১ম পর্বের পর…….
ওরা যখন ট্যুরিষ্ট লজে পৌঁছল তখন লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় প্লেন বিভ্রাটে পড়ে একরাত থাকতে হয়েছিল এখানে। অ্যালায়েন্স এয়ারের টার্বোপ্রপ এয়ারক্রাফট কলকাতা থেকে উড়ে তেজপুর পৌঁছনোর পথে প্রবল ঝড়ে টালমাটাল হয়ে শিলচরে নামতে বাধ্য হয়। সেখানে এয়ারক্রাফটে তেল ভরে গৌহাটি নেমে গাড়িতে তেজপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে। ওই রাতে রিস্ক নিয়ে বমডিলা না গিয়ে ভালুকপংয়ে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ওদের।
তাই এখানকার ম্যানেজার, ওয়েটার অনেকেই মুখচেনা। ওরাই লাগেজগুলো কটেজে পৌঁছে দিল।
‘আপনারা ডাইনিংয়ে চলে যান। আর দেরী করলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
বিশাল কম্পাউন্ডে বেশ দূরে দূরে কটেজ গুলো। এক কোনায় গোলাকার গম্বুজের আকারের একটা বাড়ি। সেখানেই কিচেন আর ডাইনিং হল। ওরা দোতলায় উঠে একটা কোনার টেবিলে বসল।
এখন বেলা তিনটে। ডাইনিং হল মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে। শুধু উল্টো দিকের কোনায় এক দীর্ঘকায় শ্বেতাঙ্গ লোক বসে খাচ্ছে। খাচ্ছে বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। আসলে কাঁটা চামচ দিয়ে থালার উপর আস্ত একটা মাছকে কব্জা করার হাস্যকর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অরূপ উঠে গিয়ে সাহেবকে সাহায্য করার চেষ্টা করল।’ য়্যু লাইক ফিশ?’
‘ইয়েস।’
‘মে আই হেল্প য়্যু?’
‘মিট ভার্গনুগেন, সরি, মাই প্লেজার।’
‘আপনি কি জার্মান?’
‘না অষ্ট্রিয়ান। তবে এখন আমেরিকায় থাকি।’
অষ্ট্রিয়ানরাও জার্মান ভাষায় কথা বলে। যদিও তাদের ডায়ালেক্ট একটু আলাদা।
সাহেবের সাথে অরূপ বেশ জমিয়ে গল্প জুড়ে দিল। বিদিশা অন্য টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। শেষ পর্যন্ত সে বিরক্তি প্রকাশ করতে অরূপ সাহেবকে ছেড়ে এসে বিদিশার সাথে খেতে বসল।
‘কি কথা হল?’
লোকটার নাম ম্যাক্স মায়ার। অষ্ট্রিয়ান আমেরিকান। নামকরা প্রাণীবিদ। ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে এসেছে ডিব্রুগড় ইউনিভার্সিটিতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাণীবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছে।
বিদিশা মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিল। হঠাৎ বলে উঠল,’ ধ্যুৎ’
‘কি হয়েছে?’
‘দেখো না, ভাবলাম আজকের ছবিগুলো পোষ্ট করব। কিন্তু নেটওয়ার্ক নেই।’
‘তাই নাকি! খেয়াল করি নি তো।’
‘অথচ দেখো উপরে দিরাং থেকে অর্কিড সেন্টার- গোটা রাস্তায় নেট ওয়ার্ক ছিল।’
‘দেখো, বিএসএনএল থাকবে হয়ত।’
‘না, বিএসএনএলও নেই। গত তিনদিন ধরেই এরকম চলছে।’ খাবার দিতে আসা ছেলেটা বলল।
‘কেন?’
‘তা জানি না।’
‘আগে চলত?’
‘হ্যাঁ। বিএসএনএল, জিও, এয়ারটেল- সব।’
লাঞ্চের পরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে ওরা দুজনে জিয়াভরলি নদীর পাড়ে গেল।
অবশ্য সচারচর পাড় বলতে যা বোঝায়, এই নদীতে তা নেই। পাহাড়ি নদী কামেং সমতলে নেমেছে এখানে। নাম হয়েছে জিয়াভরলি। নদীর দুধারে বিস্তীর্ণ চর। তাতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নুড়ি পাথর। বিভিন্ন আকারের এবং বিভিন্ন রঙের। কত লক্ষ বছর ধরে নদী এইসব গোলগাল নুড়িপাথর পাহাড় থেকে বয়ে এনেছে কে জানে!
নির্জন নদীতীর। স্বচ্ছ নীল জল। খরস্রোতা নয়। দূরে দূরে ধূসর পাহাড়। সূর্য ঢলে পড়েছে দিগন্তে। নুড়ি পাথরের মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়।
অরূপ বলল, ‘সাবধানে চল। অন্ধকার হয়ে আসছে। সাপখোপ থাকতে পারে।’
বিদিশা নদীর পাড় বরাবর দূরে তাকিয়ে ছিল। ‘আরে, অর্কিড সেন্টারের সেই বাঙালী ভদ্রলোক না! সঙ্গে তোমার ওই অষ্ট্রিয়ান সাহেবও রয়েছে দেখছি। কি করছে ওখানে।’
অরূপ-ও অবাক হয়ে দেখল মানিক দাস আর মায়ার সাহেব নদীর দিকে পিছন ফিরে কথা বলছে।
‘একজন প্রাণীবিদ আর একজন উদ্ভিদবিদ। পরস্পরকে চেনে হয়ত।’
হয়ত তাই। তবে দুজনের মনেই সন্দেহ খিচখিচ করতে লাগল। অরুণাচল প্রদেশের এত কাছে একজন বিদেশী কি করছে?
(চলবে)