাল, এবং নার্সিং-এর ব্যবস্থা জোগাবে। প্রতিটি মানুষ – দরিদ্র অথবা ধনী, পুরুষ, নারী অথবা শিশু – একে পূর্ণত কিংবা এর যেকোন অংশকে ব্যবহার করতে পারবে। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এর জন্য কোন মূল্য দিতে হবেনা। এর জন্য কোন ইন্সিউরেন্সের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা কোন “দাক্ষিণ্য বা চ্যারিটি” নয়। আপনারা সবাই এর জন্য অর্থ দিচ্ছেন, প্রধানত একজন ট্যাক্সদাতা হিসেবে, এবং অসুস্থতার সময়ে আপনাদের অর্থের জন্য বিপুল উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেবে এই সার্ভিস।” (নজরটান লেখকের)
শেষ কথা
১৯১৭ সালের ১৩ নভেম্বর (রুশ বিপ্লবের ৫ দিন পরে) সোভিয়েত সরকারের জারি করা ডিক্রিতে বলা হয়েছিল – “(১) ব্যতিক্রমহীনভাবে সমস্ত শ্রমদানকারী শ্রমিকের জন্য সোশ্যাল ইন্সিউরেন্স করা হল যার সুযোগ প্রসারিত হবে শহর ও গ্রামের দরিদ্রদের জন্যও, (২) সমস্ত ধরনের অক্ষমতাকে (যেমন অসুস্থতা, আঘাত, পঙ্গু হয়ে পড়া, বার্ধক্য, মাতৃত্বকালীন অবস্থা, বৈধব্য, অনাথ সন্তান এবং কর্মহীনতাকে) এই ইন্সিউরেন্সের আওতায় আনা হল, (৩) ইন্সিউরেন্সের সমস্ত খরচ রাষ্ট্র বা মালিক বহন করবে, (৪) কাজ চলে গেলে কিংবা অক্ষম হয়ে পড়লে সমস্ত ধরনের খরচ রাষ্ট্র বহন করবে, এবং (৫) যার ইন্সিউরেন্স করা হয়েছে তার ইন্সিউরেন্সের ওপরে সমস্ত অধিকার থাকবে। (সিজারিস্ট, সোশ্যালাইজড মেডিসিন ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, পৃঃ ৮৬-১০৪)
উইলিয়াম ন্যাট জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, “এরকম ভয়াবহ এবং আশাহীন বছরগুলোতেও চিকিৎসকেরা নিস্বার্থভাবে মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করে গেছেন।” আমরা বর্তমান ভারতের সাথে একবার মিলিয়ে নিতে পারি। বর্তমান ভারতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আত্মপ্রসাদের বীভৎস রস উপভোগ করার এর চেয়ে ভালো ঊপায় আর কি আছে?
এরপরেও আরও কিছু কথা থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে তৈরি হল লিগ অফ নেশনস। এর অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন নরওয়ের স্বাস্থ্য প্রধান কার্ল ইভাং। তিনি জানাচ্ছেন যে “স্বাস্থ্য” বিষয়টি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ কোন ব্যাপার ছিলনা। ইভাং-এর বয়ানে – “একটি মজার উদাহরণ হল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন কভেন্যান্ট অফ লিগ অফ নেশনস ড্র্যাফট করা হল তখন স্বাস্থ্য ‘ভুলে যাওয়া হয়েছিল’। একেবারে শেষ মুহূর্তে লিগ অফ নেশনস-এর হেলথ সেকশনে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটিকে ঢোকানো হয়।” (কে ইভাং, “পলিটিক্যাল, ন্যাশনাল অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল লিমিটেশনস টু হেলথ কন্ট্রোল”, হেলথ অফ ম্যানকাইন্ড, সং, গর্ডন ওলস্টেনহোম এবং মেভ ও’কনোর, ১৯৬৭, পৃঃ. ২০২)
মনে রাখা দরকার, যে সময়ে পৃথিবীর তাবড় ধনতান্ত্রিক দেশগুলো “স্বাস্থ্য” শব্দটিকে ভুলে যাচ্ছিল সেসময়ে বলশেভিক রাশিয়ায় সবার জন্য, সমস্ত নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যের নতুন মহাযজ্ঞের উদ্বোধন শুধু হয়নি, প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে সবার কাছে স্বাস্থ্যের সুযোগ পৌঁছে দেবার কর্মযজ্ঞ বিপুল গতিতে চলেছে। সিজারিস্ট তাঁর মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ ইন দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্রন্থে বলছেন – “সোভিয়েত মেডিসিনে কোন আপোষ নেই। এর কাঠামো সহজেই বোঝা যায় কারণ এটা বাস্তবোচিত, যুক্তিযুক্ত এবং স্বচ্ছ।” (পৃঃ ২৪) তিনি সোভিয়েত মেডিসিনের চারটি বৈশিষ্ট্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন – (১) মেডিক্যাল সার্ভিস খরচবিহীন, এবং সবার কাছে লভ্য, (২) সমস্ত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কার্যক্রমের কেন্দ্রে রয়েছে “promotion health and prevention of disease”, (৩) কেন্দ্রীয় সংস্থা, স্বাস্থ্যমন্ত্রক (পূর্বতন পিপলস’ কমিশারিয়াট অফ হেলথ) সমস্ত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনা করে, এবং, এর ফলে (৪) অনেক বৃহৎ পরিসরে স্বাস্থ্য নিয়ে পরিকল্পনা করা যায়। (পৃঃ ২৪-২৫)
কিন্তু সেসময়ের পরিস্থিতিতে একান্ত প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীভূত, ক্ষমতাশালী যে স্বাস্থ্যের কাঠামো গড়ে উঠেছিল আশঙ্কা হয় সে কাঠামোর মধ্যেই পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপরিমেয় ক্ষমতাসম্পন্ন আমলাতন্ত্রও গড়ে উঠেছিল, যা শেষ অব্দি মানুষের স্বরকেই হয়তো বহুক্ষেত্রে রুদ্ধ করেছে।
শেষ
Beautiful one sir
অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ নিবন্ধ।একবার পড়ে বোঝা যাবে না।এমন নিবন্ধ মানুষের হীতে সহায়ক হবে বলে আমার ধারনা।
. very nice writing. well done.
keep it up.
সুন্দর প্রবন্ধ!
রাশিয়ার ইতিহাস জানা ছিল না। লক্ষণীয় যে ১৯৪৮ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ” স্বাস্থ্যের ” সংজ্ঞায় জানাচ্ছেন ” state of complete physical, mental, social well-being” | এই “সম্পূর্ণ” এবং “state” এর কনসেপ্ট থেকে স্বাস্থ্য যে “সম্পদ” সেই জায়গায় পৌঁছতে আরো তিন দশক লাগবে। একটা ব্যাপার দেখে ভাল লাগল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য যে একটি “সম্পদ” এই কনসেপ্টটা একটি First principle এর মতন কাজ করেছে!
রাশিয়ার Evolution of Public Health System টা পড়ে ভীষণ সমৃদ্ধ হলাম। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে সব পারে।
This is a must read. Takes some time to go through. Worth the effort
Sotyi re vabtei parchhi na je,swasthyo neao ki sanghatik chakranto..!!!
Duniyatai jano akta pashobik jantro r amra kichhui korte parchhina !!
Tor lekhegulo pore tobu asol sotyita jana jay atai baro prapti,khub valo lekha kintu manus ki vabchhe adou…
শেষ কথাই তো সার কথা।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা জনমুখী করা হবে, না জনগণকে দামী বেসরকারী স্বাস্থ্যবীমা অভিমুখী করা হবে?
ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন।
বড় যত্ন করে লিখেছেন। ধন্যবাদ।
সুন্দর উপস্থাপনা
লেখাটাতে (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব মিলে) যে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং সমাধানের সুলুক সন্ধান দেবার চেষ্টা হয়েছে, তা ‘নভেল’। কিন্তু এ নিয়ে ভাবার বা সত্যি কিছু করে ওঠাতে ‘নেতৃত্ব’কে বাধ্য করার মতো স্বরই যে তৈরী হয় না।দুঃখজনক, খুবই স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী এই গভীর ভাবনায় ভাবিত!
যথাযথ
Somoyopojogi lekha. Khub sundor.