এক অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে আছি আমরা। অন্য সব নেশা এর কাছে নস্যি। নেশার নাম অন্তর্জাল, নেশার নাম আধুনিক মিডিয়া। এই নেশা পান বিড়ি, সিগারেট, মদের থেকে অনেক খারাপ। কারণ আপামর জনসাধারণ একসাথে সেসবের খপ্পরে পড়ে না।
টিভি আর ইন্টারনেট এসেছে গত শতাব্দীর শেষে। কয়েক দশকের মধ্যে এরা ব্যক্তি, সমাজ, সংস্থা- সবার শরীরে, মনে, সংগঠনে, সংস্কৃতিতে, অস্তিত্বে, অর্থনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আপাতঃভাবে মনে হয়- এদের এড়িয়ে থাকা আর কোনোদিন সম্ভব হবে না।
জুলাই মাসের শেষ। তেমনভাবে বৃষ্টি নেই। মাঠে ঘাটে ফসল ফলানোর মত জল নেই। মাটি শুকনো। অচিরেই ধান-চাল, সব্জি-সবকিছুর আকাল হতে পারে। কিন্তু মানুষের তাতে কোনো হেলদোল নেই। মোবাইলে নেট আছে তো! ব্যস, শান্তি। যে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে পায়, সে মোবাইল ফোন কেনে কুড়ি হাজারের!
বছরের পর বছর শিল্পে বিনিয়োগ নেই, শিক্ষিত বেকারের চাকরি নেই, স্বল্পশিক্ষিত-অপ্রশিক্ষিতদের অসংগঠিত ক্ষেত্রেও সেরকম কাজ নেই। কিন্তু তাতে কি? মিম বানিয়ে, সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে- লাইকের জন্যে, মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে বেশ তো চলে যাচ্ছে।
অতিমারীর দু’বছরে স্কুলশিক্ষার সর্বনাশ হয়ে গেছে। অআকখ, এবিসিডি লিখতে ভুলে গেছে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা। কারো কোনো উচ্চবাচ্য আছে? টিভি সিরিয়াল, রিয়েলিটি ঝগড়া আর নেটফ্লিক্স-ওটিটিতে বুঁদ হয়ে আছে শহুরে জনতা।
গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, শেকড়ে বিষ ঢেলে গাছ মেরে দেওয়া হচ্ছে। বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুকুর দিঘি। ভেড়ি আর ইটভাঁটা গিলে ফেলছে আস্ত নদী। আমরা নিশ্চল, নিস্তরঙ্গ। এম.এ, বি এড করা গ্রাম্য যুবক শতচেষ্টাতেও চাকরি না পেয়ে সব্জি বিক্রি করে। বিদেশে স্থিতু হওয়া বাঙালি ব্যবসায়ী দেশে বিনিয়োগ করতে চেয়েও তোলাবাজদের সর্বগ্রাসী ক্ষিদে মেটাতে না পেরে হতাশ হয়ে বিদেশে ফেরত। এসব আমাদের মহাধ্যান ভঙ্গ করে না। আমরা শুধু গ্লাডিয়েটর বা বুল ফাইটিং-এর দর্শকদের মত চিৎকার করি- রক্ত, রক্ত, আরো রক্ত! আমরা সবসময় দেখতে চাই লড়াই। বাইনারি। একের বিপক্ষে আরেক জনের লড়াই। ইষ্টবেঙ্গল না মোহনবাগান? উত্তম না সৌমিত্র? ডাক্তারী না ইঞ্জিনিয়ারিং? ভারত না পাকিস্তান? তৃণমূল না বিজেপি? টালিগঞ্জ না বেলঘরিয়া? আলমারিতে বেশী না কমোডে?
চ্যাটচেটে কেচ্ছা, টাকার বান্ডিল, কলতলার ঝগড়া গলা বাড়িয়ে টিভির পর্দা থেকে গিলি – আর ভাবি ‘ঈশশ্, ওরকম দুটো ফ্ল্যাট তো আমারও হতে পারতো!’ আরো কি কি ভাবি কে জানে! শুধু ভুলে যাই সেই পেনশন বা তা-ও না থাকা সেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা, যাদের সন্তান খালি পেটে সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বাড়ি ফিরে রুক্ষ স্বরে বলে ‘খেয়ে এসেছি। তোমরা খেয়ে নাও।’ অথবা তোলাবাজির চক্করে পড়ে একদিন গুমখুন হয়ে হারিয়ে যায়।
শুরু করেছিলাম যেখানে সেই প্রসঙ্গে ফিরি। ইন্টারনেট, সোস্যাল এবং আনসোস্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ট্রোলিং, ব্লুটুথ, ফেসটাইম ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের খাওয়া ঘুম সব বাতিল। মাঝবয়সিরাও মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ফোনে দেখে, তার পোষ্টে কতগুলো লাইক বা কমেন্ট হল!
আসলে নার্সিসাস আমরা সবাই আত্মপূজা করি। অন্তর্জাল, টিভির পর্দা হল সেই সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেওয়ার খুব ভালো পালক। তাই তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারছে আমাদের জীবনকে। নিজেদের বাস্তব অস্তিত্ব আমরা নিজেরাই জলাঞ্জলি দিচ্ছি।