পূর্বপ্রকাশিতের পর
লো ব্যাক পেইন ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন
সবচেয়ে বেশি মানুষ কোমরের ব্যথায় ভোগেন। সাধারণত কোমরের ব্যথা হলে মানুষ অর্থোপেডিক ডাক্তারদের কাছে যান। কেউবা নার্ভের ডাক্তারের কাছে যান, ডাক্তার নিজের জ্ঞান মতন চিকিৎসা করেন। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেশে লো ব্যাক-পেইনের চিকিৎসার কোনরকম গাইডলাইন ছিল না। মানুষ কারণে অকারণে এমআরআই করে ফেলেন, কেউ কেউ তো আবার অপারেশন করিয়ে সারা জীবন ভুগতে থাকেন। ব্যথার কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হয় প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের। শহরে তাও বা ব্যথার চিকিৎসা হয়। শুধুমাত্র ব্যথার চিকিৎসা করতেই বহু মানুষ গ্রাম থেকে মেডিকেল কলেজ গুলিতে আসেন। ভালো করে অনুসন্ধান করলে হয়তো বোঝা যাবে এইসব মানুষদের অনেকেরই কলকাতায় মেডিকেল কলেজে আসার মতন সিরিয়াস কিছু ছিল না, ওনাদের ব্যথা সামান্য কিছু ওষুধ ও নিয়ম মেনে চললেই হয়তো সেরে যেত। কিন্তু যেহেতু কোন প্রকৃত গাইডলাইন নেই- তাই কোথায় চিকিৎসা পাবেন বা কি চিকিৎসা পাবেন সম্পূর্ণ বিষয়টিও অনিশ্চিত। এই সমস্যায় পড়েই এখনও বহু মানুষকে গোলক ধাঁধার মতন বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানেই লো ব্যাকপেইন এর চিকিৎসার গাইডলাইন তৈরির চেষ্টা হয়েছে।
প্রথমে কুড়িজন স্পেশালিস্টকে একসঙ্গে জড়ো করি। কেউ অর্থোপেডিক্সের প্রফেসর, কেউ নিউরোলজি স্পেশালিস্ট, কেউ সাইক্রিয়াট্রির প্রফেসর, কেউ ফিজিক্যাল মেডিসিনের প্রফেসর, এমন কিছু মানুষ যাঁরা পেইন ম্যানেজমেন্ট চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করি। পৃথিবীজুড়ে লো ব্যাক পেইনের কি কি চিকিৎসা আছে বা তার গাইডলাইন আছে বা যে যে পাবলিকেশন আছে, এই সমস্ত তথ্য ভান্ডারকে সংগ্রহ করে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ গাইডলাইনটি কম্পিউটারের মেমোরিতে ঢুকিয়ে একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। এমনভাবে সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়, যেখানে কম্পিউটারকে প্রশ্ন করলে তার উত্তর পাওয়া যাবে। ধরা যাক রোগী কোমরে ব্যথার সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসলেন, চিকিৎসক তাঁকে যে যে সমস্যার কথা ও সমাধানের উপায় বলবেন তেমন ভাবেই কম্পিউটারও চিকিৎসকের মতই রোগের সমাধানের উত্তর দেবে। এইভাবেই লো ব্যাক পেইনের একটা এক্সপার্ট সিস্টেম তৈরি হয়েছিল যেখানে কম্পিউটার চিকিৎসকের অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর ভুমিকায় আছে। আসলে একটা হার্ডওয়ার (সফটওয়ার??) তৈরি করে, তা থেকে একটা ডিভাইস তৈরি করা হয়েছিল। এই ডিভাইসে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। সম্পূর্ণ কাজটা সমাপ্ত হওয়ার পরে এখন আমরা বলতে পারি যে এ রাজ্যে লো ব্যাকপেইনের গাইডলাইন তৈরি করেছি আমরা। এখন সবাই এটা ব্যবহার করছে অথচ কাউকে কোন কিছুই মুখস্থ রাখতে হচ্ছে না। ইন্টারনেটে কানেক্ট করে যে কোনো চিকিৎসক এই সিস্টেমকে ব্যবহার করতে পারবেন। গাইডলাইন তৈরি হওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছেন জেলার ও গ্রামের ডাক্তাররা, তাঁরা প্রাথমিক জ্ঞানভাণ্ডারটা হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। এখন নার্সদেরকেও এটা শেখানো হচ্ছে। হাসপাতালে এই অনুযায়ী চিকিৎসাও শুরু হচ্ছে। আগে রোগীদেরকে বহুদূর থেকে ব্যথার চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসতে হতো, এখন তা হবে না। এই গাইড লাইন সফটওয়্যার সিস্টেমের পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব, কারণ এই ধরনের কাজ আগে কোথাও হয়নি। ভবিষ্যতে এই গাইডলাইনের ওপরে নির্ভর করেই হয়তো অনেক দূর কাজ এগোনো যেতে পারে। পেইন ম্যানেজমেন্ট এর তত্ত্বাবধানে সারা দেশে কোমরে ব্যথার চিকিৎসার নির্দেশিকার একই রকম একটা রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া গেল। এর ফলে ব্যাকপেইনের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
আগেও গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচনা করেছি। গবেষণার বিষয়টি মাথায় এসেছিল অনেকগুলো চিন্তার কারণে। আমরা ব্যথার চিকিৎসা করছি ওষুধ দিয়ে অথচ আমরা নিজেরাই জানি না কোন ওষুধে কাজ হবে আর কোন ওষুধে হবে না। যখন ২০১০-এ বিদেশে ফেলোশিপ ডিগ্রি করে ফিরে আসি তখন ওই আমেরিকান চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়েই চিকিৎসা করতাম। অনেক সময়ই দেখা যেত ওই নিয়মে চিকিৎসা করেও রোগী কোনো ফল পাচ্ছেন না। আসলে আমাদের দেশের মানুষের সাথে ওই দেশের মানুষের শারীরিক অনেক পার্থক্য আছে তাই ওদের নিয়ম এদেশের মানুষের শরীরে খাটবে, সবসময় এমনটা নাও হতে পারে। ব্যথা হয় তো দু তিন মাস কম থাকছে বা যতটা আশা করছি ততটা কমছে না। এই সবগুলো আমি চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এর প্রমাণ দরকার ছিল। সেই কারণেই গবেষণা শুরু করি।
গবেষণা শুরু করতে গিয়ে প্রথমে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কারণ অনুমতি নিয়ে হাজার এক রকমের ঝামেলা হয়। আমলারা বলতে থাকেন “আপনার কাজ রোগের চিকিৎসা করা। আপনি কেন এসব করছেন? গবেষণা করবে মেডিকেল কলেজ, আপনার তো করার দরকার নেই এসব”। কিন্তু এইসব কথা আমাদের কাজকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। যুক্তি দিয়ে তাঁদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কখনো কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক লোক পেয়েছি, কখনো বা বিরোধিতা পেয়েছি। বিরোধী লোকেদের সঙ্গে তর্কে যাইনি, চুপ করে গেছি। আবার কেউ সহানুভূতিশীল হলে তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান করিয়ে, রোগীদের সমস্যা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। অনেক সময় সমস্ত কর্মকাণ্ড দেখে তাঁরা খুশি হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহুবার হয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে যাঁদের সাহায্য বহুবার পেয়েছি তাঁর মধ্যে ডা. অমিত চক্রবর্তীর কথা আমি আলাদা করে বলা দরকার।
আমার উদ্দেশ্যমত সমাজে ভালো কিছু কাজ করার চেষ্টা সম্পূর্ণতা পেয়েছে পেইন মানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে। এই যে ভালো কিছু কাজ করতে হবে সেই ইচ্ছের শিকড় নিহিত আছে আমার ছাত্রাবস্থায়। ডাক্তারি ছাত্র অবস্থায় আমি যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেখানে আমাদের শেখানো হয়েছিল তোমার জ্ঞানটাকে সমাজের সাথে মিশিয়ে দিও। সেই জ্ঞান শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরে কুক্ষিগত না রেখে সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের কাজে লাগাও। শুধু পরিচিতদের জন্য নয়, সমাজের সবার জন্য করো। কারণ সকল মানুষ সমান।
ডাক্তারি পড়ার সময় একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম। খুব মন দিয়ে রাজনীতি করতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে রাজনীতি থেকে পাওয়া শিক্ষা আমাদের কাজের মধ্যে প্রয়োগ করতে পারি। শুধু রাজনীতি করার জন্যই পাশ করার পরও কয়েক বছর মেডিকেল কলেজে থেকে গিয়েছিলাম। মেডিকেল কলেজ ছাড়ার পর ছত্তিশগড়ে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর শহীদ হাসপাতালে যোগ দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম।
প্রথম জীবনে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার সুযোগ পেয়েছি বহুবার, কিন্তু পেয়েও করিনি। কারণ সেই সময় অন্য একটা যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগী্র নেতৃত্বে ছত্তিশগড়ে তখন এক ব্যতিক্রমী স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে উঠছিল। স্বাস্থ্য যে মানুষের অধিকার হতে পারে, আন্দোলনের বিষয় হতে পারে সেকথা খেটে খাওয়া শ্রমিক মজুরদের বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। সেই বিশ্বাস থেকেই শ্রমিকরা নিজেদের একটি হাসপাতাল তৈরি করতে পেরেছিল। আমি ছত্তিশগড়ে গিয়ে সেই স্বাস্থ্য আন্দোলনে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। ছত্তিশগড়ের চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনো পোস্ট গ্রাজুয়েশনের প্রয়োজন ছিল না। এমবিবিএস করার পর হাউসস্টাফশিপে এমার্জেন্সি অপারেশন করতে শিখেছিলাম। তখন আমার মনে হত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি তৈরি । কিন্তু ছত্তিশগড়ে আমার আর যাওয়া হয়নি, যে সময় আমি শহীদ হাঁসপাতালে যোগ দেব বলে ভেবেছিলাম সেই সময় নিয়োগীজিকে হত্যা করা হয়। আমি আর যাইনি। কিন্তু আমার আদর্শকে আমি ছেড়ে দিইনি।
শেষ
অনুলিখনঃ শুক্লা সরকার ও পিয়ালী দে বিশ্বাস