(ভাষায় যতদূর সম্ভব বিদ্যাসাগরী প্রভাব বজায় রেখেছি। তথ্য ব্যতীত কোনস্থলে কোনও প্রতিলিপি হয়নি। হলে উদ্ধৃতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে)
ঈশ্বরের কর্মজীবন মানে একটি পুনরাবৃত্তির ইতিহাস। চাকুরি ছাড়া এবং নতুন চাকুরি গ্রহণ করা। এ যুগে এ অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনামাত্র। বর্তমানে পড়াশোনা করাই হয় চাকুরী করার নিমিত্ত। সুতরাং একটি ত্যাগ করে অপর চাকুরিতে উচ্চ বেতনে যোগদান নিয়মিত নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। তাহলে আমার ঈশ্বরের চাকুরি ত্যাগও কি সেই হেতু? প্রশ্ন ওঠে। উত্তর দিয়ে লিখনী আরম্ভ করাই বিধেয়। ঈশ্বর ছাত্রস্বার্থে যা কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছে, অথবা আত্মসম্মান বজায় রাখার চেষ্টায়, প্রতি ক্ষেত্রে চাকুরি পরিত্যাগ করেছে। যদিও বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার বিস্তার, বাংলা ভাষার উত্তরণ ছিলো তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এবার মূল বিষয়ে প্রবেশ করা যাক।
ঈশ্বরের কর্মপদ্ধতি বিচারে ওর মূল অবদান আমার চোখে গুরুত্ব অনুযায়ী ক্রমপর্যায়ে সাজিয়ে লিখছি।
এক) শিক্ষা বিস্তারে অবদান
দুই) বাংলা ভাষার উন্নতি
তিন) নারীশিক্ষার প্রয়াস
চার) বিধবাবিবাহ (আরও বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায়)
পাঁচ) বহুবিবাহ রোধের প্রয়াস
ছয়) বাল্যবিবাহ রোধের প্রয়াস
এবার আমরা যদি ঈশ্বরের কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করি তাহলে আশ্চর্যজনকভাবে খুঁজে পাবো, ঈশ্বরের প্রথম চাকুরি ছিলো সেরেস্তাদারের (১৮৪১-১৮৪৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের সেরেস্তাদার। কিন্তু তদপেক্ষা আশ্চর্যের, ঈশ্বরের আবেদনপত্রটি নিখুঁত ইংরাজিতে লেখা। কিন্তু না, সামান্য প্রমাদ ঘটলো। ঐ চাকুরি করাকালীন বিলাত হতে আগত সাহেবদিগকে হিন্দি শিক্ষাদানের দায়িত্ব ঈশ্বর স্বেচ্ছায় স্বস্কন্ধে বহন করে। কিন্তু পরীক্ষক হিসেবে ঈশ্বর ছিলো বড়োই কঠোর। বিলাত থেকে আগত সাহেবদিগ বাঙলা ও হিন্দিতে অকৃতকার্য হলে আবার স্বগৃহে ফেরত পাঠানো হতো। সর্বাধ্যক্ষ মার্শাল সাহেবের সনির্বন্ধ অনুরোধেও ঈশ্বর নমনীয় পরীক্ষক হতে অস্বীকার করে। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহোপলক্ষে জননী ঈশ্বরকে অতি অবশ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ছুটি মঞ্জুর না হওয়ায় ঈশ্বর মার্শাল সাহেবকে বলেন “হয় ছুটি মঞ্জুর করুন নচেৎ এস্থলে আমার কর্মজীবন অদ্যই সমাপ্ত।”
সাহেব ছুটি মঞ্জুর করেন। কথিত আছে ঈশ্বর উক্ত দিবসে বর্ষার উন্মত্ত দামোদর নদ সন্তরণে অতিক্রম করেন (চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা৮৬-৮৮)। যদিও ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এই তথ্য স্বয়ং অস্বীকার করেন।
সংস্কৃত কলেজের সহকারী সচিব পদে পঞ্চাশ টঙ্কা মাহিনায় নিযুক্ত হন, এবং ঈশ্বরের সুপারিশক্রমে পরিত্যক্ত পদে যোগ্য ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন যোগদান করেন। ১৮৪৭ সনে ফোর্ট উইলিয়ামে পদত্যাগ পত্র জমা করে, রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে রাজজামাতা শ্রীনাথচন্দ্র এবং অমৃতলালের নিকট নিয়মিত ইংরাজি অধ্যয়ন করতেন (করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রমিত্র, পৃষ্ঠা ১১১)। ছাত্রদিগের উন্নতিকল্পে সচিব রসময় দত্তের নিকট কিছু প্রস্তাব পেশ করেন। রসময় দত্ত সেই প্রস্তাবসকল বিস্তর পরিবর্তন করে’ তৎপর অনুমোদন দ্যান। ফলাফল পুনরায় পদত্যাগ।রসময়বাবু বলেন “ঈশ্বর চাকরি ছেড়ে দিলো এরপর খাবে কী?”
শোনা যায় ঈশ্বর প্রত্যুত্তরে বলেন “দত্তমশায়কে বোলো, বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে, প্রয়োজনে মুদীর দোকান খুলে খাবে; কিন্তু যে চাকরিতে সম্মান নেই সে-চাকরি করবে না”।
১৮৪৯,পয়লা মার্চ। আবার চাকুরি! আবার ফোর্ট উইলিয়াম। এবার মুখ্য লেখক ও কোষাধ্যক্ষ। এই সময় পঞ্চম সহোদর অনুজ আট বৎসর বয়সে হরিশচন্দ্র পাঠাভ্যাস নিমিত্তে কলকাতায় এসে বিসূচিকা রোগে মৃত্যুবরণ করে।
১৮৫১ সনে মাসিক দেড়শত টঙ্কায় আমার ঈশ্বর পুনরায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে।
সন ১৮৫২ থেকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তির জন্য ভর্তি হ’তে দুটাকা লাগবে এবং হাজিরা খাতায় উপস্থিতি কম হ’লে নাম কাটা যাবে। সুতরাং পূর্বের অনিয়মিত ছাত্ররা নিয়মিত হ’লো এবং পঠনপাঠনে বাধ্য হ’লো। এবং আমাদের ঈশ্বর ইংরাজি অবশ্যপাঠ্য করে দিলো; প্রথম ইংরাজি শিক্ষক প্রসন্ন কুমার সর্বাধিকারী। সংস্কৃতে লিখিত পুরাতন পুঁথি ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করলো। সহজ ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করলো। প্রবর্তন করলো পাশ্চাত্যের আধুনিক গণিত শাস্ত্র। সবথেকে বড়ো কথা আগে সংস্কৃত কলেজে ছিলো কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্যের প্রবেশাধিকার।ঈশ্বর সবার জন্য দ্বার অবারিত করে দিলো। অবশ্যই বেথুন সাহেবের অনুমতি নিয়ে।
১৮৫৪ সনে হ্যালিডে সাহেব ছোটলাট হয়ে শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমার ঈশ্বর একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করলো। সেটির অংশবিশেষ এস্থলে পেশ করা হচ্ছে।
(১) বাংলাশিক্ষার বিস্তার করা আশু প্রয়োজন।
(২) কেবল লিখন পঠন ও গণনা বা সরল অঙ্কের মধ্যে বাংলাশিক্ষা সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। জ্যামিতি,পাটীগণিত, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি এতে সন্নিবেশিত করতে হবে।
এস্থলে পন্ডিতদের মাহিনাপত্র এবং নির্দিষ্ট পরিদর্শক নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
….
(১৭) বর্তমান গুরূমশাইরা এদেশের যে পাঠশালাগুলো চালাচ্ছেন সেগুলো কোনও কাজেরই নয়। যে কাজে তাঁদের যোগ্যতা নেই সময় কাজে তাঁদের নিযুক্ত করায় পাঠশালাগুলির অবস্থা শোচনীয়….
সূক্ষ্মতর বিভাগ ব্যতিরকে মোট ঊনিশটি পরামর্শ।এ বং সেগুলি গৃহীত হয়।
স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহ; পরস্পর সম্পৃক্ত এই দুটো পরবর্তীতে প্রকাশ্য।
ইতি সপ্তমসর্গস্য সমাপনম।