তিন
(ঋণস্বীকার: করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-ইন্দ্রমিত্র; বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ-বিনয় ঘোষ; বিদ্যাসাগর-মণি বাগচি; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস-শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, তস্য তৃতীয় ভ্রাতা)
সদ্যজাত ঈশ্বরকে দেখে পিতামহ রামজয় কী করে’ বুঝেছিলেন যে এটি একটি এঁড়ে বাছুর হবে, সে সম্ভবতঃ গগনবিহারী ঈশ্বর (যদি থাকেন) ছাড়া কেউ জানে না। তবে বাস্তবে যে এই ঈশ্বর পিতামহ রামজয়কে একশো যোজন পেছনে ফেলবে, সেটা বাল্যেই বোঝা গেল। বোঝা গেল সে সুযোগ পেলে হবে কীর্তিধ্বজ মানুষ। মানুষের মতো মানুষ। না বাঙালি নয়। মানুষ।ব্যতিক্রমী এক চরিত্র।
পিতামহ পিতামহীর কলহের মাঝে দুরন্ত বালক বৃহৎ মাথাটা নিয়ে হাজির হয়;তৎক্ষণাৎ কলহ প্রশমিত হয়। রামজয় পরম স্নেহে ক্ষুদ্রকায় যশুরে কৈয়ের মতো বৃহৎ মাথাবিশিষ্ট শিশুটিকে জড়িয়ে ধরেন “ঈশ্বর-আমার ঈশ্বর”।
ছোট্ট ঈশ্বর পাঁচ বৎসরে চললো গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়। কালীকান্ত ছিলেন আদ্যন্ত স্নেহের রসে পূর্ণ এক মানুষ। সকল গ্রামবাসীর ও ঠাকুরদাসের সঙ্গে ঈশ্বরও তাঁর স্নেহের ভক্ত হয়ে গেলো। অন্য পোড়োদের ডেকে কালীকান্ত বলতেন “তোরা কী যে ছাই হিজিবিজি লিখিস-দ্যাখ তো ঈশ্বরের লেখা-যেন মুক্তো”
এরপর ঈশ্বরের হলো উদরাময় ও প্লীহাজ্বর (পেটের অসুখ আর জ্বরে পিলে বড়ো)-তখন ভগবতীদেবীর বড়মামার (রাধামোহন বিদ্যাভূষণ, পাতুলে ওঁর বাড়ি) কাছে ছ’মাস থেকে’ চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হ’য়ে বীরসিংহে ফিরলো।আবার সেই পাঠশাল। ঈশ্বর যখন আট বছরের হলো গুরুমশাই কালীকান্ত বললেন “ঈশ্বরকে আমার আর শেখানোর কিছু বাকি নাই-এবার ও কলকাতায় গিয়ে ইংরাজি শিখুক।”
এই সময়ে দীর্ঘদিন অতিসার (পেটখারাপ) রোগভোগের কারণে পিতামহ রামজয় মারা গেলেন। তখন কার্তিক মাসের শেষভাগ।
ঈশ্বর চলেছে কলকাতায়। ঠাকুরদাস সঙ্গে আছেন আর আছেন গুরুমশাই কালীকান্ত ও ভৃত্য আনন্দরাম। জলপথ তখন বিপজ্জনক আর উলুবেড়িয়ার খালও তখন কাটা হয়নি। সুতরাং হাঁটাপথেই যাত্রা। ক্ষুদ্র ঈশ্বরের মাথায় মা ভগবতীদেবীর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে; এমতাবস্থায় ঈশ্বর রওয়ানা দিলো। ঠাকুরদাস প্রথম রাত পাতুলে মামাশ্বশুরের বাড়িতে, দ্বিতীয় রাত সন্ধিপুরের জ্ঞাতিগৃহে কাটিয়ে, তৃতীয় দিন শিয়াখোলার পাকা সড়ক দিয়ে পৌঁছলেন কলকাতা। ঈশ্বর কিন্তু হেঁটে হেঁটে আসেনি। কিছুটা হেঁটে-বেশীটাই কোলে কোলে। যাই হোক একটা প্রমাণসাপেক্ষ কথা বহু জীবনীকাররা লিখে গেছেন-মাইলফলক দেখে’ ইংরাজি সংখ্যা চেনা। কথিত আছে গুরুমশাই কালীকান্ত এই অদ্ভুত স্মরণশক্তি দেখে’ বিষ্মিত হয়েছিলেন (লালমোহন বিদ্যানিধি এই বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছেন)।
কেয়াঘাটের বাঁধাঘাটে যেদিন ঈশ্বরের নৌকা ভিড়লো সেদিনই রাজা রামমোহন (সতীদাহ নিবারণ খ্যাত) চিৎপুর রোডে ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুরদাস উঠলেন দয়েহাটার জগদ্দুর্লভ (ভাগবতচরণের পঁচিশ বছরের পুত্র) সিংহের বাড়ি। এই বাড়িতেই থাকতেন রাইমণি (ভাগবতচরণের বিধবা কন্যা)-ওনার পুত্র গোপাল আর বিদ্যাসাগর সমবয়স্ক। রাইমণির অগাধ অপত্যস্নেহ শীর্ণ, মস্তকসর্বস্ব বিদ্যাসাগরকে প্লাবিত করেছিল।
তবে এই এঁড়ে বাছুরটা ছিল একেবারেই ঋণাত্মক বাচ্চা। যা বলা হবে সে তার বিপরীত করবে। হয়তো গায়ে তেল মেখে বসে’ আছে, ঠাকুরদাস বললেন “যাও ঈশ্বর স্নান করে’ এসো” ঈশ্বর প্রচুর মার খেয়েও যেতে সম্মত হতো না -যেহেতু হুকুম মানা তার স্বভাব নয়। ঠাকুরদাসের কাজ ছিল বিল কলেক্টরের-দশ টাকা তার মাহিনা। সকাল বেলা বেরিয়ে রাতে ফেরা। তবে ঘরে এসে ঈশ্বরকে ঘুমন্ত দেখলে যে পরিমাণ পেটাই হতো তাতে সম ওজনের সরিষা থেকে প্রচুর পরিমাণ তেল তৈরি হতে পারতো। এসব ক্ষেত্রে রক্ষাকর্ত্রী ছিলেন স্নেহকাতর বিধবা রাইমণি “আরে ঠাকুরমশাই এরপর তো গৃহস্থ বাড়িতে ব্রহ্মহত্যার পাতকী হবে”-আবার ভোর সাড়ে চারটের সময়-মুসলমানদের আজানের সময় থেকে শুরু হতো পাঠাভ্যাস। তখন ঈশ্বর মল্লিকবাড়িতে(শিবচরণ মল্লিক-বিখ্যাত সুবর্ণবণিক পরিবারের কর্তা) পাঠশালায় পড়েছে; ধনিক গৃহে একজন গুরুমশাই থাকতেন, ধনিকপুত্রের জন্য; বাড়ির বৈঠকখানায় বাড়ির ছেলেদের সহিত আরও কয়েকজন নিকটবর্তী বালক পাঠাভ্যাস করতো। ওখানে স্বরূপচন্দ্র দাস ছিলেন গুরুমশাই। এখানে তিনমাসের মধ্যেই পাঠশালার পাঠ সম্পূর্ণ। স্বরূপচন্দ্র চমৎকৃত।
এমৎ সময়ে ঈশ্বরের হলো রক্তাতিসার (রক্ত পায়খানা-কলকাতায় তখন ম্যালেরিয়া আর পেটের রোগ প্রচুর-হয়তো আজও হয়) ব্যাধি। এই সঙ্গেই ঈশ্বরের হলো অজীর্ণ আর লোনালাগা ব্যাধি। স্থানীয় কবিরাজ দুর্গাদাসের চিকিৎসা এবং ভাগবতচরণের কন্যা রাইমনির অক্লান্ত সেবা কোনও কিছুতেই ঈশ্বরের ব্যাধির উপশম হয় না-তখন ভগবতীদেবী এসে’ ঈশ্বরকে বীরসিংহে নিয়ে গেলেন।
“বাটিতে আসিয়া সাত আট দিনেই, বিনা চিকিৎসায় আমি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হইলাম”
অতঃপর আড়াই মাস পরে পিতা ঠাকুরদাস এসে’, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঈশ্বরকে নিয়ে’ কলকাতা যাত্রা করলেন। তখন জ্যৈষ্ঠের তীব্র দাবদাহ।আকাশে দীপ্ত সূর্য আর বাতাসে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। রুগ্ন শরীরে ঈশ্বর এতাদৃশ পথশ্রম সহ্য করতে পারলো না। মধ্যপথেই ক্লান্তি আর পায়ের বেদনায় সে পথে বসলো। প্রথমবার সঙ্গে ভৃত্য ‘আনন্দরাম গুটি’ ছিলো, সে কাঁধে বসিয়ে বালক ঈশ্বরকে প্রায় সম্পূর্ণ পথ বহন করে’ নিয়ে যায়। একগুঁয়ে বালক এইবার ভৃত্য সমভিব্যাহারে যেতে অস্বীকার করে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস হয়তো তাকে এই কঠিন শ্রমসাধ্য কাজে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো। এইবার কিন্তু শেষ অবধি জেদ বজায় থাকলো না। পিতৃদেবের চপেটাঘাত বা ফেলে’ চলে যাওয়ার ভীতিপ্রদর্শন কিছুতেই বালক ঈশ্বর আর উঠে হাঁটতে পারলো না। সুতরাং এবার প্রচুর অনুযোগ এবং চপেটাঘাত সঙ্গী করে’ পিতৃদেবের স্কন্ধারুঢ় হয়ে’ই কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলো আমার একাকী একগুঁয়ে ঈশ্বর।
অধিকেনামিতি তৃতীয় সর্গস্য সমাপ্তি।