৪র্থ পর্বের পর……
পুলিশ এসে ডেডবডি মর্গে পাঠালো। মায়ারের মোবাইল ফোনটা পাওয়া গেল না। কিন্তু এক সেট ম্যানপ্যাক, ল্যাপটপ আর রেডিও ট্রান্সমিটার পাওয়া গেল ওর ঘরে।
ডেডবডির পোষ্টমর্টেম হবে। বিদেশী নাগরিক। পরিবারের লোকজনকে খবর দিতে হবে। এম্ব্যাসীতে জানাতে হবে। অনেক ঝামেলা।
পুলিশ তো রয়েছেই। সঙ্গে বেশ কিছু আধা সামরিক জওয়ান রাস্তার দিকটা পাহারা দিচ্ছে তখন।
পিছন দিয়ে নদীর দিকে যাওয়ার গেটের কাছে একটা গাড়ি ষ্টার্ট দেওয়ার শব্দ হতেই ওরা দুজনে সেদিকে দৌড়লো। পেছনের দরজা খুলে রিসর্টের ম্যানেজার সংগ্রাম বরজাতিয়া জীপে উঠতে দেখা গেল ।
‘চললেন কোথায়?’
‘স্ত্রী অসুস্থ। আমার তেজপুর যাওয়ার কথা আজ সকালে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ভদ্রলোকেরও অন্ধকারে ঘুরে বেরোনোর অভ্যাস ছিল। খুব সাপখোপ বেড়েছে আজকাল। আপনারা সাবধানে চলাফেরা করবেন। এখানকার সব ব্যবস্থা করা আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘আমাদের আর কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনার তো একটু অসুবিধা হয়ে গেছে।’
‘মানে?’
অরূপ তখন সাহেবের মৃতদেহের পাশে পাওয়া ধাতব চাকতিটা পকেট থেকে বের করে বলল,
‘এটা চিনতে পারেন? জার্মান সাহেবকে খুন করার সময় আপনার বন্দুক ওরফে সিরিঞ্জ, সরি, ছাতা থেকে এই পার্টসটা পড়ে গেছে। এটা যন্ত্রে লাগিয়ে নিন।’
মুহূর্তে মুখচোখ বদলে গেল সংগ্রামের। পকেট থেকে রিভলবার বের করতে যেতেই দুমম্ করে গুলির আওয়াজ হল সামনের গাছটার আড়াল থেকে। ডান হাত থেকে রিভলবার ছিটকে পড়ল সংগ্রামের। বাঁ হাত দিয়ে লম্বা ছাতাটা তোলার চেষ্টা করল সে। মানিক দাস গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সংগ্রামের ছাতাটা কেড়ে নিতে যেতেই অরূপ বলল, ‘সাবধানে হাত দেবেন, ভয়ংকর অস্ত্র ওটা। একেবারে মৃতদূত। ছাতার বাঁটের মধ্যে ্যে সাপের বিষ ভর্তি সিরিঞ্জ আছে।’
ততক্ষণে জওয়ানরা ওদের ঘিরে ফেলেছে। মানিকবাবুর ইশারায় দুজন উর্দিধারী এসে হাতকড়া পরালো সংগ্রামকে। ড্রাইভারটা নেমে পালাতে যাচ্ছিল। সেও ধরা পড়ল। একটু এগিয়ে এসে ফোনের ক্যামেরায় সংগ্রামের ঘাড়ের কাছে উল্কিটার ছবি তুলল অরূপ। তারপর ছাতাটা হাতে নিয়ে সুইচ টিপতেই ছাতার সরু মাথা থেকে একটা মোটা সূঁচ বেরিয়ে এল এবং তার থেকে টপ্ টপ্ করে স্বচ্ছ তরল পদার্থ পড়তে থাকল।সশস্ত্র পুলিশ-আধাসেনায় রিসর্ট ছয়লাপ। রাহুল সহ আরো আটজন ধরা পড়েছে ততক্ষণে। সিকিউরিটি ও পুলিশের বড় বড় গাড়ি ঢুকছে।
ডাইনিং হলে বসে চা খাচ্ছিল ওরা। বিদিশা ফোন নিয়ে খুটখাট করছিল।
‘আরে! ফোনের ভালো নেট ওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে এখন।’
‘পাওয়া যাবে। জ্যামার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ মানিকবাবু বললেন।
‘মানে? জ্যামার লাগানো ছিল না কি?’
‘হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরেই সমস্ত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো খবর পাচ্ছিল যে, অরুণাচল প্রদেশ আর আসামের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য এখান দিয়ে পাচার হচ্ছে। কিন্তু চক্রটাকে হাতেনাতে ধরা যাচ্ছিল না। তখন আমাকে আর ম্যাক্স মায়ারকে এখানে পাঠানো হয়।
অষ্ট্রিয়ান-আমেরিকান জুলজিষ্ট ম্যাক্স মায়ার দিল্লি ইউনিভার্সিটি তে পড়াতো ঠিকই, তবে আসলে ও হল ডাবল এজেন্ট। । কিন্তু ওর মিসেস চাইনিজ। সে হংকং এ থাকে। দিল্লিতে আইবি-র হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল মায়ার। কিন্তু সে গুণী লোক। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, চীনা, হিন্দী, অহমীয়া সহ অনেকগুলো ভাষা জানে। বিশেষতঃ চার রকমের চীনা ভাষা। ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার জীববৈচিত্র্য সম্পর্কেও অগাধ জ্ঞান। তাই অ্যারেষ্ট না করে ওকে কাজে লাগানো হয়। দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে ডিব্রুগড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই কাজে। আর আমাকে অর্কিড সেন্টারের ইনচার্জ করে দেয়।’
অরূপ বলল, ‘আমার সেরকম একটা সন্দেহ হল যখন দেখলাম যে, আপনি বারবার অর্কিড সেন্টার ছেড়ে এখানে আসছেন আর নদীর ধারে নির্জনে মায়ারের সাথে দেখা করছেন। তারপর, হঠাৎ গতরাতে দেখলাম স্যান্ডউইচের মধ্যে লুকিয়ে মেমরি কার্ড ট্রান্সফার হল। সেই লোকটাকে দেখলাম গলায় এইরকম উল্কি আঁকা।’
মোবাইলের ছবি দুটো খুলে দেখাল সে। একই উল্কি সংগ্রাম এবং সেদিনের সেই লোকটার গলায় আঁকা।
মানিক দাস ব্যাখ্যালে দিল ন, ‘এটা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটা গোপন সংগঠনের মার্কা। এর স্বঘোষিত কম্যান্ডার প্রদীপ শইকিয়া দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে চীনের চেংদু শহরে থাকে। ওখান থেকেই সংগঠন চালায়।’
‘গতরাতের কার্ড পাচারকারী লোকটার নাম কি?’
‘দীপেন মহিলারি। বোড়ো। ভয়ংকর লোক। অন্ততঃ বারোটা খুনের চার্জ আছে ওর উপরে। জ্যামার লাগাতেই ওরা বোধহয় বুঝে যায় আমরা সন্দেহের জাল গোটাচ্ছি। তাই তথ্য চালানের এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য ওকে নিয়ে আসে।’
‘কিন্তু তথ্যটা আসে কোথা থেকে?’
‘তদন্ত এখনো চলছে। সংগ্রাম তো বটেই, মনে হয় সংগ্রামের স্ত্রীও এতে জড়িত। সে তেজপুরে এয়ারফোর্সের স্কুলে কাজ করে। এছাড়া আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারে।’
কথা বলতে বলতে ফোন এল মানিকবাবুর কাছে। একটু আড়ালে গিয়ে দু-একটা কথা বলে এলেন তিনি। তারপর অন্য একটা ফোন বের করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মেসেজ টাইপ করলেন। তারপর বললেন, ‘দীপেন মহিলারি ধরা পড়ে গেছে। কলকাতা হয়ে ব্যাঙ্কক পালানোর চেষ্টা করছিল। ওর কাছে পাঁচটা মেমরি কার্ড আর মাইক্রোচিপ পাওয়া গেছে। সঙ্গে চামড়ার নীচে লুকোনো ট্রান্সমিটার। বেশ কিছু ম্যাপ আছে মেমরি কার্ডে। সঙ্গের তথ্য গুলো সব চাইনিজ স্ক্রিপ্টে লেখা। কিন্তু মান্দারিন নয়। ক্যান্টনিজও নয়। তাই উদ্ধার করতে সময় লাগছে। মায়ার বেঁচে থাকলে হয়ত সহজ হত। ওর মৃত্যুতে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে গেল! ‘
অরূপ বলল, ‘হোকিয়েন ভাষায় লেখা হতে পারে। চীনে চারটে ভাষা আছে।’
‘আপনাদের দুজনকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব!’
‘আমি পিএইচডি করার সময় হামবুর্গে ছিলাম। জার্মান ভাষা কিছুটা জানি। তাই মায়ারের সাথে আগ বাড়িয়ে আলাপ করেছিলাম। কার্ড পাচারের ভিডিও টা ও আমাকে পাঠিয়েছিল। ও বোধহয় বুঝেছিল, ওরা যেকোনো ভাবে ওর মোবাইল ফোনটা হাত করবে। তাই কোনভাবে আমাকে পাঠিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এভাবে খুন হতে হবে ভাবতে পারে নি।’
‘খুনটা সত্যি ইনোভেটিভ!’ মানিক দাস বলল।
‘না না, মৌলিক আইডিয়া নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় গুপ্তচর এজেন্সি গুলো এভাবে বিষ মাখানো ছাতা দিয়ে খুন করত। তবে এক্ষেত্রে মনে হয় চাইনিজ টেকনোলজি। ছাতার বাঁটের মধ্যে বিষের অ্যাম্পুল আর পিষ্টন ভরা আছে। ছাতার সুইচ চাপ দিলে মাথার দিক থেকে একটা মোটা ফাঁপা সূঁচ বেরিয়ে আসে। ছাতার ছদ্মবেশে বিষভরা সিরিঞ্জ।’
‘তোমার সন্দেহ হল কি ভাবে?’ প্রশ্ন করল বিদিশা।
‘প্রথমে আমার অনেককেই সন্দেহ হচ্ছিল। তারপর গতকাল রাতে আমি যখন সংগ্রামের থেকে ছাতাটা চাইলাম-ও আমার হাতে দিল না। তখন দেখলাম, ছাতায় একটা সুইচ আছে, কিন্তু সেটা দিয়ে ছাতাটা খোলে না। হাত দিয়ে ঠেলে খুলতে হয়। মনে প্রশ্ন এল, তাহলে সুইচটা কি জন্য আছে? সন্দেহ হল। তারপর আজ মায়ারের ঘরে ছাতার মাথার কাছের চাকতিটা খুঁজে পেলাম। আর তুমি বললে যে, চন্দ্রবোড়ার বিষে মায়ার মারা যায় নি। বিষটা নিউরোটক্সিন। শুধু তাই নয়, পায়ের ক্ষতটাও মোটেই সাপের কামড়ের মত নয়। তখন পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল।
পাচারের ঘটনাটা দেখে ফেলায় ওরা সেই রাতে আমাদেরও মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আগেভাগে ব্যাপারটা আঁচ করে ঘর ছেড়ে নদীর ধারে পালিয়ে যাওয়ায় বেঁচে গেছি।’
(শেষ)