বিটোফেন তাঁর সেরা কীর্তি নবম সিম্ফনি রচনা করে ফেললেন। এক ঘণ্টার মাস্টারপিসে অর্কেস্ট্রা রইল, কোরাস রইল। এমনকী একক সঙ্গীতও। আর এই সবের স্রষ্টা তখন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ বধির। শান্তিনিকেতন কলাভবনের দেওয়ালে ম্যুরালগুলো দেখে কি আদৌ মনে হয় যে এই অসামান্য শিল্পকর্মের অনেকটাই বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরে করেছিলেন। এরপরও কি শ্রবণ বা দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষদের সৃজনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়? ওনাদের বিশেষ ভাবে সক্ষম বলা যায় না। ওনাদের সক্ষমতা ছিল অতি বিশেষ পর্যায়ে।
এবার সামান্য একটু পুরাকথা। বিগ্রহের হাত নেই পা নেই। গ্রীবাদেশও নেই। তবু প্রভু জগনাথকে আমরা দেবজ্ঞানে পূজা করি। অষ্টবক্র মুনির শরীরে আটখানি অঙ্গবিকৃতি। তবু আমরা তাঁকে সর্বাধিক জ্ঞানী বলে শ্রদ্ধা করতে দ্বিধা করি না। খর্বাকৃতি বামনকেও বিষ্ণুর অবতার বলে মেনে নি। অথচ বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটুক? নিষ্ঠুরতার রূপ বদলালেও সামাজিক বৈষম্যের ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। ভিন্নদর্শন বা ভিন্নচরিত্রের মানুষদের নিয়ে ব্যাঙ্গবিদ্রূপ এখনও অব্যাহত। এমনকি অঙ্গবৈকল্যের কারণে সদ্যজাত শিশু পরিত্যাগের খবর আজও শোনা যায়। সমস্যাটা যে শুধু কয়েকটি রাজ্যে বা আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ তা নয়। কিছু উন্নত দেশ বাদ দিলে এই চিত্র প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশেই অভিন্ন। ৩রা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এবার ভাবার সময় এসেছে এই বন্ধুদের জন্য আমাদের সমাজকে আরো সুন্দর করে তোলা যায় কী না।
ইদানীং কালে আমরা ডিফারেন্টলি এবল বা বিশেষ ভাবে সক্ষম ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে শিখেছি। আশা রাখবো রাষ্ট্রপুঞ্জও এই বিশেষ দিনটির নামকরণে আরও গ্রহণযোগ্য শব্দ ব্যবহার করতে উদ্যোগ নেবেন। সক্ষমতার মাপকাঠিই যেখানে অনির্দিষ্ট সেখানে কারো গায়ে কি সহজে প্রতিবন্ধকতার তকমা লাগানো যায়! চুলচেরা সংজ্ঞায়ন বা শ্রেণীবিন্যাসে নাই বা গেলাম। বয়স, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী প্রাত্যহিক জীবনে আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক কাজকর্ম না করতে পারার নামই তো বিশেষ ভাবে সক্ষমতা। সেটা হতে পারে জন্মগত বা পরবর্তীতে রোগের কারণে অথবা দুর্ঘটনাজনিত। এই শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা কখনো দৃশ্যমান কখনো বা অদৃশ্য। এগারো সালের জনগণনার ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায় দেশে এখন তিন কোটি মানুষ বিশেষ ভাবে সক্ষম যার দুই তৃতীয়াংশেরই বসবাস গ্রামাঞ্চলে। মনে রাখতে হবে “উই দ্য পিপল”এর মধ্যে কিন্তু এনারাও পড়েন। আমরা আইন করেছি যথেষ্ট। মুখে তাঁদের কথা বলিও অনেক। বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে পাড়ার জলসায় সুযোগ পেলেই তাঁদের দিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করাই। কিন্তু তাঁদেরকে কি আমরা সত্যিই ভালো রাখতে পেরেছি।
দু’ হাজার পনেরো সালে এই দিনে সূচনা হয়েছিল আক্সেসিবল ইন্ডিয়া প্রজেক্ট বা সুগম্য ভারত অভিযানের। উদ্দেশ্য ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের পরিবহন, বিনোদন, সরকারি অফিস তথা তথ্য প্রযুক্তির যাবতীয় সুবিধা সামগ্রিক ভাবে এঁদের উপযোগী করে তোলা। কিছু কাজ অবশ্যই হয়েছে তবে আমাদের সামনে এখনও দীর্ঘ পথ বাকি। নিচু বাসের দরজা থেকে ভাঁজ হয়ে থাকা র্যাম্প বেরিয়ে আসবে এবং স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ারে বসা আরোহী সটান সেই বাসে উঠে পড়ার দৃশ্য দেখতে এখনও আমাদের বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা সত্যি কথা যে ত্রুটিহীন না হলেও গত কয়েক বছরে আমরা বেশ কিছু রাস্তাতে অন্তত একদিকে ফুটপাথ পেয়েছি। বাসে ট্রেনে আমরা আসন সংরক্ষণও করেছি। কিন্তু যে মানুষটি নিজে হাঁটতেই পারেন না তিনি সংরক্ষিত আসনে পৌঁছবেন কিভাবে সে কথাও তো এবার আমাদের ভাবতে হবে।
বহু শতাব্দী ধরে সমাজ শারীরিক বা মানসিক সমস্যাযুক্ত মানুষদের ভয়ের চোখে দেখেছে। ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে দেখেছে। এই ধারণার পরিবর্তন আসতে সময় লেগেছে অনেক। অনেকের ধারণা খানিকটা হলেও দুটি বিশ্বযুদ্ধ আমদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। তাও প্রশ্ন থেকে যায় আমরা কি যথেষ্ট এগোতে পেরেছি। আমরা কি এনাদের সমানাধিকার দিতে পেরেছি? অথচ সুযোগ পেলে এনারা কত কীই না করতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাকে দৃষ্টান্তমূলক নেতৃত্ব দিয়েছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। স্টিফেন হকিং ছিলেন বিশ্ববন্দিত পদার্থবিদ। দুজনেই বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ। জন্মান্ধ শিল্পী রবীন্দ্র জৈনের সৃষ্ট গান শুনে আমরা মুগ্ধ হই। দুর্ঘটনায় একটি পা হারানো নৃত্যশিল্পী সুধা চন্দ্রনের ভারতনাট্যম দেখে এখনও আমরা গর্বিত হই।
বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো আইনী রক্ষা কবচের কোন অভাব নেই। দেশের সংবিধান এঁদের শিক্ষার অধিকার দিয়েছে। কাজের অধিকার দিয়েছে। প্রয়োজনে যাবতীয় সহায়তা দেবার কথা বলেছে। অধুনাপ্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি এঁদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিকরণে আরও জোর দিয়েছে। বিশেষ ভাবে সক্ষমদের অধিকার সংক্রান্ত পুরনো আইন আমরা দু হাজার ষোল সালে সংশোধন করেছি । শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে আমরা তাঁদের জন্য সংরক্ষণ বাড়িয়েছি। পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে কর্মরত অসরকারি উদ্যোগকে অর্থ সাহায্য দিয়েছি। সরকারি দপ্তর তো বটেই প্রাইভেট কোম্পানিদেরও বলেছি তাঁদের কর্তব্যের কথা। কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে জরিমানার ব্যবস্থাও করেছি। সমাজে সর্বস্তরে তাঁদের একাত্ম করে নিতে আমরা এখন অঙ্গীকারবদ্ধ । তবু দৈনন্দিন জীবনে তার প্রতিফলন এখনও বড়ই সীমিত। অসহায় শিশুরা বিদ্যালয়ে এখনও প্রত্যাখ্যাত হন। উচ্চশিক্ষায় বা কর্মস্থলেও একই ধরনের সমস্যা। সব সময় যে পরিকাঠামো অপ্রতুল তা নয়। সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গিতেও। কারণ হিসেবে বলা হয় বাকি ছাত্রছাত্রী বা অন্য উপভোক্তাদের সম্ভাব্য অসুবিধার কথা। আর এই নেতিবাচক মনোভাবের ফলে ভুক্তভোগীরা চলে যান হতাশার গভীরে। বিস্মৃতির অন্তরালে।
বিপুল সংখ্যক সমস্যা আসলে প্রতিরোধযোগ্য। গর্ভবতী মায়ের যত্ন, শিশুর সঠিক পুষ্টি এবং সময়মতো রোগের চিকিৎসা করলেই হয়। বরিষ্ঠ নাগরিকদের কল্যাণে আরো একটু মনোনিবেশ করলে তাঁদের তথা সমাজের সকলের মঙ্গল। পরিশ্রুত পানীয় জল, সংক্রমণ হ্রাস ইত্যাদি সাধারণ কিছু কাজ করতে পারলেই অনেক দূর এগোন যায়। রাস্তাঘাটে বা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও আরো যত্নশীল হওয়া যায়। ন্যায্যমূল্যে যাঁদের সহায়ক যন্ত্রপাতি পাবার কথা তাঁরাই হয়ে পড়ছেন অসাধু ব্যবসার সহজ লক্ষ্য! তাই সামান্য একটা গাড়ির সীট ঘোরানোর বন্দোবস্ত করতেও সর্বাধিক পনের হাজার টাকা ছাপাই মূল্যের সামগ্রী পঞ্চাশ হাজার টাকায় কিনতে হয়। বরিষ্ঠ নাগরিকবৃন্দও হামেশাই এই হেনস্থার শিকার। জীবনভর সঞ্চিত অর্থ উজাড় করে তাঁরা একটু ভালো থাকতে চাইলেও সব সময় উপায় থাকে না। সেখানেও অন্তরায় পরিকাঠামোগত সমস্যা এবং বিক্রেতাদের সীমাহীন লালসা। সামর্থ্য থাকলেও যে কোন প্রকার বিনোদন যেন তাঁদের কাছে অধরা। কেউ নাটক সিনেমা দেখতে পছন্দ করলেও যেতে পারেন না। কারণ সেই পরিবহন তথা প্রেক্ষাগৃহগুলির অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো।
সহায়ক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে। আমাদেরই মেধাবী সন্তানেরা ইউরোপে আমেরিকায় এমনকি খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতেও অভাবনীয় সাফল্যের সাথে কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই দেশের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। উন্নত মানের সহায়ক সামগ্রী এখনও আমাদের অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সামান্য একটা খাটের গদি যাতে দীর্ঘদিন শুয়ে থাকলেও বেডসোর হবে না সেটাও কেন আমরা নিজেরা প্রস্তুত করে আরও সহজলভ্য করতে পারবো না। আমাদের তৈরি হুইলচেয়ারগুলিরও অনেক উন্নতি সম্ভব। হাত পা সম্পূর্ণ শক্তিহীন হয়ে যাবার পরও কৃত্রিম মেধার প্রয়োগে শুধু চোখের ইশারায় একটা আধুনিক চেয়ার সঠিক রাস্তায় চলতে পারে। উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অকুপেশনাল হেলথ স্পেশালিষ্টরা অসুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে তাঁর মতো করে যাবতীয় সহায়তার ব্যবস্থা করে আসেন। আমরাও সেরকম ভাবে ভাবলে কি খুব উচ্চাশা হবে?
রাষ্ট্রপুঞ্জ এ বছরের থীমে অন্তর্ভুক্তিকরণের কথা বলেছে। আরও ন্যায়নিষ্ঠ পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধকতা আর দারিদ্র্য যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য নয়া জাতীয় খসড়া নীতি এখন চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার পথে। জনসাধারণের মতামত গ্রহণ সদ্য সমাপ্ত হয়েছে। ২০০৬ এর সাথে তুলনা করলে এই নীতিকে অনেক বেশি নাগরিকদের অধিকারকেন্দ্রিক বলে মনে হয়। তাছাড়া সঠিক তথ্য সংগ্রহের উপরেও যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। তবে সমালোচকরা এই নীতিকেও বড় বেশি আদর্শধর্মী মনে করতে পারেন। তাঁদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হবে যদি এই নীতিরও সঠিক প্রয়োগ না হয়।
জনসংখ্যা বাড়ছে। মানুষের গড় আয়ুও বাড়ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে মানুষ অনেক দিন বেঁচে থাকছেন। ফলে অধিকতর সুরক্ষা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধার প্রয়োজনও উত্তরোত্তর বাড়ছে। আমাদের এখন দরকার পরিকাঠামোর আশু উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন নাগরিকদের জন্য চাই যথাযথ ব্যয়বরাদ্দ ও তার সদব্যবহার। সরকারি প্রকল্পের ঘাটতি হয়তো খুব একটা নেই। এখন দরকার তার সুষ্ঠু প্রয়োগ। প্রয়োজনে অসরকারি স্বেছাসেবী সংস্থাদেরও কাজে লাগানো হোক। তবে সবার আগে দরকার আমাদের মানসিকতা বদলের। হিতসাধনের অঙ্গীকার শুধু বিশেষ দিবসে সীমাবদ্ধ না থেকে দৈনন্দিনের বিষয় হোক।
এই প্রবন্ধ ডা কাঞ্চন মুখার্জী ও ডা সুব্রত গোস্বামী দ্বারা রচিত। ঈষৎ সম্পাদিত রূপ ‘এই সময়’ পত্রিকায় উত্তরসম্পাদকীয় হিসেবে ২রা ডিসেম্বর ২০২২-এ প্রকাশিত।