২৩.১১.২০২২
বিষয়: ২১.১১.২২ তারিখে নবান্ন সভাগৃহে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক মিটিং
১. বিষয়: রুগী রেফার
২১.১১.২২ তারিখে, নবান্ন সভাগৃহে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠকের পর সাধারণ ভাবে চিকিৎসক সমাজের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকারি চিকিৎসকদের নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়। নানা স্তরের হাসপাতালে যে পরিকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম,ওষুধপত্র থাকার কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়। প্রায় সব হাসপাতালেই প্রশিক্ষিত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মী নেই। চুক্তির স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়েই সরকারি হাসপাতাল চালানো হচ্ছে। ফলে চিকিৎসকরা বহু ক্ষেত্রেই বাধ্য হন রুগী রেফার করতে। নানা জেলার রিভিউ মিটিং থেকেও উঠে আসছে মাতৃ মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ আসলে দেরিতে রেফার করা।
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বা জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলোতে সুপার স্পেশালিটি দূরের বিষয়, বেশিরভাগ জায়গায় স্পেশালিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। অন্যান্য প্রান্তিক, প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে রেফার করলে এবং রেফার হওয়া রুগীর মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক দায়ী থাকবেন বলে রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনের অবৈজ্ঞানিক, অবিবেচক, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতাকে পাশ কাটানোর লক্ষ্যে পরিকল্পিত ও প্ররোচনা সৃষ্টিকারী বক্তব্যে চিকিৎসক সমাজের মধ্যে চূড়ান্ত আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
তাঁদের মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৭ সালে, কলকাতার টাউন হলে,যেভাবে কর্পোরেট হাসপাতালের নানা অনিয়ম বেনিয়ম নিয়ন্ত্রণের নামে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত অপ্রতুলতার দায়, পরিকল্পিত ভাবে চিকিৎসক সমাজের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল। সেই মিটিংয়ের পরেই গোটা রাজ্যের হাসপাতালগুলোর দখল নিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি হয় রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। প্রতিদিন ঘটতে থাকে চিকিৎসক নিগ্রহ এবং হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা। অ্যাম্বুলেন্স নেই বলে চিকিৎসকের মাথা ফাটানো, চিকিৎসকের গায়ে মানুষের বিষ্ঠা মাখানো, বাংলা বলতে না পারায় জুনিয়র ডাক্তারকে পুলিশ আধিকারিকের চড়, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ভয়ঙ্কর জুনিয়র ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনা সমেত প্রায় ৩৫০ চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ওই সময়ে। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, জীবনদায়ী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ, সর্বোপরি প্রয়োজনীয় চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ না করে, সমস্ত অব্যবস্থার দায় চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানোর এই প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা আমরা করছি। আমাদের আশঙ্কা আবারও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি হবে। সরকারি প্ররোচনায় প্রতিদিন নিগৃহীত হতে থাকবে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরা।
আমরা চাই সন্তোষজনক পরিষেবা প্রাপ্তি ও রেফারের মূলগত সমস্যার গভীরে গিয়ে সরকার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করুক। এবং আমরা আরও চাই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে তাঁর একপেশে, খণ্ডিত চিন্তার চিকিৎসক বিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহার করুন।
২. বিষয়: স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প
শুরু হওয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত হয়রানির শিকার। কোথায়, কোন রোগের, কিভাবে চিকিৎসা হবে এসব নিয়ে নানা বিভ্রান্তি চলছিল। এসব বিতর্কের মধ্যে হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, ফিসার, ফিশ্চুলার মত অপারেশন, যেগুলি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের প্রয়োজন সেগুলো স্বাস্থ্যসাথীর আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার একই সঙ্গে বিনামূল্যে চিকিৎসার ফ্লেক্স, হোর্ডিংয়ে ভরে যাওয়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যেও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সুপার, প্রিন্সিপালদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা থেকে হাসপাতাল চালানোর সমস্ত খরচ, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা দিয়ে, তাদের নিজেদেরকেই তুলতে হবে। ফলে প্রতিদিন খবর আসছে বহু সরকারি হাসপাতালে টাকা না পাওয়ায় ঠিকাদারেরা ওষুধ, সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তাঁরা আধিকারিকদের চুল ছিঁড়ে নিচ্ছে বকেয়া টাকার জন্যে। স্বাভাবিক ভাবে স্থানীয় প্ৰশাসন প্রবল চাপে। বহু পরিষেবা কার্যত বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বর্তমান ব্যবস্থায়। বিপদে সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে বেসরকারি নার্সিং হোম ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও কোটি কোটি টাকার বিল বকেয়া রেখে হুমকি দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসাথীর পরিষেবা না দিলে লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে বলে। কোটি কোটি টাকা বকেয়া থাকলে তারাই বা পরিষেবা দেবেন কি করে? স্বাস্থ্য দপ্তর টাকার ব্যবস্থা না করে এক্ষেত্রেও দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে বলেই আমরা মনে করি।
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের চিকিৎসায় মানুষের সমস্ত হয়রানি অবিলম্বে দূর করতে হবে এবং একই সাথে প্রতিটি মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথীর চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে। রুগীর ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে তাঁকে কত টাকার পরিষেবা দেওয়া হলো তার উল্লেখ করার অপমানসূচক ভাবনা ও সম্ভাব্য আদেশনামা প্রকাশের চিন্তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার এবং পরিষেবা দেওয়ার টাকা সাধারণ মানুষের ট্যাক্স থেকেই আসে, কারো বাড়ি থেকে নয়।
৩. বিষয়: আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের দুজন ইন্টার্ন ডাক্তারের কমপ্লিশন
কিছু দিন আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে নানা দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্র মুচলেকা দিতে অস্বীকার করায়, স্থানীয় প্রশাসন অনৈতিকভাবে, ৬ মাসের বেশি তাদের ইন্টার্নশিপ কমপ্লিশন আটকে রেখেছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য লিখিত অভিযোগ নেই। একজনের সমস্ত বিভাগ ইন্টার্নশিপ লগবুক সাইন করে দেওয়ার পরও কমপ্লিশন আটকে রাখা হয়েছে। অন্য জন, যার বিরুদ্ধে একটি বিভাগে ডিউটি করেনি বলা হয়েছিল,সেও অতিরিক্ত ডিউটি করে দেওয়ার পরও কমপ্লিশন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তাঁরা চিকিৎসক হিসাবে কাজ যেমন করতে পারছে না, তেমনিই উচ্চ শিক্ষাতেও যেতে পারছে না। প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দুই মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। তীব্র মানসিক যন্ত্রনা ও উদ্বেগে তাদের পরিবার পরিজন। কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্যে, নেতৃত্বের উপর এই রকম প্রতিহিংসা মূলক আচরণ স্মরণ কালের মধ্যে আছে বলে আমাদের জানা নেই। কোনো অঘটন ঘটে গেলে, তার দায় আর জি করের স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজ্য স্বাস্থ্য প্রশাসনকেই নিতে হবে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য সচিবকে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্মের পক্ষে এই বিষয়ে ডেপুটেশন দিলেও, কোনো সুরাহা হয়নি। দুজন মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত স্থানীয় প্রশাসনকে আমরা ধিক্কার জানাই।
আমরা দ্রুত ওই দুজন ছাত্রের ইন্টার্নশিপ কমপ্লিশন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। নাহলে আমরা আইনের পথে যেতে বাধ্য হবো।
ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ
ডাঃ হীরালাল কোঙার
যুগ্ম আহ্বায়ক,
জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস, পশ্চিমবঙ্গ