সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে উন্নত,আরামদায়ক ও গতিময়। বর্তমানে আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে ইন্টারনেট। ১৯৯৫ সালের আগে যে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল এক শতাংশেরও কম, এখন তা বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করেন। কিন্তু সব কিছুরই যেমন ভাল-খারাপ দুই দিক থাকে, তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুফল ও কুফল দুইই আছে। আর এই কুফল হল ইন্টারনেটের নেশা।
পরিসংখ্যান
বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ০.৩ থেকে ৩৮ শতাংশ মানুষ এই নেশায় আক্রান্ত। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতের কিশোরদের মধ্যে ০.৭ শতাংশ এই নেশায় আক্রান্ত। ১৯৯৬ সালে ডা কিম্বারলেই ইয়ং প্রথম এই জাতীয় নেশার বিবরণ দেন ।
কি কি দেখে বোঝা যায় যে কোন ব্যক্তি ইন্টারনেটের নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন?
অন্যান্য নেশার মত ইন্টারনেটের নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিও সারাক্ষণ ইন্টারনেটের চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকেন। ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে তাঁর মন খারাপ, উদ্বিগ্নতা, বিরক্ত ভাব, একঘেয়েমি, ইত্যাদি দেখা যায়।
শুধু তাই নয়, এর সাথে সাথে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়সীমা ক্রমশ বাড়তে থাকে। যেমন– আগে যে ব্যক্তি দিনে ৪ ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, কিছুদিন পরে দেখা গেল যে তিনি রোজ ৬ ঘন্টার কম ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও খুশী হন না।
এই সময় ওই ব্যক্তি চেষ্টা করলেও ইন্টারনেটের নেশা থেকে বিরত থাকতে পারেন না ও ব্যবহারের সময়সীমাও কমাতে পারেন না। ক্রমশ দেখা যায় যে ওই ব্যক্তি আগে যে যে কাজগুলি করতে ভালবাসতেন, এখন সেগুলির থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করাকেই বেশী পছন্দ করেছেন ও কখনো মন খারাপ হলে তা কাটানোর জন্যও ইন্টারনেটই ব্যবহার করছেন।
শুধু যে মানসিক সমস্যা তা নয়, দীর্ঘক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে ঘাড়ে ও মাথায় ব্যথা, পিঠে ও কোমরে ব্যথা, চোখের সমস্যা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা যায়। এইভাবে ওই ব্যক্তি নিজের শারীরিক সমস্যা ভুলে,পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলে ক্রমশ ইন্টারনেটের জালে জড়িয়ে পড়েন।
বিভিন্ন ধরণের ইন্টারনেটের নেশা-
সাইবার গেমিং– ইন্টারনেটে অনেক ধরনের খেলা থাকে। খেলাগুলি একা খেলা যায় অথবা কয়েকজন মিলে খেলা যায়। বাজারে নতুন নতুন খেলা আসার সাথে সাথে এই জাতীয় নেশা বেড়েই চলেছে।
সাইবার সেক্স এডিকসন- এই জাতীয় নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক বা এডাল্ট সাইটে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং অনেক সময় সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
সাইবার রিলেশনশিপ এডিকশন- এই জাতীয় নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামনাসামনি লোকজনের সাথে মিশতে পারেন না। তাই তাঁরা ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসএপ- এই সবের মাধ্যমে লোকজনের সাথে মিশতে চেষ্টা করেন, সবসময় লাইক ও কমেন্টের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এঁরা ক্রমশ বাস্তব দুনিয়া থেকে দূরে সরে গিয়ে ইন্টারনেটের দুনিয়াকেই আসল দুনিয়া ভেবে বসেন।
ইনফরমেশন ওভারলোড –ইন্টারনেট থেকে আমরা অনেক বিষয়ে জানতে পারি। কিন্তু অনেক ব্যক্তি এমনও আছেন যারা বিভিন্ন তথ্য খুঁজতে গিয়ে সহজে থামতে পারেন না এবং তথ্য খোঁজাটাই এদের নেশাতে পরিণত হয়।
সাইবার কন্ড্রিয়া- এই জাতীয় নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেকে অসুস্থ মনে করেন ও সেই অসুস্থতার কারণ ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন। চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে ধারণা না থাকা সত্ত্বেও এই ভাবে এই জাতীয় তথ্য খোঁজার প্রচেষ্টার ফল হয় মারাত্মক– তিনি অহেতুক নিজেকে অনেক রোগের শিকার ভেবে বসেন।
কেন ইন্টারনেটের নেশা হয়?
আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা নিউক্লিয়াস একামবেন্স নামক এক জায়গায় ডোপামিন নামক একটি রাসায়নিকের বৃদ্ধি আমাদের ভাললাগাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের পছন্দের খাবার খেলে যেমন ওই জায়গায় ডোপামিন বাড়ে, তেমনি নেশা করলেও ওই বিশেষ জায়গায় ডোপামিন বাড়ে। কিন্তু নেশা করার পরে ওই জায়গায় ডোপামিনের পরিমাণ অল্প সময়ে অনেকখানি বাড়ে। তাই খাবার খাওয়ার থেকে নেশা করা অনেক বেশী আনন্দ-দায়ক হয় এবং ঐ আনন্দ লাভের আশায় আমরা নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ি। মদ,গাঁজা,আফিম, সিগারেটের মত ইন্টারনেটের নেশাতেও একই ঘটনা ঘটে।
অনেকে আবার নিজের মন খারাপ,উদ্বিগ্নতা কাটানোর জন্য নেশাতে জড়িয়ে পড়েন এবং সেখান থেকে আর বেরোতে পারেন না।
কিছু মানুষ সামাজিক ভাবে মিশতে পারেন না বা ভয় পান। কারণ তাঁরা নিজেদেরকে দুর্বল মনে করেন। এই জাতীয় ব্যক্তিরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের চিন্তা ভাবনা প্রকাশের চেষ্টা করেন এবং এদের মধ্যে ইন্টারনেটের নেশায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশী।
অনেক সময় দেখা যায় যে সমস্ত ব্যক্তির মন খারাপ, উদ্বিগ্নতা, এটেনসন ডেফিসিট হাইপার কাইনেটিক ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি সমস্যা আছে,তাঁরা সহজেই এই নেশার শিকার হন।
প্রতিকার ও চিকিৎসা-
ইন্টারনেটের নেশা দেখা দেওয়ার প্রথম দিকে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিলে সহজেই এই নেশার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
- শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বাবা -মা কে নজর রাখতে হবে। তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিতে হবে, সময়ের সঠিক ব্যবহার শেখাতে হবে এবং আউটডোর গেমসগুলির প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়াতে হবে।
- খেয়াল রাখতে হবে শিশু যাতে তার বন্ধুবান্ধবের সাথে সঠিক ভাবে মিশতে পারে।
- সমস্যা জটিল মনে হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- অনেক সময় ইন্টারনেটের নেশার পিছনে থাকে অন্য মানসিক রোগ। তাই এই সব মানসিক রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা হলে এই নেশাও কমে যায়।
- কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ধরণের কাউন্সেলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমন-টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিল, বিহেভিয়ার থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি, সোশ্যাল স্কিল ট্রেইনিং, মাইন্ড ফুলনেস বেসড থেরাপি, ইত্যাদি।
- অনেক সময় সমস্যা বেড়ে গেলে এন্টি ডিপ্রেসেন্ট, এন্টি আংজাইটি, এন্টিসাইকোটিক, ইত্যাদি গোত্রের ওষুধের প্রয়োজন হয়।
??
Khubi sundor daktarbabu. Khub upokrito holam