কলেজের দ্বিতীয় ভাগ
(ঋণস্বীকার: করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-ইন্দ্রমিত্র; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ-বিনয় ঘোষ; বিদ্যাসাগর-মণি বাগচি; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস-শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, তস্য তৃতীয় ভ্রাতা। এবং স্বীকারোক্তি: এই দীর্ঘ প্রবন্ধে আমার নিজস্বতা কণামাত্র নাই; শুধুমাত্র কয়েকটি পুস্তক অধ্যয়নান্তে কিছু স্বকীয় ধারণা ব্যতিরকে বাকি সমস্তটাই উদ্ধৃতিমাত্র)
সংলগ্ন গৃহে সংস্কৃত কলেজ আর হিন্দু কলেজের মধ্যে শুধুমাত্র আদর্শগত ভিন্নতা প্রাচ্য পাশ্চাত্ত্যের ছিলো তা নয় সংস্কৃত কলেজে হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের আধিক্য সেখানে হিন্দু কলেজ ছিলো উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারের সংকীর্ণ পরিধিভুক্ত; এদের মধ্যে একগুঁয়ে জেদী অহংসর্বস্ব ভাবটিই মুখ্য ছিলো। দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো দুই বিপরীতধর্মী অবস্থানের। ঈশ্বর ছিলো সর্বার্থেই উভয়ের সেতুবন্ধন।
এই সংস্কৃত কলেজের ঈশ্বরই কিন্তু বাল্যবিবাহের বিপক্ষে; বিধবাবিবাহের পক্ষে; স্ত্রীশিক্ষার এবং স্বাবলম্বনের জন্য সংগ্রাম করেছে। বরঞ্চ বহু পাশ্চাত্যমনোভাবাপন্ন বাঙ্গালীও এইসবের বিরোধিতা করেছেন।
১৮৩৩ সন পর্যন্ত ব্যাকরণ শিক্ষা সম্পন্ন করে’ ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৫ সন পর্যন্ত সাহিত্য পাঠ করে।
সংস্কৃত কলেজে যে কেবল সংস্কৃত ন্যায় কাব্য পড়ানো হতো তা’ নয়; ১৮২৭ সালের ১লা মে এম. ডাবলিউ. ওয়ালস্টোনসাহেব মাসিক দুই শত টাকা মাহিনায় ইংরাজি শিক্ষক নিযুক্ত হন।আমাদের ঈশ্বর ১৮৩৩-৩৪ সালের বাৎসরিক পরীক্ষায় ইংরাজী ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্ররূপে ৫৷৷৹(পাঁচ টাকা অষ্ট আনা) মূল্যের পুস্তক পুরষ্কার পান-History of Greece, English Reader no 2 and 3 ইত্যাদি। ১৮৩৫ সালের নভেম্বর মাসে উক্ত কলেজে ইংরাজী শিক্ষার পর্ব বন্ধ হয়। তখন বিনা ভাড়ার বাড়িতে রান্নাঘরে মলগৃহের কৃমিকীট সরিয়ে সরিয়ে অন্নগ্রহণ, রন্ধন চলছে। ঘন ঘন অসুখ আর প্রবল অমানুষিক পরিশ্রম। দিবারাত্র। বাজার, রন্ধন, রাত্রজাগরণ-তদুপরি অক্লান্ত জিগীষা। উদ্ভটশ্লোক, স্বকৃত সংস্কৃত শ্লোক; কথিত ছিলো এই বালক ঈশ্বর বাঙালার মতো সাবলীলভাবে সংস্কৃত বলে। পরে জানা যাবে ইংরাজী লিখনেও সে সমান সাবলীল।
হয়তো পিতা ঠাকুরদাসের ইংরাজী শিক্ষার কঠোর প্রয়াস অথবা পাশ্চাত্যের উদার মনোভাব অথবা কেবলমাত্র ঈশ্বরের জিগীষা।সেস্থলে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা বাঙালা ভাষাকে হীনজ্ঞান করে’ বঙ্গভাষায় স্বহস্তে আপন নাম লিখতেও সমর্থ ছিলো না।
সমসাময়িক মধুকবিও বাঙালা পরিত্যাগ করে’ ইংরাজি সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ার বাসনায় ইংরাজি ভাষা কাব্য করতে থাকেন। ইংরাজী লেখক হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হ’তে তিনি বাঙলায় পৌরাণিক কাহিনী ভিত্তিক কিছু অবিস্মরণীয় কাব্য রচনা করেন এবং আমাদের ঈশ্বরের ভালবাসা ও পরম স্নেহের পাত্র হ’য়ে ওঠেন।
ঈশ্বরের জ্ঞানতৃষা ছিলো অতি প্রবল। সেই জানার আগ্রহে কিশোর ঈশ্বর যে যে কান্ড করেছিল সেগুলোর অনুল্লেখে ঈশ্বরের পূর্ণ পরিচয় দেওয়াই হবে না। ফোর্ট উইলিয়ামে কর্মজীবনে এক হিন্দুস্থানী পন্ডিতের কাছে মাসিক দশটাকা বেতনে হিন্দি শিখতো এছাড়া ডাক্তার (পাশ না করা) দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-হেয়ার স্কুলের শিক্ষক এবং তাঁর পরবর্তীতে নীলমাধব মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরকে ইংরাজী শেখাতেন। এই সব ঘটনাবলী কলেজ জীবনের পরে ঘটেছে।
ছাত্রজীবনে ঈশ্বর পাণিনি লিখিত মুগ্ধবোধ (মূঢ়ের ব্যুৎপত্তি উদ্দেশে ব্যাকরণ) পড়তে অত্যন্ত ক্লেশ অনুভব করে। যদ্যপি ঈশ্বর মূঢ় ছিলো না তথাপি এই জটিল পুস্তকটি এমত উপায়ে লিখিত যে মুখস্থ করা ব্যতীত উপায় ছিলো না; পরবর্তীতে ঈশ্বর রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সহজে ও অল্প সময়ে সংস্কৃত পড়িবার নিমিত্ত বাংলায় স্বহস্তে ব্যাকরণ উপক্রমণিকা এবং পরবর্তীতে সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী লিখে সমস্যা নিরসনে কৃতকার্য হয়।
সে বড়ো অস্থির সময়। হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’র অনুরক্ত ছাত্রদল (ইয়াং বেঙ্গল) হিন্দু ধর্মের বিচ্যুতির উদ্দেশে যে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন তা অনেক সময়ই ভদ্রতার সীমা এতটাই অতিক্রম করতো যে সমগ্র হিন্দু সমাজের জাত্যাভিমানে আঘাত লাগলো। আন্দোলনের তরঙ্গাঘাতে বহু ছাত্র কলেজ ছাড়লো। হেয়ার সাহেব, উইলসন সাহেব, শ্রীকৃষ্ণ সিংহের আপত্তি সত্ত্বেও ডিরোজিও পদচ্যুত হলেন (১৮৩১, ২৩শে এপ্রিল)। ইয়াং বেঙ্গল দিশাহীন। তার কয়েকমাস পরে ২৬শে ডিসেম্বর ইউরেশিয়ান কবি, যুক্তিবাদী ও চিন্তাবিদ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর অকাল প্রয়াণ ঘটে। ইতোমধ্যে বিলাতে রাজা রামমোহনেরও মৃত্যু হলো (১৮৩৩, ২৭শে ডিসেম্বর)। রামমোহন ছিলেন পথপ্রদর্শক আর ডিরোজিও ছিলেন ছাত্রকুলের নয়নমণি, য়ূরোপীয়ান ভাবধারার এক তীক্ষ্ণ নেতা। দুজনেই গত হওয়ার পরে ইয়াং বেঙ্গল অদৃশ্যপ্রায় হলো। একই কলেজ প্রাঙ্গণে ভিন্ন কলেজে পাঠ করে’ ঈশ্বর এই উত্থান পতনের সাক্ষী হলো। অবধান করলো সহজে, হুজুক দিয়ে কোনও মহৎ কাজ সম্পন্ন হয় না; সমাজ পরিবর্তনের পথ অতি বন্ধুর; প্রবল জেদ এবং জনসচেতনতা ভিন্ন এই কাজ অসম্ভব।এই সময়ই ক্ষীরপাই গ্রামের শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী ভট্টাচার্যের সঙ্গে চৌদ্দ বৎসরের বালক ঈশ্বর পরিণয়পাশে আবদ্ধ হলো।
ঈশ্বরের পড়াশুনায় কিন্তু ক্ষণিকের যতিও পড়ে নি। ন্যায়, তর্ক, স্মৃতি, ব্যাকরণ সবই সে কঠোর আত্মদমনের মধ্যে সম্পূর্ণ করেছে।
ও হ্যাঁ, ঈশ্বরের বিদ্যাসাগর হওয়ার উপাখ্যান বাদ পড়ে’ গিয়েছে।বহু তর্কসভায় নামী নামী পন্ডিতদের শাস্ত্রজালে পরাজিত করে’; শিক্ষকদের আপন অধ্যাবসায় ও ধীশক্তিতে, মেধায় আপ্লুত করে’ আমার একাকী ঈশ্বর ‘বিদ্যাসাগর’ পদবী অর্জন করেছে; যে পদবী পূর্বে কেউ পায়নি, ভবিষ্যতেও আর দ্বিতীয় কেউ পাবে না।আমার অনন্য ঈশ্বর এখন বিদ্যাসাগর। একটি বিশেষ সাফল্য অনুক্ত রয়ে গেল। আইন পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়সে গৌহাটি আদলতের জজের চাকরি পেয়েছে; কিন্তু ঠাকুরদাসের প্রবল আপত্তিতে যাওয়া হয়নি। হয়তো জজ হ’লে ঈশ্বর ভিন্ন পরিচয়ে ইতিহাসের পাতায় নিমজ্জিত থাকতো। কে তখন মহতী ইংরাজী সাহিত্য বাঙালায় অনুবাদ করে’ পড়াতো?কে’ই বা সত্যকার আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলন করতো? তরুণী পাঠিকা ‘বর্ণপরিচয়’ পুস্তকখানি হয়তো আপনারও মনে পড়বে।ওটা ছাড়া আজও হাতেখড়ি অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ। ওটা আমার ঈশ্বরের লেখা।
বাস্তবে কিছু দিন যাবৎ আমি অকূল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি।কোনপথে সাঁতার কাটলে যে সহজে পাড়ে পৌঁছবো জানি না।সাগরের নাম বিদ্যাসাগর।
একটা ভিন্নধর্মী ঘটনার অনুল্লেখে আমার ঈশ্বর অসম্পূর্ণ থাকে।
বৃদ্ধ শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির স্ত্রী বিয়োগের পরে অথর্ব বৃদ্ধের পক্ষে দিনাতিপাত করা অসম্ভব হ’য়ে উঠলো। তিনি এই সত্যবাদী, দৃঢ়চেতা, মেধাবী ছাত্রটিকে শুধুমাত্র স্নেহ করতেন বললে অনৃতভাষণ হবে; তিনি সর্বক্ষেত্রে এই বালকের ওপর নির্ভর করতেন। তিনি নতুন বধূ আনার বিষয়ে ঈশ্বরের মতামত চাইলেন।
“এই বুড়োবয়সে নতুন দারপরিগ্রহ উচিত হবে না” ঈশ্বর মত প্রকাশ করলো।
বাচস্পতিমশাই কিন্তু শোনেন নি। একটি অল্প বয়সী কন্যাকে বিয়ে করে ঈশ্বরকে তার নতুন গুরুপত্নী অর্থাৎ মা’কে দেখতে ডাকেন।ঈশ্বর মায়ের চরণে দু’টি টাকা রেখে অশ্রুবিগলিত নয়নে ঐ গৃহের সংশ্রব ত্যাগ করে। “কতদিনই বা এই বালিকার সীমন্তে সিঁদুর থাকবে?তারপর তো অবর্ণনীয় বৈধব্য”
ঈশ্বর অতি খর্বকায় ছিলো। ক্ষুদ্র দুহাতে যতদূর সম্ভব সমাজের পাঁক পরিষ্কার করেছে। হয়তো এই যুগের কোনও তরুণী বলবে “সিঁদুর? থাকলেই বা কী? না থাকলেই বা কী?”
না, ঈশ্বর বিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলন দেখতে পায়নি (সম্ভবতঃ সিমন দি ব্যোভেরার তখনও জন্ম হয়নি); কিন্তু বিধবাদের জীবনযাপনের জন্য তাদের প্রস্তুত ঘরোয়া দ্রব্যাদি ঈশ্বর স্বহস্তে বিক্রি করেছে; নারীকে আপন বলে বলীয়ান করতে নারীশিক্ষার প্রসার করতে প্রাণপণ করেছে; সর্বোপরি বিধবাবিবাহের জন্য সমস্ত বঙ্গদেশের বিরুদ্ধে একা তার খর্বাকৃতি হাতে লড়াই করেছে।এই অদ্ভুতকর্মা মানুষটিকে ব্যাখ্যা করা ভারী মুশকিল।
অথ পঞ্চম সর্গস্য ইতি। অতঃপর কর্মজীবনস্য প্রারম্ভম।