কী এক অনিবার্য তাড়নায় আমি ঈশ্বরচর্চা করছি। যেন ঋণশোধ। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে পড়ে চলেছি। এমন মানুষ কি সম্ভব? বিশেষ আমাদের এই পোড়া, অমেরুদন্ডী দেশে? হয়তো আমার সারা জীবনের পড়াশোনা, অধার্মিক যাপন সবটাই সজ্ঞানে, অজ্ঞানে ঈশ্বরের অক্ষম অনুসরণ। আগে নর্ম্যান বেথুন, চে গ্যেভারা লিখেছি, হঠাৎ একটা অপরাধবোধ এলো, আমার এক আপনার জন, এক সর্বত্যাগী যোদ্ধা বাদ পড়ে গেলো!
আমি সচেতনে ঈশ্বরচন্দ্র নামটা উচ্চারণ করলে শতকরা আশি ভাগ মানুষ মুগ্ধের (মূঢ়ের) মতো তাকিয়ে থাকে। বিদ্যাসাগর নামটি কিন্তু সবাই বিলক্ষণ চেনে! ব্যক্তি ঈশ্বর বলতে খেঁটো ধুতি, উড়ানি স্কন্ধে এক উপবীতধারী ব্রাহ্মণের কথা মনে পড়ে। ঈশ্বর নিজস্ব যাপনে কতোটুকু ধার্মিক ছিলো? নাকি সবটাই ভেকধারী সন্ন্যাসীদের মতো মেকি?
কলেজে অধ্যয়নকালে ডিরোজিয়ানদের লোকাচার ভাঙার তীব্রতায় সমগ্র ভদ্রসমাজ ডিরোজিয়ানদের বিরোধিতা করে। সুতরাং যুক্তিবাদী ঈশ্বর লোকাচারের বিরোধিতা মেঘনাদের মতো লোকাচারের বেশের অন্তরালে থেকেই করেন। উপবীত ত্যাগ না করা তারই অংশমাত্র। ঈশ্বর যে সন্ধ্যাহ্নিক করতো না, সেটা বহু লেখকের লেখায় পাওয়া যায়। ঈশ্বর চিঠির ওপরে ‘শ্রীহরি শরণম’ লিখতেন; সম্ভব এটিও লোকাচার রক্ষা মাত্র। ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোষের বাড়িতে বসে একটা চিঠি লিখছিলো।লেখার পর চন্দ্রমোহন বাবু সেটা দেখতে চাইলে, ঈশ্বর হাস্যপূর্বক বলে “তুমি যা ভাবছো তা নয়; এই দ্যাখো চিঠির ওপর শ্রীহরি সহায় লিখেছি (রসসাগর বিদ্যাসাগর, শঙ্করীপ্রসাদ বসু)। পুত্রদিগের উপনয়নও দেয় নি। এ বিষয়ে জীবনীকার বিহারীলাল সরকার ক্ষেদোক্তিও করেন। ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন যদিও বলেন উপনয়ন হয়েছিল; ইন্দ্রমিত্র সেই মত অগ্রাহ্য করেন। কেন না শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন কোনও বিশেষ স্থান বা তারিখ উল্লেখে ব্যর্থ। অন্য কারও লেখায় এরূপ উল্লেখমাত্র নাই।
প্রসঙ্গ উপবীত:- রামতনু লাহিড়ী একবার রাঁধুনি বামুনের খোঁজে ঈশ্বরের কাছে এসেছেন।
ঈশ্বর:-কেন হে, তোমার আবার বামুনের দরকার কি? বাবুর্চি, খানসামা হলেই তো চলে
রামতনু:- হাঁ তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে বাড়ির ভেতরে যে বামুন ছাড়া চলবে না
ঈশ্বর:- (হেসে) বাপের কথায় পৈতেগাছ (পৈতেগাছা)টি রাখতে পারলে না। এখন পরিবারের কথায় বামুন খুঁজতে বেরোলে! (শঙ্করীপ্রসাদ বসু)। অর্থাৎ বুদ্ধিমান পাঠক পাঠিকা আপনারা ঈঙ্গিত বুঝে নিন।
ঈশ্বরের উক্তি-“আমার মত আমি কাউকে বলি না। তবে এই কথা বলি গঙ্গাস্নানে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন, শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন, তাহলে তাই আপনার ধর্ম।”
সংস্কৃত কলেজ থেকে ধর্মমূলক বহু পাঠ্যবিষয় ও বাদ দেয়। তবে বেদান্ত বাদ দিতে পারেনি, এই আক্ষেপ বহন করেছে।
একটা গল্প না বলে পারছি না। চন্দননগরের উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পন্ডিত বিমাতার অত্যাচারে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।
……
ঈশ্বর:-তা স্ত্রীটি কেমন? সতীত্ব আছে তো? শিশুসন্তান দুটি তোমার ঔরসজাত তো, না অন্য কারও?
দ্বিতীয় শিক্ষক জানান, তিনি অতি সাধ্বী এবং শিশুরা নিজেরই ঔরসজাত।
ঈশ্বর (কঠোরভাবে):- “তাহলে ওই সাধ্বী অনুরক্তা স্ত্রী কী এমন অপরাধ করেছেন যে, সংসারত্যাগ করে তাকে শাস্তি দেবে?…..দুঃখ তাপ আছেই।সংসারে এসেছো, কর্তব্য করে যেতে হবে।….অমন যে বিমাতা, তাঁর প্রতিও কর্তব্য আছে….”(শঙ্করীপ্রসাদ বসু)।
“চেঙ্গিস খাঁ একলক্ষ মানুষের মুন্ডচ্ছেদন করেছিল (আরও উদাহরণ সহযোগে) কই ঈশ্বর তো নিবারণ করলেন না।…তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার তো কোনও উপকার হলো না।”
এই প্রবন্ধ জোর করে শেষ না করলে শেষ হবে না। পাঠিকারা অধৈর্য হবেন। একজন ইতঃপূর্বে জানিয়েছেন যে বড্ড বড়ো এই লেখা।মানুষটাই যে বড্ড বড়ো ছিলো; লেখা ছোটো করার জো কই!
ঈশ্বর কাশীতে গিয়েও বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করে নি (ঠাকুরদাস তখন কাশীবাসী)।
রামকৃষ্ণের আহ্বানেও সন্নিধানে যায়নি। তা ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেই বিদ্যাসাগরকে দেখতে এসেছেন। উভয়ের সংলাপ সূচনা
(উভয়েই ঈষৎ তোৎলা ছিলেন)
রামকৃষ্ণ:আজ সাগরে এলাম। এতদিন খাল, বিল, হদ্দ, নদী দেখেছি; এইবার সাগর দেখছি। (সকলের হাস্য)
ঈশ্বর:তবে লোনা জল একটু নিয়ে যান। (শ্রীম কথিত)
….
ঠাকুর:….আর সিদ্ধ তো তুমি আছোই।
ঈশ্বর : মহাশয় কেমন করে?
ঠাকুর: (সহাস্যে) আলু, পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়। তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া। (হাস্য)
ঈশ্বর: (সহাস্যে) কলাইবাটা সিদ্ধ তো শক্তই হয়। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর: তুমি তা নও গো। শুধু পন্ডিতগুলো দরকচা-মার্কা। না এদিক, না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে ওঠে, তার নজর ভাগাড়ে। যারা শুধু পন্ডিত, কিন্তু তাদের কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি। শকুনির মতো পচা মড়া খুঁজছে।”
পাশাপাশি আরও এক জীবনীকার, প্রবল ধার্মিক ‘বিহারীলাল সরকার’ অভিমান ভরে লিখেছেন, ‘‘দুঃখের বিষয় অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখ কাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে। হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসগর উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন।’’
লেখকের কথা:- পত্নী দীনময়ীর সঙ্গে ঈশ্বরের যখন বিবাহ হয়, তখন দীনময়ী সপ্তমবর্ষীয়া বালিকা। প্রথম সন্তান জন্মে পঞ্চদশ বৎসর পরে।না, ভাববেন না ঈশ্বরের পৌরুষ কম ছিলো। চার সন্তানের পিতা। অর্থাৎ দীর্ঘ বৎসর ধরে’ ঈশ্বর পত্নী উপগত হয়নি। এক্ষেত্রেও ঈশ্বর ব্যক্তি হিসেবে নীতিভ্রষ্ট হয়নি; পত্নী সাবালিকা হওয়ার অপেক্ষা করেছে।রামকৃষ্ণ ঠাকুর যেমনটি বলতেন মেয়েমানুষের সঙ্গে এক বিছানায় না শুতে, সেটাও মানেনি; অথচ নিজের মত থেকে সরেনি।
দীনময়ী নারায়ণের বিধবাবিবাহ স্বীকার না করে অন্নজল বন্ধ করায় আদর্শবদ্ধ ঈশ্বর প্রিয়তমা পত্নীর মুখদর্শন করে নি। পত্নীর মৃত্যুশোকে আকুল হয়ে ক্রন্দন করেছে। ইতিহাস তাই বলে।
ঈশ্বর নিজের কন্যাদের ষোড়শ বৎসর বয়সেও বিবাহ দেন নি (মদনমোহন তর্কালঙ্কারের স্মৃতি)। সুতরাং ঈশ্বরের জীবনে দ্বিচারিতার স্থান ছিলো না। পিতা মাতা ওর উপাস্য দেবতা ছিলেন। এমনকি পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে কলকাতার বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেও মাসাধিক কালের বেশী সে লেখাপড়া করে নি। পলায়ন করে পিতামহের আশ্রয়ে ফিরে যায়।
ইশ্বর তখন পিতাকে বলে আপনি নিজেকে নিরামিষভোজী বলেন কিন্তু বাস্তবে আপনি নারায়ণের মস্তক খাচ্ছেন। উদ্ধৃতি চিহ্ন নেই; অর্থাৎ স্মৃতি থেকে লেখা। কিন্তু সক্রিয়ভাবে পিতার বিরোধিতা করে নি। এদিকে নারায়ণচন্দ্র অর্থলোলুপ প্রমান হলে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে।
বিজ্ঞানবিশ্বাসী ঈশ্বরের চরিত্রালোচনায় যদি বিজ্ঞান না আসে, তাহলে এই বিলোচন বৃথা।
স্ট্রিং থিওরি অনুযায়ী মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে চলছে প্রসারণশীল পর্যায়। সঙ্কুচিত হওয়াকালীন এক মহাজাগতিক সংঘর্ষে সকল বস্তুকণা জড়িয়ে পড়বে। মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে। অতঃপর বিগ ব্যাং হতে পূর্বে যেমন ভবিষ্যতেও,পুনরায় সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্রাদি প্রস্তুত হবে।
প্রাণের সৃষ্টি:-আদিতে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়া প্রায় সহস্র ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তপ্ত ছিলো। এমতাবস্থায় ভেস্টা নামক একটি জলভরা গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। উত্তাপ মেঘ এবং বজ্রপাতের সৃষ্টি করে। অতিবেগুনি রশ্মি, বজ্রপাত এই দুইয়ের সহবাসে কার্বন নাইট্রোজেন মিলে আরএনএ তৈরি হয়। প্রাণের পরশ। অক্সিজেন না থাকায় মিথেনোজেন প্রাণী তৈরি হয়। যারা মিথেন গ্রহণ করে, মিথেন গ্যাস ত্যাগ করে। এখনও তাদের অস্তিত্ব আছে (ডার্ক বায়োস্ফীয়ার)। এর পর আসে নীল সবুজ ছত্রাক (ব্লু গ্রীণ অ্যালগী), যারা এ্যাতোটা অক্সিজেন তৈরি করে যে ওজোন স্তর তৈরি হয়। পৃথিবীতে অতিবেগুনি রশ্মি আসা বন্ধ হয়। ধরিত্রী শীতল হয়।
Svante Pääbo নামের বৈজ্ঞানিক মানব বিবর্তন জিনোমিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষিত মানুষের কাছে কাল্পনিক ভগবানের লীলা সম্বরণ হয়ে গেল। বিজ্ঞানমনস্ক,নিরীশ্বরবাদী ঈশ্বরসম্বন্ধে লিখতে এটুকু না বললে বোধহয় প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থাকে।
এরপরেও ঈশ্বর সম্বন্ধে বলতে থাকলে শেষ হবে না। সম্ভব যে এই অন্তিম পর্বে ঈশ্বরের জীবনযাপনটুকু বোঝাতে পেরেছি। সকলেই ভালো থাকুন। সত্যের পথে থাকুন। ঈশ্বর আপনার হৃদয়ে অবস্থান করুক।
ঋণস্বীকার : ইন্দ্রমিত্র, বিনয় ঘোষ, মণি বাগচী, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, তৎকালীন আরও কিছু পত্রিকা, ও দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর, সংবাদ প্রভাকর, সোমপ্রকাশ ইত্যাদি। ইত্যাদি কথাটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, দীর্ঘ পঠনান্তে বহু পত্রিকার নাম ভুলে গেছি।এছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রপত্রিকা।
বিনীত লেখক।