হরিসাধন বসু কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছেন।
ব্যাপার কিছুই তেমন না। একটা গল্পের বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্প পড়ে থেকে তিনি কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছেন সম্প্রতি। গল্পের এক চরিত্র নাকি মৃত্যুর গন্ধ পায়। আসলেই এই লেখকটির লেখার ভঙ্গিতে একটা বিশ্বাস করিয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। যে কোনও বড় লেখকেরই তাই। সহজ সরল আন্তরিক ভাবে অকপট মিথ্যে বিশ্বাস করিয়ে দেবার ব্যাপারটা।
এই অবধি মনে করেই হরিসাধনের মনে হল তিনি কিঞ্চিৎ গুলিয়ে ফেলেছেন। মিথ্যে মানেই কি কপটতা? নিজের সঙ্গে নিজেই তর্ক করলেন। বাঃ রে, এই যে মায়েরা বলে আয় চাঁদ আয় চাঁদ, যাদুর কপালে এসে টিপ দিয়ে যা, তা কি কপটতা? কিম্বা ভারত আবার জগৎ সভায় ইত্যাদি পরম আশা গানে গানে, তাও কি কপটতা?
কিম্বা ভিক্টোরিয়ায় আর গঙ্গার ধারে বসে ‘ওগো, তোমার জন্য প্রাণ দিতে পারি’?
তিনি সহজ সরল মানুষ। অত প্যাঁচঘোচ বোঝেন না। তাঁরা স্বামী স্ত্রী বিরাটিতে থাকেন। পৈত্রিক বাড়িতে। অগোছালো অসফল হরিসাধন বলেন, ‘বাবার বাড়িতে আশ্রিত থাকি’। একমাত্র পুত্র শিবব্রত তার বউছেলে নিয়ে নিউটাউনে থাকে।
তিনি বোঝেন নিজে ক্রমশ অশক্ত হয়ে পড়ছেন। শরীরেও। পয়সায়ও। ভিটা পৈত্রিক। ওইটুকুই রক্ষা। কিন্তু সেই আবাসেরও মেইন্টেন্যান্স জরুরি। আজ জলের কাজ, কাল জঙ্গল সাফ, পরশু গ্রিল রঙ লেগেই আছে। তিনি নিজের চাকরি জীবনেও এই সবে মাথা ঘামাননি। স্বর্গগত বাবার ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন।
এখন বাবা নেই। এই সমস্ত কাজ একলা হাতে সামলাতে হয়, মানে সামলাবার চেষ্টা করেন। সে এক নাজেহাল অবস্থা। পয়সাকড়ির ব্যাপারটাও ভোগাচ্ছে।
সামলানো মোটেই সহজ না। তার ওপর বয়স হয়েছে। রোগব্যাধি লেগেই আছে। প্রেশার সুগার ওষুধ পরীক্ষা। পুঁজি ক্রমশ কমে আসছে।
ছেলে আসার সময় পায় না। অফিস, ঘরসংসার। ছেলেকে মাঝে মধ্যে ফোন করেন। সেই রকম এক ফোনে তাকে বললেন, বিহ্বলতা তৈরি করা নতুন গল্পটার কথা। শুনে কিন্তু ছেলে অবিশ্বাস করল না। ‘বাবা, জানো তো, সত্যিই এরম হয়’, বলল শিবু। ‘তোমার বউমা পায় এই রকম মৃত্যুর গন্ধ’!
অবাক হরিসাধন শুধোলেন, ‘কী রকম?’
‘আর বোলো না, আগে তো হয়েইছে। এবারেও আবার। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলাম গত মাসে। এক গাদা পরীক্ষা লিখে দিল লোকটা। পরের সপ্তাহে রিপোর্ট দেখাতে হবে।
এই অবধি শুনেই হরিসাধনের মনে হল, ‘আহা, খোকার মায়েরও শতখান পরীক্ষা লিখে দিয়েছে বিরাটির ডাক্তার। পয়সাই বা কোথায়, আর নিয়েই বা যায় কে?’
ছেলে ওদিকে ফোনের ওপার থেকে বলেই চলেছে, ‘বাড়িতে ফিরেই বুঝলে বাবা, ও বলল, একটাও পরীক্ষা করাব না।
আমি বোঝালাম, অত বড় ডাক্তার। দুহাজার টাকা ফি। তাকে অমান্য করা কি ঠিক?
তখন তোমার বউমা বলে কি, করালে টেস্টের টাকাটাই জলে যাবে। আমি সেই গন্ধটা ডাক্তার বাবুর ঘরে ঢুকেই পেয়েছি। ভক করে নাকে লাগল। রিপোর্ট যে করাব, দেখাব কাকে?
সত্যিই তাই, জানো বাবা, তিন দিনের মাথায় খোঁজ নিয়ে দেখি ডাক্তার নিজেই হার্ট অ্যাটাকে গন ফট।’ লম্বা গল্পটা বলে থামল ছেলে।
হরিসাধনের মাথায় মুহূর্তে নানান সম্ভাবনার কথা খেলে গেল। ব্যাপার সত্যি হলে, এই গন্ধ পাওয়া ব্যাপারটার জন্য সম্ভাবনা বিরাট। কর্পোরেট হাসপাতালের পাশে চেম্বার খুলে বসবে। গন্ধ শুঁকে বলে দেবে, কোন পেশেন্টের কেমন চান্স। সেই বুঝে খরচা করবে পেশেন্ট পার্টি। হাসপাতালও পয়সা দিতে পারে, ভুল প্রেডিকশন দেবার ইনসেনটিভ।। অবশ্য সেটা করা ঠিক হবে না। প্রেডিকশন না মিললে বদনাম হয়ে যাবে।
কিম্বা আরও বড় ভাবে ভাবলে ব্ল্যাক ক্যাট নিয়ে ঘোরা মালগুলোকে সকালে গন্ধ শুঁকে বলে দেবে আজকেই টসকাবে কিনা। রাষ্ট্রের তরফে মস্ত চাকরি।
কিন্তু যা ভাবা যায়, তাইই কি বলা যায়? যায় না।
ভীতু হরিসাধন ছেলেকে বললেন, ‘ তাই? তবে তো ভালোই হল। তুই মাসে দুমাসে বউমাকে নিয়ে এসে ঘুরে যাস তো! তোর মাকে আর আমাকে এট্টু শুঁকে দিয়ে যাবে। মানে তেমন হলে সে মাসে আমিও আর, মানে ওষুধেবিষুধে পরীক্ষায় অনেক খচ্চার ব্যাপার কিনা!’
বলেই মনে মনে ভাবলেন, ‘আহা, সেই অজুহাতেও তো তোর সঙ্গে একবার দেখা হবে!’