ব্যথার অচলায়তন অতিক্রমণের এক প্রয়াস পর্ব ৩
ভিত্তিপ্রস্তর: পেইন-ক্লিনিক
কিন্তু কপাল মন্দ! মানিকতলা থেকে অফিসিয়ালি আমাকে সপ্তাহে মাত্র দুদিনের জন্য শিয়ালদায় পাঠানো হয়েছিল, তার ওপর আমার অর্ডারে কোথাও লেখা ছিল না যে শুধু পেইনের কাজ করার জন্য আমাকে শিয়ালদায় পাঠানো হচ্ছে। সুপার বেঁকে বসেন। আমাকে বলেন, “যে দুদিনের জন্য তোমাকে পাঠানো হয়েছে, সেই দুদিন তুমি অন্য ডিউটি করবে, তারপরে তুমি বুঝে নাও তুমি পেইনের কাজ কিভাবে করবে?”
কাজ করার উপায়টাও অবশ্য উনিই বাতলে দিয়েছিলেন, তখন নিয়ম ছিল—একটা নাইট করলে দুদিন অফ পাওয়া যেত। উনি আমাকে নাইট ডিউটি করার প্রস্তাব দেন। আমিও রাজি হয়ে যাই, আমি জানতাম আমার অমানুষিক পরিশ্রম হবে, পর পর দুদিন কাজ অর্থাৎ প্রথম দিন সকালে জয়েন করে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যে পর্যন্ত কাজ করতে হত। কিন্তু পেইন নিয়ে কাজ করার এই সুযোগ আমি হারাতে চাইনি। তাই চ্যালেঞ্জটা নিই। কারণ জানতাম কঠিন কাজ করতে হলে আমাকে চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করতেই হবে। তখন বৃহস্পতিবার নাইট ডিউটি করতে হত, শুক্রবার অর্থপেডিক্সের ওটি থাকতো বলে ডে-অফ পেতাম না। সেটা দেওয়া হতো মঙ্গলবার। ফলে মঙ্গলবার সকালে আর বৃহস্পতিবার সকালে ফাঁকা থাকতো। ওই দুটি দিনের মধ্যে মঙ্গলবার সকালে আউটডোর শুরু করি আর বৃহস্পতিবার ওটিতে ইন্টারভেনশনের কাজ করতাম। কাজ তো শুরু করা গেল, কিন্তু এবার চিন্তা শুরু হল অন্য জায়গায়। এখানে কোন সি-আর্ম মেশিন নেই, কিভাবে পেইনের কাজ করব? তখন একটুও দমে না গিয়ে সি-আর্ম ছাড়া যে কাজগুলো করা যায়, যেমন হাঁটুতে ইনজেকশন বা কাঁধে ইনজেকশন—এই কাজগুলো করতে থাকলাম। কিন্তু শিয়ালদা ইএসআইতেও পেইনের রোগী দেখার জন্য আউটডোরে কোনও জায়গা পাওয়া গেল না।
মঙ্গলবার অঙ্কোলজির আউটডোর ফাঁকা থাকত, প্রস্তাব দিলাম মঙ্গলবার সকাল বেলায় অঙ্কোলজির আউটডোরটা যদি পেইনের কাজ করার জন্য দেওয়া হয়। কিন্তু পেলাম না। তখন বাধ্য হয়েই সুপারের ঘরের পাশে থাকা এমার্জেন্সি রুমে একটা ছোট চেয়ার আর কম্পিউটার টেবিল নিয়ে বসতে লাগলাম। প্রাথমিকভাবে ওইগুলো দিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল। রোগীরা বাইরে সুপারের ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, নাম ধরে ডাকলে ঘরে যেত। আমি নিজেই শিয়ালদা থেকে মাইক আর স্পিকার কিনে একটা বন্দোবস্ত করেছিলাম। এমার্জেন্সি রুমের বাইরের দিকে মাইক্রোফোনটা ফিট করা হয়। রোগীরা যাতে শুনতে পায় তাই জোরে জোরে এক-দুই-পাঁচ-ছয় করে রোগীদের নম্বর ও নাম ডাকা হতো। স্পিকারটা সুপারের ঘরের দিকে থাকায় সুপারের কাজের অসুবিধা ঘটছিল, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।
ওই সময়টা আমার শেখার সময়, নিজের হাতে প্রতিটা রোগীর সব রেকর্ড খাতায় লিখে রাখতাম। আক্ষরিক অর্থে এই ভাবেই আমাদের আউটডোর শুরু হয়েছিল এখানে। এত চেষ্টার পরেও মাস তিন এই ভাবে চলার পর সুপার খুবই বিরক্ত হয়ে গেলেন। বলা যায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি আমাকে অঙ্কোলজির রুমে বসার অনুমতি দেন সেইসময়। আউটডোর চালু হওয়ার পর থেকেই প্রথম চিন্তা ছিল কিভাবে একটা সি-আর্ম মেশিন পাওয়া যায়! সুযোগটাও এলো হঠাৎ করেই। আউটডোরের একটা ভবন উদ্বোধন করতে শ্রমমন্ত্রী আসার কথা শুনেই সুপারের কাছে কথাটা পাড়লাম। সুপারকে বললাম, মন্ত্রীর সাথে কি দশ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে? সুপার ‘হ্যাঁ’ বললেন। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম, সম্মতি পাবার পর থেকেই মন্ত্রীকে দেখানোর জন্য একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। জানতাম যদি বোঝাতে পারি মুশকিল আসান হবেই।
ইএসআই-এর মুমূর্ষু ক্যান্সার রোগীদের ছবি জোগাড় করি, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যান্সার হয়েছিল এবং অপারেশন হয়েছে এমন ১৫-২০ টা ছবি বেছে নিই, পেশেন্টের আগের ছবি আর অপারেশনের পরের তোলা ছবি সেখানে রাখি, মন্ত্রী উদ্বোধনে এলে তাঁকে ওই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ছবিগুলো দেখানোর সুযোগ পেয়ে যাই। প্রেজেন্টেশনে প্রত্যেকটা ছবিতে রোগীর অবস্থা বর্ণনা করতে থাকি। ওই সব ছবি দেখে মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করেছিলেন “আমরা কি এই রোগীদের ব্যথা কমাতে পারি না?” ছবি দেখে আর সমস্যা শুনে হলের সব লোকেরা এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত আঁতকে ওঠেন! প্রেজেন্টেশন শেষে দেখি সবাই মাথা নিচু করে বসে আছেন।
মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে উনি হাত ধরে বলেন ‘এই ভয়ংকর পরিস্থিতি কি কমাতে পারি না?’ আমি বলি, “অবশ্যই পারি- এর জন্য পেইন ম্যানেজমেন্ট করতে হবে- নার্ভ ব্লক করতে হবে- কিছু ওষুধ দিতে হবে।” উনি প্রশ্ন তোলেন “তবে আমরা কেন এগুলো করতে পারছি না?” আমি বলি “এখানে কোন সি-আর্ম মেশিন নেই বলে। আপনি যদি মেশিন কিনে দেন তাহলে এই কাজগুলো করতে পারি”। মন্ত্রীমশাই মেশিনের দাম জিজ্ঞাসা করলে বলি- “একটা আট-দশ লাখ টাকার সি-আর্ম হলেই আমরা চালিয়ে নিতে পারব। উনি বলেন “এটা তো আমরা করতেই পারি, সুপারকে তাড়াতাড়ি সি-আর্ম কেনার প্রস্তাব পাঠাতে বলুন, আমার অনুমতি দেওয়াই থাকল”। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পেইন ম্যানেজমেন্টের হাসপাতাল চালু হোক সে ব্যাপারে তিনিও খুব উৎসাহিত ছিলেন।
আমাদের উদ্দেশ্য সফল। দ্রুত চিঠি দেওয়ার দু সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সি-আর্ম বসানোর অনুমতি পেয়ে গেলাম। তবে মেশিন কিনতে আরো তিন চার মাস সময় লেগে গিয়েছিলো। তার পেছনেও এক গল্প। মেশিন কেনা নিয়েও শুরু হলো জটিলতা। তখন যে ব্যক্তি ডেপুটি ডিরেক্টর পদে ছিলেন, তাঁর অফিস থেকে হঠাৎ করে খবর পাঠানো হয়- নতুন সি-আর্ম মেশিনটা মানিকতলা ইএসআই তে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, বদলে ওই হাসপাতালের পুরনো মেশিনটা এখানে আনা হবে। আমাদের তো শুনে মাথায় হাত। ফের বিষয়টা মন্ত্রীকে জানাই, মন্ত্রী কড়া ভাবে ওদের জানিয়ে দেন, ওইটি হবে না। ওনাদের দরকার হলে নতুন মেশিন কিনে নেবে। এই মেশিন শিয়ালদা ইএসআই-এর জন্যই। এবার স্বপ্নপূরণের পালা, ২০০৯ থেকে অফিশিয়ালি পেইন ক্লিনিক শুরু হয়ে যায় শিয়ালদা ইএসআই হাসপাতালে।
আমাদের অভিজ্ঞতা ও চেষ্টা দিয়ে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে এই ক্লিনিক। প্রথমদিকে মঙ্গলবার আউটডোর করে বৃহস্পতিবার ওটি রাখতাম। সারাদিন ওটি করার পর নাইট ডিউটি করে শুক্রবার ফের হাসপাতালের কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম। এইভাবেই কোন ছুটি না নিয়ে দীর্ঘ চার বছর ধরে এই কাজটি করে গেছি। ছুটি নিলে আউটডোর, ওটি সব বন্ধ থাকতো। এটা কিছুতেই মানতে পারতাম না।
২০০৯ সাল থেকে অঙ্কোলজির বোর্ডরুমেই পেইন ম্যানেজমেন্টের আউটডোর চলছিল। ততদিনে মন্ত্রীর কল্যাণে সি-আর্ম মেশিন পেয়ে গেছি। তিন দিন হাসপাতালে থাকতাম। মঙ্গলবার আউটডোর করে বৃহস্পতিবার সি-আর্ম দিয়ে অপারেশন করতাম। তখনো শিয়ালদায় সি-আর্ম মেশিন চালানোর লোক নেই। হাসপাতালের রেডিওগ্রাফারকে বলেছিলাম, কিন্তু উনি রাজি হলেন না। ওনার ধারণা ছিল সি-আর্ম মেশিনে শরীরের ক্ষতি হবে। ফলে শিয়ালদা ইএসআইতে সি-আর্ম অপারেটর পাচ্ছিলাম না, অগত্যা আমাকেই কাজ চালিয়ে নিতে হতো।
ওই হাসপাতালেই তপন রজক বলে একটি ছেলে ছিল। সে ইএসআই-তে চাকরি করতো না কিন্তু হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকতো। যেহেতু তার বাপ-ঠাকুরদারা এই হাসপাতালের গ্রুপ ডি কর্মী ছিলেন, সেই সূত্রেই তপন হাসপাতালে চা দিত। ওই চা দেওয়ার কাজ করতে করতেই হাসপাতালের অনেক কাজ ও শিখে নিয়েছিল, রোগীদের অনেক কাজও করে দিত। হাসপাতালের টুকটাক কাজে ওকে সবাই ডাকতো। যেহেতু পাশেই কোয়ার্টারে থাকতো তাই সহজেই ওকে পাওয়া যেত। তপন ছেলেটা ভালো ছিল, কাজ করার আগ্রহ ছিল বলেই ও সব কাজ নিজেই শিখে নিয়েছিল। এর জন্য কোন টাকা পয়সা পেত না, কিন্তু যা বলা হত আনন্দের সঙ্গে করে দিত। একদিন তপনকে ডেকে বলি “তুই ওটিতে সি-আর্ম অপারেট করবি? তাহলে তোকে শেখাবো।” সবাই জানতো আমার ওটিতে সি-আর্ম চালানোর লোক নেই, তপনকে বলায় ও সহজেই রাজি হয়ে যায়। তখন আমি আমার কাজ এগোতে সুপারকে বিষয়টা জানাই। সুপার বলেন, অন্য কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু টাকা দিতে পারব না। তপন তাতেই খুশি। ছেলেটা কোন পার্টি করত না, ফলে হাসপাতালে কোনো স্থায়ী কাজ হওয়ার সম্ভবনাও ছিল না। কিছুদিন কাজ করার পর সুপার সব দেখে শুনে আমাকে বলেন, “আমার কাছে ৪০০০ টাকা আছে আমি তা থেকে ওকে ২০০০ দিতে পারব। ওর সাথে অন্য কো্নো একজন ছেলে নেওয়া যাবে। তপন খুব তাড়াতাড়ি সি-আর্ম চালানো শিখে নেয়। রোগী তোলা- নামানো, ধোয়া মোছা সব কাজই আনন্দের সঙ্গে শিখলো ছেলেটা। ডাক্তার চলে গেলে রাতের দিকে তপন আবার রোগীদের খোঁজ নিয়ে আসতো, পরের দিন ডাক্তারকে সব রিপোর্ট করত। রোগীদের সাহস যোগাতো – তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখত। ওর ব্যবহারে রোগীরাও আনন্দ পেত।
এর অন্য একটা দিকও ছিল। তপনকে দেখেই ওটি টেকনিশিয়ানের কোর্স চালু করার ভাবনা আসে, যাতে তপনের মতো ছেলেরা শিখতে পারে, ওটিতে কিভাবে কাজ করতে হয়। ওটি টেকনিশিয়ান তৈরীর জন্য একটা সার্টিফিকেট কোর্সের কথা ভাবি, যেখানে তারা পরীক্ষা দিতে পারবে এবং সার্টিফিকেটের একটা দাম থাকবে যাতে সেই সব ছেলেরা ভবিষ্যতে কোন চাকরি পায়, এখানকার শিক্ষা কাজে লাগাতে পারে। এই কোর্সে আমি নিজেই শেখাতাম সবকিছু। তপন শিখতে শিখতেই পরীক্ষায় পাশ করল। ওটির দিন ওকে অনেক কাজ করতে হতো। সবাই ওর কাজে খুব খুশি ছিল। বৃহস্পতিবার প্রায় ১০-১৫ জনের ওটি হত, যেভাবে বইতে নির্দেশ দেওয়া ছিল ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতাম আমরা। ২০০৯ থেকেই শিয়ালদা ইএসআই এ পেইনের কাজ দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসতো। এমনকি ইউএসএ থেকেও কাজ দেখতে এসেছেন চিকিৎসকেরা।
চলবে…
অনুলিখন: শুক্লা সরকার ও পিয়ালী দে বিশ্বাস