কলেজের প্রথম ভাগ
(ঋণস্বীকার: করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-ইন্দ্রমিত্র; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ-বিনয় ঘোষ; বিদ্যাসাগর-মণি বাগচি; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস-শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, তস্য তৃতীয় ভ্রাতা)
ঠাকুরদাসের তখন দশটাকা মাসিক উপার্জন। যদ্যপি ঠাকুরদাসের মনের সুপ্ত ইচ্ছে মেধাবী, একগুঁয়ে পুত্র ইংরাজি অধ্যয়ন করুক, তথাপি অর্থের অকুলান। তখন হিন্দু কলেজে ডিরোজিও আছেন শিক্ষক; ছাত্র হিসেবে আছেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, ইত্যাদি মানুষেরা। রাজা রামমোহন এঁদের দিয়েছিলেন ইউরোপীয় চিন্তাধারার আভাসটুকু মাত্র আর ডিরোজিও দিলেন ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার স্বরূপ। মেকলে সাহেব (সব সাহেবই জাত্যাভিমানে টৈটম্বুর থাকতেন-ফলতঃ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো সবাইকে ধীরে ধীরে নিজ ধর্ম এবং সভ্যতার প্রতি অনুরক্ত করে তোলা) চাইতেন ছাত্ররা যেন নিজেদের স্বজাতীয় গর্ব, ঐতিহ্য ত্যাগ করে’ ইউরোপীয় সভ্যতার পূজা করে। এইসব ছাত্ররা মনে করতো বাংলা ভাষা ক্ষীণতোয়া নদীর হাঁটুজল তাতে ঘরোয়া কথা চলতে পারে কিন্তু সাহিত্যের সমুদ্র ইংরাজি ভাষা; তাতেই একমাত্র ব্যবসা বাণিজ্য ও সাহিত্যরচনা সম্ভব; তাঁরা বাঙলা ভাষায় নিজের নামটুকুও শুদ্ধভাবে লিখতে অপারগ ছিলেন।হয়তো হিন্দু কলেজে পড়লে ঈশ্বর তাঁদের মতেই চলতো অথবা বেশী সম্ভাবনা ঈশ্বরের সঙ্গে ইউরোপীয় মনোভাবাপন্ন মানুষের তীব্র সঙ্ঘাত হতো। কেন না ঈশ্বর ছিলো মননে বৈজ্ঞানিক, সত্যান্বেষী আর যাপনে ভারতীয়-শুধু মাত্র ভারতীয় নয় তীব্র ভাবে বাঙালি; বাঙলা ভাষার প্রতি তার ছিলো অগাধ ভালবাসা-মাতৃভাষার প্রতি যেমনটি থাকা উচিত।
যাই হোক তা আর হয়নি। ১৮২৯ সালের ১লা জুন নয় বছরের ঈশ্বর ভর্তি হলো সংস্কৃত কলেজের তৃতীয় শ্রেণীতে; জি টি মার্শাল সাহেব তখন সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক। (আর এতদ্ব্যতীত হিন্দু কলেজে পঠনপাঠনের দ্বার কেবলমাত্র উচ্চশ্রেণীর, যথেষ্ট প্রতিপত্তি -সম্পত্তির অধিকারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিলো। তৎকালীন জমিদারদিগের অত্যাচারের যা বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে তাতে মধ্যযুগীয় ইংরাজ প্রফুল্ল হ’তে পারে; এযুগের মানুষের বিবমিষা জন্মিবে।) নয় বছরের খর্বাকৃতি, মস্তকসর্বস্ব বালক যখন ছাতি মাথায় কলেজে যেতো তখন সমস্ত শরীরটাই ঢাকা পড়ে যেতো বিশালাকার ছাতির তলায়। মনে হতো রাস্তা দিয়ে কেবলমাত্র একটা ছাতা চলেছে। উদ্ভট দেহাকৃতির জন্য বাকি ছাত্ররা ‘কশুরে জৈ’ (যশুরে কৈয়ের অপভ্রংশ, অর্থাৎ বৃহৎ মাথাবিশিষ্ট কৈমাছের সঙ্গে তুলনা করতো) বলে’ ঊত্যক্ত করতো।বেচারা তোৎলা ঈশ্বর ক্রোধে লোহিত বর্ণ ধারণ করতো কিন্তু মুখের কথা আটকে যেতো। বাকি সময়টা পিতা ঠাকুরদাসের কঠোর শাসনের প্রাচীর বেষ্টিত হয়ে থাকতো। ফলে মানসিক বৃদ্ধিটি হয়েছিল চমৎকার। ঠাকুরদাস ইংরাজি শিক্ষার গুরুত্ব অবধান করেছিলেন কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতিতে আস্থাবান ছিলেন। ঈশ্বর এই মতেই বেড়ে উঠেছে সঙ্গে ছিলো তার বিজ্ঞানজিজ্ঞাসা এবং গভীর অনুসন্ধিৎসু মন। দিকপাল যতো পন্ডিত সব তখন সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক। ঈশ্বর কিন্তু চতুষ্পার্শে এই জ্ঞানের ছড়াছড়ি দেখে পরম আহ্লাদ পেলো। কোথায় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চতুষ্পাঠি আর কোথায় সংস্কৃত কলেজ; প্রথমেই শিক্ষক হলেন গঙ্গাচরণ তর্কবাগীশ। ঈশ্বরের সেই প্রথম সংস্কৃত পাঠ। তাঁর শিক্ষাদান যে অতি উত্তম ছিলো শুধু তাই নয় প্রতিটি ছাত্রকে তিনি পুত্রসম ভালবাসতেন-স্নেহ করতেন। বিশেষতঃ বালক ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশেষ করুণা ছিলো; কেননা ঈশ্বরের মতো তীব্র পাঠানুরাগ এবং অধ্যাবসায় অন্য কারোই ছিলো না।
সংস্কৃত কলেজের জন্মসন ১৮২৪; সেই সময় থেকে বহুদিন এখানে অধ্যয়ননিমিত্ত কোনও দক্ষিণা প্রয়োজন হতো না। ফলতঃ মনে স্ফূর্তি জন্মিলে যে কেউ এসে ভর্তি হতো তারপর তার আর শিখাটিও দ্যাখা যেতো না। ১৮৫২ সন থেকে ঈশ্বরের প্রয়াসে ভর্তির জন্য দুই টাকা দক্ষিণা ধার্য হলো।ঠাকুরদাস একাদশ বর্ষে ঈশ্বরের উপনয়ন সম্পন্ন করলেন। ইতোমধ্যে ঈশ্বর ব্যাকরণের পাঠ সমাপ্ত করেছে। এবার সংস্কৃত সাহিত্য পাঠের জন্য জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের অধীনে কলেজে ভর্তি হলো। বারো বৎসরের বালক পড়বে সংস্কৃত সাহিত্য? শ্লেষের হাসি তর্কালঙ্কারের ওষ্ঠপ্রান্তে। ঈশ্বর বিনীতভাবে অনুরোধ করলো “আপনি আমাকে পরীক্ষা করেই নিন”
জয়গোপাল তর্কালঙ্কার শান্তভাবে বললেন “বেশ পরীক্ষাই দাও।কালিদাসের কুমারসম্ভবের একটা শ্লোক বল দেখি?”
দ্বিধামাত্র নেই।
“অক্ষাগ্রহস্তে মুকুলীকৃতাঙ্গুলৌ|
সমর্পয়ন্তী স্ফটিকাক্ষমালিকাম||
কথঞ্চিদদ্রিস্তনয়ামিতাক্ষরঃ|
চিরব্যবস্থাপিত বাগভাষত||”
জয়গোপাল “ব্যাখ্যা করো”
“অঙ্গুলিগুলিকে পুষ্পকলিকার ন্যায় মুদ্রিত করিয়া করাগ্রভাগে স্ফটিকাক্ষমালা স্থাপন করিতে করিতে অদ্রিতনয়া বহু কষ্টে মুখে বাক্য আনিয়া পরিমিতভাষায় স্বীয় উচ্চাভিলাষের কথা ব্রহ্মচারীবেশী শিবকে ব্যক্ত করিলেন”
সাধু সাধু রবে অধ্যাপকগণ মুখর হয়ে উঠলেন। এরপর কালিদাসের ঋতুসংহারের শ্লোক চিনে নেওয়া, রঘুবংশ আবৃত্তি- এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে সমস্ত সংস্কৃত শ্লোকভারাক্রান্ত আর করবো না। খর্বাকৃতি ঈশ্বর সগৌরবে পরীক্ষায় সফল হলো। ঈশ্বর প্রথম বর্ষে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব ইত্যাদি পাঠান্তে প্রথম স্থান অধিকার করেন। দ্বিতীয় বর্ষে মাঘ, ভারবি, কাদম্বরী, দশকুমারচরিত পাঠেও প্রথম স্থান নিয়ে সফল হয়। এইসব পাঠাভ্যাসের কথা বলে পাঠকপাঠিকার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। তবে আমার ঈশ্বরের লিখনীতে দেখি “কখনও অন্ন জুটিতো কখনও জুটিতো না। যখন জুটিতো তখনও সকলে পেট ভরিয়া খাইতে পারিতেন না। যখন পেট ভরিয়া অন্ন জুটিতো তখন ব্যঞ্জনের অভাব।”
তখন ভাই দীনবন্ধুও কলকাতার বাসিন্দা। চৌদ্দ বছরের ঈশ্বর প্রাতঃকালে স্নানান্তে বাজার সমাপন করে’ শিলে মশলা পিষে’, চ্যালাকাঠ চিরে’ উনুনে রান্না করতো। হয়তো তাই বাঙালির পোষাক ওনার কাছে জাতীয় পতাকার মর্যাদা পেতো। মা চরকায় সূতা কেটে’ কাপড় তৈরি করে’ ঈশ্বরকে পাঠাতেন। খর্বকায় ব্রাহ্মণ মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় শুধু মাথায় তুলে’ নিয়েছিলো তা নয় ইংরাজের দম্ভের সামনে সেই পতাকার সম্মান যথোচিত রক্ষা করেছিলো।
অধিকমিতি।চতুর্থ সর্গস্য সমাপ্তিমিদম।