1978 সাল। জুলাই মাস। ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যাম হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড। হাসপাতালে প্রতিদিন জন্ম নেয় কত শিশু – কিছু স্বাভাবিক পথে, কিছু সিজারিয়ান সেকশনে অর্থাৎ পেট কেটে – মা-বাবার চোখে প্রতিটি জন্ম স্মরণীয় হলেও, হাসপাতালে এ নেহাতই রুটিন ব্যাপার। কিন্তু, এই একটি জন্ম যেন হাসপাতালের চোখেও বিশেষ। যাবতীয় আগ্রহ সিজারের জন্য প্রতীক্ষা করা এক মায়ের কেবিনের দিকে। মিডিয়ার যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রে ওই একটি কেবিনের দরজা। পরিস্থিতি দেখে গাইনোকোলজিস্ট ডাঃ প্যাট্রিক স্টেপটো তাঁর পেশেন্ট লেসলি ব্রাউনের কেবিনের জন্যে বিশেষ রক্ষীর বন্দোবস্ত করার দাবি করলেন – কিন্তু, সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলো। যতোই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্মের সম্ভাবনা হোক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো এক বিশেষ রোগীকে বিশেষ সুবিধে দিতে পারেন না। পক্ষে থাকা মিডিয়া তো বটেই, এতদিন ধরে আইভিএফ-এর আদ্যশ্রাদ্ধ করা মিডিয়াও বৈরিতা ভুলে জমা হয়েছে ওল্ডহ্যাম হাসপাতালের সামনে।
1978 সালের পঁচিশে জুলাই, রাত্রি এগারোটা সাতচল্লিশ – জন্ম নিলো পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম টেস্টটিউব বেবি। শিশুর বাবামায়ের নামের চাইতেও এ শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে অমর হয়ে গেল দুই বিজ্ঞানীর নাম – রবার্ট এডওয়ার্ডস ও প্যাট্রিক স্টেপটো। অনেক বিতর্ক ছিল। মূলত “ঈশ্বরের ইচ্ছা”-কে অতিক্রম করে মানুষেরই ঈশ্বর হতে চাওয়ার উচিত-অনুচিত নিয়ে। কিন্তু সংসারের আরো অনেক ঝগড়াঝাঁটি বিতর্কের মতোই, একটি শিশুর জন্ম থামিয়ে দিল অনেক প্রশ্ন। বিজ্ঞানীমহলের সংশয়, ধর্মযাজকদের প্রশ্ন সম্পূর্ণ বন্ধ না হলেও মিডিয়ার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে গেল জনসাধারণের মধ্যে – বৃহত্তর সমাজে আইভিএফ তথা টেস্টটিউব বেবির গ্রহণযোগ্যতা পেতে সমস্যা হল না। প্রথম টেস্টটিউব বেবির নাম হল, লুইজি ব্রাউন।
বৃহত্তর সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বলতে আমি আমজনতার কথা বলছি। সন্তানধারণে অক্ষম দম্পতি আইভিএফ মস্তবড় আশীর্বাদ হিসেবে দেখলেন। টেস্টটিউব বেবি যে গ্রহান্তরের প্রাণি নয়, সেটুকু বুঝতে সমাজের সাধারণ মানুষের সময় লাগল না বেশী। একটা ছোট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। লুইজির জন্মের চার বছরের মাথায় তার বোন নাতালি ব্রাউনের জন্মও ওই আইভিএফ পদ্ধতিতে – সে পৃথিবীর চল্লিশ নম্বর টেস্টটিউব বেবি। আইভিএফ পদ্ধতির তখন শুরুর দিন এবং বিশ্বের সর্বত্র এই পদ্ধতির সুযোগও সেভাবে ছিল না৷ এই কথাগুলো মাথায় রাখলে মাঝের চারবছরে চল্লিশটি টেস্টটিউব বেবির সংখ্যাটা নতুন পদ্ধতির প্রতি সাধারণ মানুষের বিপুল আগ্রহের কথা বলে। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মমত-অধ্যুষিত তথাকথিত উন্নত পশ্চিম দেশে আইভিএফ-এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার কাজ সহজ হয়নি। উচিত-অনুচিতের বিতর্ক বন্ধ হয়নি সহজে। বিংশ শতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ কিছু আবিষ্কারের অন্যতম এই ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, তার জন্যে বিজ্ঞানের সবচেয়ে পরিচিত স্বীকৃতি অর্থাৎ নোবেল পুরস্কার দিতে গড়িয়ে গেল চার দশকেরও বেশী সময়। রবার্ট এডওয়ার্ডস নোবেল পুরস্কার পান 2010 সালে – প্যাট্রিক স্টেপটো মারা যান অনেক আগেই, তাঁর বরাতে এই স্বীকৃতি জোটেনি।
রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটোর নাম চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে আইভিএফ-এর জনক হিসেবে। বিজ্ঞানের ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর – ফিনিশিং লাইন স্পর্শ যিনি করছেন দ্বিতীয় হিসেবে, সকলে বড় সহজে তাঁর কথা ভুলে যায়। অথচ আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলে হয়ত অনেকসময়ই দেখা যায়, দ্বিতীয় বা তৃতীয় মানুষটির যাত্রাপথ ছিল ঢের বেশী চ্যালেঞ্জিং – অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তাঁকে পৌঁছোতে হয়েছে এই দৌড়ে। না, সঠিক সুযোগ পেলে তিনি প্রথমকে টপকে যেতেন, এমন কথা বলছি না – শুধু বলতে চাইছি, প্রথম স্থানাধিকারী বাদে বাকিদের জন্যেও কিছুটা সময় বরাদ্দ করুন। আইভিএফ-এর গল্পে শুনতে হলে এডওয়ার্ডস-স্টেপটো বাদে অন্তত দুজনের গল্প জেনে রাখা জরুরি।
প্রথমে বলি ল্যান্ড্রাম শেটলসের কথা। কৃত্রিম পরিবেশে নিষেক নিয়ে একেবারে প্রথমসারিতে থাকা বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি একজন। কৃত্রিম পরিবেশে নিষিক্ত ডিম্বাণু কেমন করে গর্ভে প্রতিস্থাপন করা যায়, সে নিয়ে পুরো ষাটের দশক জুড়ে তিনি চেষ্টা করছিলেন। মুশকিল হল, সেই সময়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রভাব মার্কিন সমাজে প্রবল এবং এইধরনের গবেষণা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আপত্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেও এই গবেষণা এগোনো মুশকিল। তবু, শেটলস চোরাগোপ্তা গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। 1969 সালের নেচার জার্নালে এডওয়ার্ডস-স্টেপটোর গবেষণার খবর অগ্রগতি দেখে তিনি রীতিমতো চাপে পড়ে গেলেন। উচ্চতম পর্যায়ের বিজ্ঞানের মধ্যে প্রতিযোগিতা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা আর মনে না করালেও চলে। 1973 সালে একটি বিখ্যাত মামলায় (Roe vs Wade) মার্কিন আদালত গর্ভপাতের পক্ষে রায় দিলেন। কিন্তু শেটলস খুব সঙ্গতভাবেই অনুমান করলেন, এই রায়ের ফলে গর্ভপাতে ভ্রূণহত্যা বিষয়ক বিতর্কের সাথে সাথে উঠে আসবে আইভিএফ-এ ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার কথাও – অতএব, গবেষণার পথে আসতে শুরু করবে নতুন নতুন বাধা। অতএব, বিন্দুমাত্র দেরি করার সুযোগ আর নেই। অতিগোপনে এক সন্তানহীন দম্পতিকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন ল্যান্ড্রাম শেটলস। কলাম্বিয়া প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতালের আর কেউই জানতে পারলেন না সেকথা। কাজ এগোতে থাকল। যথাসময়ে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু জোগাড় করে পেট্রিডিশে নিষেকের পদ্ধতি শুরু হল। কিন্তু মুশকিল, আচমকা খবর পেয়ে হাজির হলেন শেটলসের বিভাগীয় প্রধান। বিভাগীয় প্রধানের দুশ্চিন্তা ছিল, একবার এই গবেষণার কথা জানাজানি হয়ে গেলে পুরো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে টানাটানি হবে। অতএব, ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দেন তিনি – এবং হাসপাতাল থেকে সাথেসাথেই বরখাস্ত হন ল্যান্ড্রাম শেটলস – শেটলসের আইভিএফ পথিকৃৎ হওয়ার স্বপ্নের ইতি সেখানেই। এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম পরিবেশে নিষিক্ত ডিম্বাণু ও ভ্রূণের গর্ভাবস্থায় প্রতিস্থাপনের ‘পরে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয় – কাজেই তৎসংক্রান্ত গবেষণাও ব্যাহত হয়। যেসময়ের কথা বলছি, রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটো তখন চূড়ান্ত সাফল্য থেকে বহুদূরে। এডওয়ার্ডস-স্টেপটোর সাফল্যের পর, যে দম্পতির শুক্রাণু-ডিম্বাণু কলাম্বিয়া প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নষ্ট করে ফেলেন, সেই দম্পতি হাসপাতালের কাছে দেড় মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলাও করেন। কিন্তু, সে তো ভিন্ন প্রসঙ্গ – আমরা আপাতত ভাবতে চাইছি, ঠিক কেমন হতো, যদি শেটলস সেই গবেষণায় সাফল্য পেতেন? বিস্মৃত এক নাম না হয়ে তিনি হয়ে উঠতেই পারতেন বিশ্ববিশ্রুত ও চিরস্মরণীয়, তাই না?
দ্বিতীয় নামটি আমাদের ঘরের গল্প। আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার ইতিহাসের গল্প করতে গেলে সেখানে ভারতীয় নামের অনুপস্থিতি রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। কেন? বিজ্ঞান-গবেষণার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই বলে? নাকি যোগ্য প্রতিভার অভাব? নাকি সামগ্রিক মানসিকতাতেই কোথাও পিছিয়ে আমরা? টেস্টটিউব বেবির প্রসঙ্গে এসে একটু ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের করুণ পরিণতির গল্পটা মনে করিয়ে দেওয়া যাক।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ডাক্তার। এমবিবিএস পাস করেন কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে পিএইচডি – বিষয় রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি। দ্বিতীয় পিএইচডি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে – বিষয় রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগে কাজ করার সময় তিনি গবেষণা শুরু করেন ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন নিয়ে। রবার্ট এডওয়ার্ডসের থেকে প্রায় দশ বছর বাদে এবিষয়ে গবেষণা শুরু করেন – এবং এমন এক পরিবেশে তিনি গবেষণা করেন, যেখানে বিষয়টির নামই বিশেষ কেউ শোনেননি।
এডওয়ার্ডস-স্টেপটোর হাতে প্রথম টেস্টটিউব বেবি জন্ম নেয় 1978 সালের পঁচিশে জুলাই। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার ফসল টেস্টটিউব বেবি জন্ম নেয় ওই একই বছরের অক্টোবর মাসে – পৃথিবীর দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবি – এমন এক দেশে, যেখানে এবিষয়ে গবেষণার ঐতিহ্য পরিবেশ ধারণা কিম্বা পরিকাঠামো, কিছুই ছিল না। 1978 সাল, তেসরা অক্টোবর – কলকাতা দূরদর্শনে দুপুর 11:44-এ ঘোষিত হল প্রথম ভারতীয় টেস্টটিউব বেবির জন্মগ্রহণের খবর। কী ভাবছেন? শোরগোল পড়ে গেল আর দিকে দিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সম্মান জানানোর প্রস্তুতি শুরু হল? ভারতের বিভিন্ন সম্মেলনে তিনি গবেষণার খবর জানালেন অবশ্যই – এবং সেখানে উপস্থিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিশেষজ্ঞরা তাঁর সাফল্যে চমৎকৃত হলেন। তবু, নিজের কর্মক্ষেত্রে এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের শেষে তাঁর বরাতে জুটল সম্মান বা স্বীকৃতির পরিবর্তে – অবিশ্বাস। তদানীন্তন রাজ্য সরকার তাঁকে সম্মানিত করার পরিবর্তে বসালেন তদন্ত কমিশন। তদন্তের বিচার্য –
১. ডাঃ মুখোপাধ্যায় দাবি করছেন, তিনি ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে দুর্গা নামক শিশুর কারিগর। এ কি সত্য?
২. তিনি দাবি করছেন, সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতির সাহায্যেই (অর্থাৎ সরকারের কাছে উন্নত পরিকাঠামোর দাবি না জানিয়েই) তিনি এত বড় যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এমনকি, তাঁর দাবি, মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপনের পূর্বে তিনি নিষিক্ত ডিম্বাণুটি রেখেছিলেন নিজের বাড়ির ফ্রিজে। এ কি আদৌ সম্ভব?
৩. সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার হিসেবে তাঁর দায়িত্ব এমন আবিষ্কারের কথা সর্বাগ্রে সরকারকে জানানো – আমলাদের কাছে গবেষণার রিপোর্ট পেশ করা। তা না করে তিনি সরাসরি মিডিয়ার কাছে চলে গেলেন কেন?
৪. নিজের কার্যকলাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে তিনি বারংবার নিজের গবেষণাকে সত্য বলে দাবি করেই চলেছেন। এ কি ঔদ্ধত্য নয়?
ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার সত্যতা যাচাই করার জন্যে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি বসল, তার নেতৃত্বে এক রেডিওফিজিসিস্ট। কমিটিতে একজন স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ থাকলেও আইভিএফ-সংক্রান্ত গবেষণার ন্যূনতম অভিজ্ঞতা আছে, এমন কেউই ছিলেন না। অবশ্য তেমন কাউকে পাওয়াও মুশকিল হতো – কেননা, আগেই বললাম, সেসময় এদেশে এমন গবেষণার কথা কেউই ভাবেননি। মোদ্দা কথা এই, ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের বিচার করতে যাঁরা বসলেন, তাঁদের মধ্যে খুব কমজনই একটি মানব-ভ্রূণ ঠিক কেমন দেখতে হয়, সে বিষয়ে অবহিত ছিলেন। তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তা সুভাষবাবু, আপনার এই ভ্রূণটি কোথায় রাখতেন? ডাঃ মুখোপাধ্যায় সিল-করা অ্যামপুলের ভরে ফ্রিজে রাখতেন শুনে প্রতিপ্রশ্ন আসে, সে কী!! অ্যামপুল সিল করার সময় গরমে ভ্রূণ মরে যেত না?
অতএব, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভণ্ড, ধাপ্পাবাজ ও মিথ্যেবাদী হিসেবে প্রমাণিত হন। কলকাতা থেকে দূরের বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে আগেই। গবেষণা চলেছিল তার মধ্যেই। কিন্তু ধাপ্পাবাজ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার পরে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় – ওই বছরেরই আঠাশে ডিসেম্বর, যেকোনো বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার আগে স্বাস্থ্যদপ্তরের আগাম অনুমতি গ্রহণ তাঁর জন্য আবশ্যক করা হয়।
1979 সালের শুরুতেই জাপানের কিয়োটো শহরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণা বিষয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত হন। ষোলই ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা তাঁর জাপানযাত্রার অনুমতির আর্জি নাকচ করেন – এবং এও জানান, কোনোকারণেই যেন ডাঃ মুখোপাধ্যায় দেশ ছাড়ার কথা না ভাবেন। হ্যাঁ, একটি গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের কাছ থেকেই এমন চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। এ আঘাত সামলাতে পারলেন না তিনি – কিছুদিনের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সরকারের কাছে বাড়ির কাছাকাছি বদলির আর্জি জানালেন – এবং কী আশ্চর্য, চটপট আর্জি মঞ্জুরও হয়ে গেল যেন – কলকাতা মেডিকেল কলেজের পাশেই রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজির ইলেকট্রোফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে বদলির নির্দেশ এলো। 1981 সালের পাঁচই জুন। আর পারছিলেন না তিনি। সব দরজা তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে আসছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর গবেষণার কথা তিনি আর কখনোই সবার সামনে জানিয়ে উঠতে পারবেন না, কেননা সরকার তাঁকে সম্মেলনে যোগ দিতে দেবেন না। এতদিন ধরে বড় জার্নালে নিজের গবেষণার কথা প্রকাশ করতে পারেননি – কেননা প্রথম সাফল্য খুব মিঠে হলেও গবেষণার ধাপগুলো আরেকবার পুনরাবৃত্তি করে না দেখা অব্দি সেটি বৈজ্ঞানিক নির্ভরযোগ্যতা পায় না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বুঝলেন, সে সুযোগও তিনি আর পাবেন না – তাঁকে বদলি করা হয়েছে এমন এক বিভাগে যেখানে বসে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব, সেই বিভাগ তাঁর গবেষণা থেকে বহুদূরের ব্যাপার এবং তাঁর আজীবন কাজের সাথে এই নতুন কর্মক্ষেত্রের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। আর সত্যিই পারলেন না তিনি। 1981 সালের উনিশে জুলাই। বদলির অর্ডারের চুয়াল্লিশ দিনের মাথায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, কবে হৃদরোগ এসে আমায় মুক্তি দেবে, তার জন্যে আর প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না।
ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ভুলেই গিয়েছিলেন সবাই, শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকজন বাদে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজির অধ্যাপক সুনীত মুখার্জি এবং কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সরোজ কান্তি ভট্টাচার্য – প্রথম টেস্টটিউব বেবির পেছনে এঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আসল মানুষটি ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই – অসম্ভবকে সম্ভব করার জেদটা ছিল তাঁরই। 1986 সালের ছয়ই আগস্ট আইসিএমআর এবং মুম্বাই কেইএম হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া হর্ষকে দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি এবং সেই টিমের নেতা ডাঃ আনন্দকুমারকে পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে সেই বিস্মৃতিতে সিলমোহরও পড়েছিল। কিন্তু আগেই যেকথা বললাম, কয়েকজন সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ভোলেননি।
1997 সাল। ডাঃ আনন্দকুমার ততদিনে দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জনক হিসেবে স্বীকৃত – খ্যাতির শিখরে তিনি। কৃত্রিম গর্ভধারণ বিষয়ক জাতীয় সম্মেলনের আসর সেবছর কলকাতাতেই। সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ বক্তা তিনি। উপস্থিত কয়েকজন প্রতিনিধি সেই সম্মেলনে একান্তে তাঁর হাতে তুলে দিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণাসংক্রান্ত ব্যক্তিগত নোটস। স্তম্ভিত এবং চমৎকৃত হয়ে গেলেন তিনি।
দেশকে আনন্দকুমারই জানালেন এক বিস্মৃত বিজ্ঞানীর কথা৷ সাথে জানালেন, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় শুধু বিশ্বের দ্বিতীয় টেস্টটিউব বেবি, তথা দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জনকই নন, বেশ কিছু বিষয়ে তিনি পথিকৃৎ –
১. পিতার শুক্রাণু কম হলেও কীভাবে আইভিএফ সম্ভব, সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিকা জারি করার দুবছর আগেই ঠিক একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন ডাঃ মুখোপাধ্যায়।
২. এডওয়ার্ডস-স্টেপটো ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করেছিলেন ঋতুচক্রের সময় মেনে। 1981 সালে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা প্রথম ওভারিয়ান স্টিমুলেশন পদ্ধতি অনুসরণ করে আইভিএফ করেন – এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ব জুড়ে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হয়। জানা গেল, এবিষয়ে পথিকৃতের স্বীকৃতি প্রাপ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরই – কেননা বিশ্ব জুড়ে এখন যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়, সেই হরমোন দিয়ে ওভারিয়ান স্টিমুলেশন সর্বপ্রথম করেছিলেন তিনিই।
৩. এডওয়ার্ডস-স্টেপটো ডিম্বাণু সংগ্রহ করেছিলেন জটিলতর ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে। ডাঃ মুখোপাধ্যায় অনুসরণ করেছিলেন সহজ পদ্ধতি – যোনিপথে ছোট ছিদ্র দিয়ে অনেক কম সময়ে সম্ভব কম জটিল সেই পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয় অনেক পরে – যোনিপথে (ট্রান্সভ্যাজাইনাল) আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বহুল প্রচলিত হওয়ার পরে এখন ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় যে পদ্ধতিতে, সেটির সাথে ডাঃ মুখোপাধ্যায় অনুসৃত পদ্ধতির হুবহু মিল।
৪. হরমোন দিয়ে ওভারিয়ান স্টিমুলেশন পদ্ধতিতে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে বিশেষ দ্রবণের মধ্যে রাখা শুক্রাণুর সাহায্যে নিষেক ঘটানো – নিষিক্ত ডিম্বাণুটি প্রাথমিক দশার ভ্রূণে রুপান্তরিত হলে তাকে ফ্রিজে তুলে রাখা – পরবর্তী স্বাভাবিক ঋতুচক্রের উপযুক্ত সময়ে ফ্রিজ থেকে ডিম্বাণু বের করে সেটিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে গর্ভে প্রতিস্থাপিত করা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই পদ্ধতিই এখন অনুসৃত হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র। হিমাঙ্কের নীচে ভ্রূণ সংরক্ষণ, হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রা নামানোর জন্যে উপযুক্ত যে রাসায়নিক উপাদান – প্রতিটির জন্যই কোনো না কোনো বিজ্ঞানী দুনিয়াজুড়ে পথিকৃতের স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছেন – কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায় সেই কাজ করে গিয়েছেন তাঁদের ঢের আগে।
আনন্দকুমারের নিরন্তর প্রয়াসে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্তত মরণোত্তর স্বীকৃতিটুকু পেলেন – জাতীয় স্তরে, এবং পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীদের তালিকায় তাঁর নাম ইদানীং পরিগনিত হয়। একথাও মোটামুটি নিশ্চিত, সময়ে বিশ্বের দরবারে পেশ হলে রবার্ট এডওয়ার্ডসের সাথে সাথে নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন আমাদের ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও – স্বাধীনতোত্তর দেশের প্রথম বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার – কেননা, আইভিএফ বিষয়ে তাঁর গবেষণা চলছিল এডওয়ার্ডস-স্টেপটোর সাথে একই সময়ে এবং তাঁর পদ্ধতি ছিল এডওয়ার্ডসদের চাইতে উন্নততর।
তবু কেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এমন করুণ পরিণতি? ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্য, সরকারি আমলাদের সবজান্তা মানসিকতা, সহকর্মীদের ঈর্ষা ইত্যাদি তো ছিলই – তার বাইরেও কিছু কথা রয়ে যায়।
বিজ্ঞানের আবিষ্কার আচমকা আকাশ থেকে পড়ে না। প্রদীপ জ্বলে ওঠার আগে সলতে পাকানোর পর্যায় থাকে, প্রদীপে তেল ঢালার পর্ব থাকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই পর্বগুলো এতখানিই লোকচক্ষুর অন্তরালে সম্পন্ন হয়েছিল, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময় – এবং সেখান থেকে অবিশ্বাস। পাশাপাশি এডওয়ার্ডস-স্টেপটোর কথা যদি মনে করি, তাঁদের কাজের প্রতিটি ধাপ ছিল বহুল-আলোচিত। কাজ নিয়ে বিতর্ক ছিল অবশ্যই, কিন্তু প্রাথমিক ধাপগুলো প্রকাশ্যে চর্চিত হওয়ার কারণেই চূড়ান্ত সাফল্যকে কেউই অবিশ্বাস্য মনে করতে পারেননি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় গবেষণা বিষয়ে এমন গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন কেন? আবারও মনে করিয়ে দিই, বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার বা তার অভিঘাতকে সময়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়। সেসময় ভারতবর্ষে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে – বিশ্ব জুড়ে সব উন্নয়নশীল দেশেই তাই। 1975 সালে সঞ্জয় গান্ধীর, জরুরী অবস্থার সুযোগে, বহুলনিন্দিত জোর করে ভ্যাসেকটমি করানোর কথা মনে করুন – এক বছরে ষাট লক্ষের বেশী মানুষের নির্বীজকরণ সম্পন্ন হয়, সংখ্যাটা হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বলপূর্বক নির্বীজকরণের পনের গুণ। এই বাড়াবাড়ির কথাটা যদি বাদও দিই, তবুও একথা অনস্বীকার্য, সেই সময়ে গর্ভধারণ সংক্রান্ত যা গবেষণা চলছিল, তার প্রায় প্রতিটিরই লক্ষ্য ছিল গর্ভধারণ বন্ধ করার নতুন কার্যকরী পথ খোঁজা – অর্থাৎ নতুন কোনো গর্ভনিরোধক যদি পাওয়া যায়, গবেষণা চলছিল সে নিয়ে। এমতাবস্থায় বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা বা কৃত্রিম গর্ভধারণ সংক্রান্ত গবেষণা প্রায় রাষ্ট্রের লক্ষ্যের বিপ্রতীপ। স্বাভাবিকভাবেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের গবেষণা চলেছিল কিছুটা গোপনে। পরবর্তী ক্ষেত্রেও গবেষণার কিছু ধাপ আরেকবার খুঁটিয়ে দেখে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করা অব্দি ডাঃ মুখোপাধ্যায় নিজের গবেষণার যাবতীয় তথ্য সকলের সামনে আনতে চাননি। রাজ্য সরকারকে তিনি নিজের গবেষণার সারমর্ম জানিয়েছিলেন অবশ্যই – কিন্তু বিশদ তথ্য তৎক্ষণাৎ জানানোর ব্যাপারে কিছু অসুবিধের কথা জানিয়েছিলেন, যা শেষমেশ তাঁর বিষয়ে অবিশ্বাসকেই আরো গাঢ় করে তুলেছিল। এসব কথার অর্থ কখনোই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি অবিচারের পক্ষে যুক্তি সাজানো নয়। সরকারি ঔদ্ধত্য, হৃদয়হীনতা, সবজান্তা মনোবৃত্তি এবং সহকর্মীদের তীব্র ঈর্ষা – এসবের পরেও কিছু ফ্যাক্টর ছিল, যা এক যুগন্ধর বিজ্ঞানীর স্বীকৃতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবু ভারতে বসে গবেষণা করে এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ – স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে যা অতি বিরল ঘটনা – তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ ভুলব কী করে!!