২
ঋণ স্বীকার:-বিদ্যাসাগর (মণি বাগচি), করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (ইন্দ্রমিত্র), বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ (বিনয় ঘোষ), বিদ্যাসাগর জীবনীচরিত ও ভ্রমনিরাস (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন)
বনমালীপুর। হুগলি জিলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। সেখানে এক তর্কালঙ্কার ছিলেন- রামজয় তর্কালঙ্কার। ভুবনেশ্বর তর্কালঙ্কারের মেজপুত্র। জ্ঞানী কিন্তু মহাতেজস্বী-সহজ বাংলায় উগ্র স্বভাবের। এদিকে উপার্জন ঢুঢু। বাকি ভাইদের অবজ্ঞা, অবহেলা সইতে না পেরে’ রামজয় হলেন গৃহত্যাগী।বিদ্যাসাগরের ভাষায় “তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনও অংশে, কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে, অথবা কোনও প্রকারে, অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পারিতেন না। তিনি সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন….উপকার প্রত্যাশায় অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি কখনও পরের উপাসনা বা আনুগত্য করিতে পারেন নাই” (এটা আমার ঈশ্বর তাঁর ঠাকুর্দামশাই সম্বন্ধে লিখেছেন নাকি নিজের চরিত্রবিশ্লেষণ করেছে্ন বোঝা মুশকিল)।
পত্নী দুর্গাদেবী পড়লেন অকূল সমুদ্রে। তার মধ্যে আবার ছ’টি নাবালক সন্তান। বড়টির নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর দুর্গাদেবী চললেন পিত্রালয়। পিতার নাম উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত। তিনি তখন বীরসিংহ নিবাসী।আদরের কন্যা ও দৌহিত্রদের আশ্রয় জুটলো। কিন্তু বৃদ্ধ তখন পুত্রের ওপর নির্ভরশীল, উমাপতিবাবুর পুত্র দুর্গাদেবীকে অপমানের চূড়ান্ত করলেন।
“বাবা-আর তো এখানে থাকা চলে না” চোখের জলে দুর্গাদেবীকে উমাপতিবাবু বিদায় জানালেন এবং ঐ গ্রামেই একটা চালাঘর তুলে’ গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করলেন।
আমার ঈশ্বর লিখলেন “সেই সময়ে, টেকুয়া (সূতা পাকাবার যন্ত্র) ও চরকায় সূতা কাটিয়া, সেই সূতা বেচিয়া অনেক নিঃসহায় ও নিরুপায় স্ত্রীলোক আপনাদের দিন গুজরান করিতেন। দুর্গাদেবী সেই বৃত্তি অবলম্বন করিলেন… তথাপি তাঁহাদের ক্লেশের পরিসীমা ছিল না”
অতঃপর ঠাকুরদাসের জীবনসংগ্রামে দৃষ্টিপাত করা যাক।
পিতৃসঙ্গহীন ঠাকুরদাস সংস্কৃতের প্রথম পাঠ ভিন্ন বনমালীপুর বা বীরসিংহে কিছুই বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ পান নি। কলকাতায় চাকরি সন্ধানে এসে দেখলেন ইংরাজী শিক্ষা ব্যতিরকে উপার্জনের উপায় নেই। কলকাতার সভারাম বাচস্পতি বলে’ একজন জ্ঞাতির বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁর মতো দরিদ্র মানুষের পক্ষে ইংরাজি ইস্কুলে পড়া দুঃসাধ্য ছিলো।তাই বাচস্পতিমশাই একজন জাহাজ সরকারের কাছে কাজ চালানো গোছের ইংরাজি শিক্ষার ব্যবস্থা করে’ দিলেন। ঐ জাহাজ সরকার আবার সারাদিন চাকুরিক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকতেন। তাই সন্ধ্যার পরে ঠাকুরদাস ওনার কাছে পড়তে যেতেন।
অথচ ঐ সায়ংকালেই বাচস্পতিবাবুর বাড়িতে সায়মাশের (সন্ধ্যার/রাতের আহার) পাট সাঙ্গ হয়ে যেতো।
ঈশ্বর লিখেছেন “(ঠাকুরদাস) যখন আসিতেন তখন আর আহার পাইবার সম্ভাবনা থাকিত না; সুতরাং তাঁহাকে রাত্রিতে অনাহারে থাকিতে হইতো। এই রূপে নক্তন্তন (রাত্রিকালীন/নৈশ; নক্ত বিশেষ্যপদ রাত্রি) আহারে বঞ্চিত হইয়া তিনি দিন দিন শীর্ণ ও দুর্বল হইতে লাগিলেন”
তখন সমুদয় বৃত্তান্ত শুনে ঐ জাহাজ সরকার শিক্ষক অন্য এক শূদ্রের বাড়িতে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। ঠাকুরদাস সেখানে স্বপাকে খেতেন। অতঃপর ভাগ্যের পরিহাসে আশ্রয়দাতারও ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে।আবার সেই অভাব আর অনটন। ক্ষুধার জ্বালায় ক্লান্ত ঠাকুরদাসকে এক বৃদ্ধা বিধবা মুড়ি বিক্রেতা দৈ মুড়ি খাইয়ে ঠাকুরদাসের ক্ষুধা উপশমের ব্যবস্থা করলেন। অবশেষে ঠাকুরদাস মাসিক দুই টাকা হিসেবে একটা চাকরি পেলেন। ঠাকুরদাসের অনলস পরিশ্রমে মাহিনা পাঁচ টাকায় পৌঁছে গেল। এমন ঠাকুরদাসের পিতা রামজয় তর্কালঙ্কার প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি ঠাকুরদাসকে কলকাতার দয়েহাটা নিবাসী ভাগবতচরণ সিংহের বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত করে’ দিলেন। ভাগবতচরণ সিংহের চেষ্টায় ঠাকুরদাস একটা মাসিক আট টাকার চাকরি পেলেন। তখন ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম তেইশ চব্বিশ।
রামজয় দুর্গাদেবীকে বললেন “এবার তো ঠাকুরদাসের বিয়ের ব্যবস্থা দেখতে হয়”
দুর্গাদেবী তো তৎক্ষণাৎ রাজি। ঠিক হলো গোঘাটের রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতী অত্যন্ত সুলক্ষণা। রামজয় আবার তীর্থভ্রমণে গেলেন। যখন ফিরে এলেন তখন ভগবতী সন্তানসম্ভবা।
একদিন ঠাকুরদাস কোমরগঞ্জ হাটে গেছেন। দিনটা মঙ্গলবার। রামজয় ঠাকুরদাসকে বললেন “একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে”
সত্যসত্যই সে সময়ে বাড়িতে একটা গর্ভবতী গাভীও ছিলো। পরিহাসটা সম্যক উপলব্ধি না করতে পেরে’ বেচারা ঠাকুরদাস গোয়ালঘরেই চলে যাচ্ছিলেন। রামজয় হাস্যসম্বরণ করে’ ঠাকুরদাসকে আঁতুর ঘরে নিয়ে গেলেন। সেদিন ঈশ্বর জন্ম নিয়েছে। ঠাকুরদাস বিষ্মিত।
“কেন এঁড়ে বাছুর বললাম জানো? এ এঁড়ে বাছুরের মতো একগুঁয়ে হবে। যা ধরবে তাই করবে। কোনও বাধা মানবে না।” এই সদ্যজাত শিশুর নাম রাখা হলো ঈশ্বরচন্দ্র। ঈশ্বর জন্মালো বীরসিংহের এক চালাঘরে-যার জন্য বাংলা ইতিহাসের চলন গেল বেঁকে।
অধিকেনেমিতি
দ্বিতীয় সর্গম সমাপ্তমিদম।