ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তার মেয়ের জন্য, স্বামীর সাথে। চিরাচরিত মাথাব্যথা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, ব্যবহার খারাপ, ইত্যাদ্ প্রভৃতি। অনেকদিন ধরেই ভদ্রমহিলার স্বামী কোনো একটা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। শীর্ণ দীর্ণ,ক্ষয়া, চেহারা, দেখলেই মন ছ্যাৎ করে ওঠে।
মেয়ের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে দৃশ্যতই বারে বারে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন মা। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন এই মায়েরা অতি সহজলভ্য একটি প্রজাতি। অন্তহীন সমস্যা বলতে বেশি উৎসাহী, যেসমাধানই দেওয়া যাক, সবেতেই সমস্যা, এবং প্রায় সব ব্যাপারেই কিছু না কিছু জ্ঞান- এই হচ্ছে এই মায়েদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অনেকসময়ই সমস্যার সূত্রপাত না হোক, সমস্যা বজায় রাখতে এনাদের অত্যাধিক উদ্বেগ একটা বড় ভূমিকা নেয়, বলাই বাহুল্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এনাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য খুব কমন। খুঁতখুঁতে, বদরাগী, জেদী এবং একটা ভীষণ সবকিছু নিজের মত অনুযায়ী করার চেষ্টা। পরিভাষায় যাকে বলে need for control.
যাই হোক, আজকের এই মাটি এই প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্না হয়েও যেন তার বাইরে একটু বেশি কিছু। বেশ একটা চটকদার সৌন্দর্য্য আছে যা বেশ চোখ টানে। এককথায় বেশ সুন্দরী, বয়েস খুব বেশি হলে মধ্য-তিরিশ। চিকিৎসকরা বলাই বাহুল্য বহু বছরের পেশাদারী প্রশিক্ষণে রোগিনীদের প্রতি কোনো বিশেষ অনুভূতিহীন হন। কিন্তু এনার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা ঠিক ভাষায় বোঝানো মুস্কিল।
দ্বিতীয় ভিজিটে সেই মা দেখা গেল নিজেরও নাম লিখিয়েছেন রোগীর খাতায়। বয়েস জানা গেল ৩৫ বছর, সমস্যা সেই মাথাব্যথা, ঘুম নেই, খিদে নেই, কথায় কথায় রাগ, এমন অনেক কিছু। মন যথারীতি ভালো থাকে না, তবে সেটা স্বামীর শরীর, মেয়ের পড়াশোনা, ইত্যাদির জন্যেই বলে বার বার জানালেন। কিন্তু ঐযে যাকে বলে, রোগী দেখে চুল পাকিয়ে ফেলে, কি জানি কিছু একটা যেন খটকা লাগছিলো। এত স্বাভাবিক কারণে ডিপ্রেশন – এতটাই স্বাভাবিক যে ঠিক যেন হজম হচ্ছিল না। যাইহোক, প্রথাগত ওষুধ দিয়ে যথাযথ জ্ঞান বিতরণপূর্বক আবার একমাস বাদ আসতে বলে পরের রোগীর ডাক দেওয়া গেল।
মাসখানেক পরের মোলাকাত। প্রত্যাশা মতই জানালেন ” কিসসু সারেনি”, ওই একটু ঘুমটা ঠিকঠাক হচ্ছে, আর বাকি সব একই আছে। যাইহোক, কেন সারেনি ,কতটা সারেনি তার চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় ধীরে ধীরে উনি মেনে নিলেন যে উনি বেশ খুঁতখুঁতে শুধু তাই নন, কোনো অন্যায় মানতে পারেন না, এবং কোনো কিছু যদি মনে হয় খারাপ বা ঠিক নয় তাহলে সেটা কোনো ভাবে মানতে পারেন না।
প্রশ্ন করলাম, ” ঠিক কি নিয়ে কষ্টে আছেন বলুন তো? কেন জানি না আপনার গল্পটা ঠিক হজম হচ্ছে না”.
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন “জেনে লাভ আপনার? সমাধান করতে পারবেন ?”
বললাম “বলেই দেখুন না”.
তিনি বললেন – “আচ্ছা, ডাক্তারবাবু, আমি দেখতে ঠিক কেমন? খুব খারাপ?”
“একেবারেই না । বরং ঠিক উল্টোটাই”।
-“আমার স্বামী আমার থেকে চোদ্দ বছরের বড়। দেখেশুনে বিয়ে, নিজে করিনি কিন্তু। ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে যা ঠিক করেছিল, তাই মেনে নিয়েছি। স্বামী আজ বারো বছর শয্যাশায়ী প্রায়। অনেক প্রলোভন এসেছে, কিন্তু আমার সংস্কার আমায় কোনো অন্য পথে পা বাড়াতে দেয় নি। কিন্তু আমিও তো মানুষ ডাক্তারবাবু। এভাবে আর কতদিন বলতে পারেন? আমার এই বয়েস আর কি ফিরবে ডাক্তারবাবু ? বলুন, পারবেন এর সমাধান করতে ? কি হবে ডাক্তারবাবু আমার ওষুধে? বলুন, জবাব দিন।”
নাহ্, জবাব ছিল না। ভদ্রমহিলা আর আসেননি। সব রোগ তো আর সারে না। সব প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যায় না। আমাদের সংস্কার , আমাদের superego আমাদের মনের চাওয়া পাওয়াকে আস্তে আস্তে একসময় মেরে ফেলে। কেউ কেউ sublimate করে অন্য কিছুতে মনপ্রাণ ঢেলে দেই, কেউ বা হয়ে যাই খিটখিটে, খুঁতখুঁতে, ….আর রাতে বালিশ ভিজে যায় কান্নায়।