আমার ঈশ্বর এক অদ্ভুতকর্মা মানুষ। যাকে, যার ব্যক্তিত্বটিকে না চিনলে তার কর্মপদ্ধতি বোঝা যাবে না। সুতরাং কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগে সেই মানুষটিকে চেনানোর চেষ্টা করি।
ঈশ্বর চাকরি করেছে, চাকরি ছেড়েছে। না না, আর্থিক কারণে নয়- মতাদর্শগত কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে, অথবা পিত্রাদেশ মান্য করতে। হ্যাঁ, তুলনা অবশ্যই আসবে, সাধারণের সঙ্গে, তবে সেটা এই পর্বের শেষভাগে।
প্রথমে আসামের আদালতে ন্যায়াধীশের চাকুরী ত্যাগ করে পিতৃ ইচ্ছা পালনে। এটা পারিবারিক ব্যাপার, বিশেষ উল্লেখ্য নয়। এবার আসা যাক ঈশ্বরের পোশাক আষাকের বিষয়ে। বই পুস্তক থেকে ঈশ্বর উপার্জন কম করেনি, যদিও বহু অর্থ ব্যয় হয়েছে বিধবাবিবাহে, তবুও নিজের পোশাক চিরকাল ছিলো খেঁটো ধুতি, একটি উড়নি এবং শুঁড়তোলা তালতলার চটি। এটা কি ঈশ্বরের মিতব্যয়িতা? কৃপণতা? নাকি এর পেছনেও রয়েছে ঐ একগুঁয়ে বালকোচিত জেদ?
একদা ঈশ্বর কর্মাবসানে গৃহ প্রত্যাবর্তন কালে পথিমধ্যে এক বড়োমানুষের দেখা পায়। রীতিমতো চোগা, চাপকান পরিহিত ভদ্রমানুষ। গৃহ থেকে ভৃত্য ঊর্দ্ধশ্বাসে এসে ওনাকে বার্তা দেয় “বাবুমশয়, শীঘ্র বাটিতে ফিরুন। বাটিতে আগুন লেগেছেন।”
ক্রুদ্ধ বড়োমানুষ বলেন “আরে আমি কি এই উত্তম পোষাকে পথে দৌড়াবো? আগুনে যা ধ্বংস হয় হৌক। আমি আমার আপন গতিতেই চলবো”
বিষ্মিত ঈশ্বর স্থির করে যে পোষাক মানুষের স্বাভাবিক পরিচয় ভুলিয়ে দেয়, সেই পোষাক আমি অঙ্গে তুলবো না।(করুণাসাগর বিদ্যাসাগর ইন্দ্রমিত্র)
অবশ্য ছোটোলাট হেলিডে সাহেবের সনির্বন্ধ অনুরোধে (১৮৫৭সনে) একবার চোগা ইত্যাদি অঙ্গে তুলেছিলো, কিন্তু সেই শেষ। ঈশ্বর হেলিডে সাহেবকে (নারীশিক্ষার বিস্তারের আগ্রহী) বলে “এই আপনার সঙ্গে শেষ দেখা”
বিষ্মিত হেলিডে কারণ জানতে চাইলে; ঈশ্বর বলে “না সাহেব, এই পোষাক আমার সহ্য হবে না। এ আমি আর পরিধান করতে পারবো না।”
ছোটোলাট অনন্তর উপরোধ করেন নি।
একবার লাটসাহেবের নিকট বিশেষ কোনও সরকারি কার্যোপলক্ষ্যে ঈশ্বর যেতে বাধ্য হয়েছিলো। প্রতীক্ষালয়ে রায়বাহাদুর, রাজা জমিন্দার এবং রায়বাহাদুর প্রার্থী সুসজ্জিত বড়োমানুষের ভীড়। সেখানে ঈশ্বর একেবারেই হংস মধ্যে বকো যথা। দ্বাররক্ষক যথারীতি হাঁটু পর্যন্ত ধূলিমলিন ধুতি পরা, ধূলিধূসরিত বেঁটে ব্রাহ্মণকে একপাশে বসিয়ে ঈশ্বরের হস্তলিখিত পরিচয়পত্র নিয়ে লাটসাহেবের কাছে পেশ করলো। এবং কিমাশ্চর্যম সকলের পূর্বে এই টেকো, তোতলা ব্রাহ্মণের আহ্বান এলো। বিষ্ময়তাড়িত ঈশ্বর লাটসাহেবকে প্রশ্ন করলে “বাহিরে এতো জন সাক্ষাৎপ্রার্থীর পূর্বে আমার কেন ডাক এলো?”
লাটসাহেব মৃদু হাস্যে কহিলেন “উহারা সকলেই উমেদারি নিমিত্তে আসিয়াছে। উহাদের প্রত্যেকের কিছু ব্যক্তিগত যাচ্ঞা আছে। এবং প্রত্যেকেই ঐ কর্মসাধন হেতু প্রত্যহ আমার নিকট নিয়মিত হত্যে দিয়া থাকিবে। কিন্তু এই মানুষটি নিজ স্বার্থে আসে নাই। শুধু তাই নহে, আজ প্রত্যাখ্যাত হৈলে আর দ্বিতীয় দিবসে এস্থলে পদার্পণ করিবে না। তখন হয়তো আমাকেই উহার সমাগমে সাক্ষাতপ্রার্থী হইতে হইবে। তাই ঈশ্বরচন্দ্রের ডাক সর্বাগ্রে”
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে সাহেবরা বড়ই জাত্যাভিমানে ভোগে। নিজেদের পোষাক, নিজেদের সংস্কৃতি অন্য দেশে বপন করতে সদা উদগ্রীব। সেক্ষেত্রে এই রকমভাবে জাত্যাভিমানী একজন মানুষকে সম্মান করতেও তাদের বাধে না। (এক্ষণে রবীন্দ্রনাথের একটা উক্তি প্রণিধানযোগ্য; ব্রাহ্মণপন্ডিত যে চটি জুতা ও মোটা ধুতিচাদর পরিয়া সম্মানলাভ করেন, বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই। তাঁহার নিজের সমাজে যখন ইহাই ভদ্রবেশ, তখন তিনি অন্য বেশ পরিয়া আপন সমাজ এবং সেই সঙ্গে আপনার (নিজের) অবমাননা করিতে চাহেন নাই। সাদা ধুতি ও সাদা চাদরকে ঈশ্বরচন্দ্র যে-গৌরব অর্পণ করিয়াছিলেন, আমাদের বর্তমান রাজাদের ছদ্মবেশে আমরা আপনাদিগকে সে-গৌরব দিতে পারি না; বরঞ্চ এই কৃষ্ণচর্মের ওপর দ্বিগুণতর কলঙ্ক লেপন করি। এই আমাদের অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখন্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।)
নেটিভ কালা আদমিকে অসম্মান করার জন্য হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ এক লালমুখো কারসাহেব কলেজের ঈশ্বরের অভ্যর্থনায় টেবিলে জুতা সমেত পদযুগল তুলে রেখেছিলেন। অবশ্যই আমাদের বেঁটে বামুন সেই অপমান ভোলে নাই। তখন ঈশ্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। কারসাহেব বিশেষ কিছু কাজে ঈশ্বরসমাগমে আসেন। ঈশ্বর তার যথোপযুক্ত অভ্যর্থনা করেছিলো। সাহেবের আগমন বার্তা পেয়ে ধূলিমলিন শুঁড়তোলা তালতলার পাদুকা সহ নিজের পদযুগল টেবিলে তুলে দিয়েছিলেন। কারসাহেব সে অপমান সহ্য করেন নি। তিনি মেয়ট সাহেবের কাছে অভিযোগ করেন। প্রত্যুত্তরে মেয়ট সাহেবকে বলেন আমাদের ঈশ্বর, “আমি ভেবেছিলাম, আমরা অসভ্য, সাহেবেরা সভ্য, সাহেবদের কাছেই আমাদের সভ্যতা শেখা উচিত। কার সাহেবের কক্ষেও আমি গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, আমি ভেবেছিলাম সেইটাই অভ্যর্থনা জানানোর রীতি, কাজেই তিনি যখন আমার কক্ষে এলেন, ঠিক একই রকমভাবে আমি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছি। এ জন্য যদি আমার কোন অপরাধ হয় সেজন্য কার সাহেবই দায়ী।”
মেয়ট সাহেব সকৌতুক আস্যে অসীম সত্যবাদী ঈশ্বরকে অভিযোগ মুক্ত করেন।
যে বালক শুধুমাত্র অন্যের হুকুম না মানা মনোভাবে স্নান করতে অথবা না করতে বেধড়ক ঠ্যাঙ্গানি খেয়েও মচকায় নি, নিতান্ত স্নেহশীলা রাইমণি বুকে আগলে না রাখলে কী যে হতো ভাবতেই হস্তপদ শীতল হয়ে যায়-তার এই ব্যবহারই বুঝি শোভা পায়।
এস্থলে আমাদের অন্যান্য বহু মনীষী আছেন, যাঁরা বিজাতীয় ভাষায়, দেশে ও বিদেশে,বিজাতীয় পোষাকে বক্তৃতা করে বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁদের কথা লিখে এই লেখাকে ভারবিড়ম্বিত করবো না। শুধু বিষমৃত এই ঈশ্বরের সঙ্গে বন্দে মাতরম গানটির স্রষ্টার একটা ছোট্ট তুলনা টানবো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু সে ছিলো দায়িত্বহীন ক্ষমতা। ১৭৬৫ সনের ১২ই অগাস্ট দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। বেনিয়ারা বলপূর্বক সমস্ত খাদ্যশস্য মজুদ করে’ রাখে (বর্তমান কৃষিবিলের সমতুল্য), যাতে ভবিষ্যতে অধিক মূল্যে বিক্রয় করা যায় (লেখক ইংরাজ লেখক ইয়াং হাসবেন্ড)। কিন্তু মানুষের কাছে তৎপরিমাণ ক্রয়যোগ্য অর্থ ছিলো না। ফলাফল বাংলা ১১৭৬ (১৭৭০ খৃষ্টাব্দ) সনের ভয়াবহ মন্বন্তর। প্রায় দেড় কোটি মানুষ অনাহারে মারা যায়। এর আরম্ভ হয় ১৭৭৬ সনের শীতকালে। এই অভূতপূর্ব মন্বন্তরকালে নরমাংস ভোজনের তথ্যও লিপিবদ্ধ আছে। তথাপি ঐ বৎসর ওয়ারেন হেস্টিংস ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিকদিগকে (ডিরেক্টর) ওয়ারেন হান্টার এক প্রতিবেদনে বলেন “এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর পরেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লভ্যাংশ বেড়েছে।” সুতরাং অত্যাচারের মাত্রা অনুমেয়।
তৈরি হয় গণ অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি (উত্তর বঙ্গের ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ উল্লেখ্য)। এই সময়ে ১৮৮০-৮১ সনে ভাবুক ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন “আনন্দমঠ”। মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের জ্বলন্ত চিত্র হিসেবে।
অথচ সেই সময়ে অনাহারে মৃত দেড় কোটির মধ্যে মুসলমান বড়ো কম ছিলো না। এবং অত্যাচারী মুসলমান শাসকদের পতনে দরিদ্র মুসলমান দরিদ্রতর হয়। উত্তরবঙ্গের ফকির আর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিলো ঘোরতর অসঙ্ঘবদ্ধ। এবং তারা কখনোই শৈব ছিলো না। এরা ছিলো বাউল ফকির সন্ন্যাসী। চাকুরী বড়ো বালাই। বঙ্কিমচন্দ্র ওদের শৈব বানালেন। এমনকি বৈষ্ণবদের দেখি প্রতিশোধস্পৃহায় তরবারিতে শান দিতে। শুধু মন্বন্তরের বর্ণনা মোটামুটি বাস্তব। কারণটি নয়। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং সাফাই গেয়েছেন এটা ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, আমার মতে বিষবৃক্ষ রোপণ।
বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় চিরকালই বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ব্রিটিশ পূজারী। সুতরাং তাঁর লেখা বন্দেমাতরম জাতীয় সঙ্গীত হলো। আর শিরদাঁড়া সোজা রাখা বিটলে বামুন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলো।
আমাদের দরিদ্র তোৎলা ব্রাহ্মণ কখনোই ব্রিটিশ তোষণ করে নি। হ্যাঁ সত্য যে সক্রিয় হয়ে পিস্তল নিয়েও নামে নি।কখনও বা ঈশ্বর ছিলো নিখুঁত বাঙালি, কখনও ছিলো অনেক বেশী ইংরাজ (কর্মজীবনে পাওয়া যাবে)। তবে ঈশ্বরের কর্মপরিধি ছিলো বাঙালির মননের উন্মেষ, পাশ্চাত্যের সকল আধুনিকতার ছোঁয়া পিছিয়ে পড়া বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে দিতে চেয়ছিলো। ইংরাজিতে গণিত, বিজ্ঞান, নারীশিক্ষা, বাংলা ভাষার বাস্তবে উত্তরণ, বিধবাবিবাহ, নারী স্বাবলম্বী হওয়ার বীজতলা ঈশ্বরের করা। হয়তো বা সেই কারণেই আজ বিদেশপ্রীতি, ধর্মান্ধতা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা, ভক্তিবাদ আর মৌলবাদের যুগে ঈশ্বরের প্রয়োজন এত অধিক।
ইচ্ছে আছে পরবর্তী দুটি পর্বে ঈশ্বরের কর্মজীবন ও বঙ্গসমাজ নিয়ে লেখার।
ইতি ষষ্ঠস্য সর্গস্য সমাপ্তিমিদম্।