দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২২
প্রথমে দিল্লীতে ও পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া জুনিয়র ডাক্তারদের (post graduate trainee) আন্দোলন জনমানসে কতটা সাড়া ফেলেছে বা ফেলবে জানি না, কিন্তু basic infrastructure এর প্রতি এতটা অনাদর ও উপেক্ষা বোধকরি জাতীয় পরিসরে খুব স্বস্তিদায়ক উদাহরণ নয়।
গত কয়েকবছর ধরে চলা NEET PG (post graduate)পরীক্ষা সাধারণতঃ হয় জানুয়ারী আর counselling আরম্ভ হয় মার্চ মাস থেকে। কোভিডের কারণে এ বছর পরীক্ষা পেছিয়ে হয়েছে সেপ্টেম্বরে আর ‘কাউন্সেলিং’ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২৫শে অক্টোবর থেকে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা দায়ের হয় গত জুলাই মাসে জারি হওয়া সরকারের এক বিজ্ঞপ্তির হেতু..যেখানে সমস্ত সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ OBC ও ১০ শতাংশ EWS (economically weaker sections)-এর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। সংরক্ষণ মূল ২৫ শতাংশ (১৫ SC+ ১০ ST) তো থাকছেই..আরও যোগ হবে PWD (persons with disabilities) ৫ শতাংশ..অর্থাৎ, সব মিলিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজের AIQ (all India quota)-র ৬৪•৫ শতাংশ !! এটাই সব নয়, EWS-এর মাপকাঠি করা হয়েছে বছরে ৮ লক্ষ টাকা বা তার কম রোজগারের পরিবারকে। OBC -র ক্ষেত্রেও উপার্জনের সীমারেখা (creamy layer) ছিল ঐ একই মানে ৮ লাখ। সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২১ অক্টোবরের শুনানিতে সরকারের Advocate General-কে প্রশ্ন করেন, OBC-র ক্ষেত্রে তো সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনার দুয়েরই ইতিহাস আছে, কিন্তু EWS-এর ক্ষেত্রেও একই মাপকাঠির ভিত্তি কী..” You must have some demographic or sociological or socio economic data. You just cannot pull out Rs.8 lakh out of thin air…..”. সরকারপক্ষ সময় চায় এবং জানায় ‘কাউন্সেলিং’ আপাততঃ স্থগিত থাকবে।
২৫ শে নভেম্বর আরও এক মাস সময় চেয়ে জানানো হয়, এক বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি হয়েছে এই বিষয় পুনর্বিবেচনার (revisit) জন্য। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য হয় ৬ই জানুয়ারী’২০২২।
এবার, কমিটির সদস্যদের পরিচয় একটু দেওয়া যাক…..
১) প্রাক্তন আমলা অজয় ভূষণ পাণ্ডে.. ইনি Aadhar, GSTN, ও Direct Tax Reform কমিটির প্রত্যেকটিতেই শীর্ষ স্থানে ছিলেন।
২) Prof V K Malhotra, Member Secretary, ICSSR(ভারত সরকারের শিক্ষা দফতরের Indian Council of Social Science Research)। অটল ভক্তিবাদের কারণেই মীরাটের অর্থনীতির অধ্যাপকের এই বিশেষ পদ প্রাপ্তি।
৩) সঞ্জীব স্যান্যাল..সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। এনার লেখা বিভিন্ন বইতে ইনি সম্রাট অশোকের নিয়ত নিষ্ঠুর ও প্রবঞ্চক চরিত্র তুলে ধরেছেন। অশোক নাকি আসলে জৈনদের চাপে পড়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হন অহিংসার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নয় এবং তিনি মোটেই ধর্মসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। মহাভারত, পুরাণ থেকে তিনি ভারতীয় ইতিহাস খুঁজে বার করেছেন, চাণক্যের কূটনীতিকেই ভারতীয় আদর্শের দিকদিশারি মেনেছেন এবং সেইসঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতিতে নেহেরু- মহলানবিশ এর কুপ্রভাব সম্মন্ধে অতিশয় নিশ্চিত মতামতের অনুসারী হয়েছেন।
প্রসঙ্গতঃ, এই বাঙালী মহাপণ্ডিত ও আবিষ্কারকের পারিবারিক ইতিহাস কিন্তু অত্যাশ্চার্য। তার প্রপিতামহ ছিলেন বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা নলিনাক্ষ স্যান্যাল (দেশভাগের একটি বিকল্প দলিল তৈরির প্রয়াসের অন্যতম অংশীদার)। এই বংশেরই আর এক ব্যক্তি অসামান্য বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ স্যান্যাল, যিনি ছিলেন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য , বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অন্যতম সহযোদ্ধা ও সেলুলার জেলে দুদফায় দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দী আসামী!
কী পরিবারের কী সন্তান!!! সত্যিই…….
যাক, এই মহামূল্যবান ত্রয়ী ৯০ পৃষ্ঠার একটা দলিল ইতিমধ্যেই নাকি প্রস্তুত করেই ফেলেছেন..ধরেই নেওয়া যেতে পারে সরকারের বিজ্ঞপ্তির বিশদ ব্যাখ্যা ও সমর্থনে। সুতরাং, স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এই মামলার আশু সমাধান সত্যিই দুরূহ।
সমস্যাটা ঠিক এখানেই। দেশের মেডিকেল কলেজগুলির হাসপাতালসমূহের চিকিৎসা সংক্রান্ত মূল পরিষেবার ধারক ও বাহক হলো এই PGT-রা যারা স্নাতকোত্তর শিক্ষার অন্তর্গত। তিন বছরের কোর্সের একটা ব্যাচ অনেক দিন বেরিয়ে গেছে; সুতরাং দুটি ব্যাচকে তিন ব্যাচের duty অর্থাৎ দেড়গুণ কাজ করতে হচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস নাগাদ আর একটি ব্যাচের পাশ করে যাওয়ার কথা….তখন??? বিগত পৌনে দু বছর ধরে যারা কোভিডের কারণে অমানুষিক অসমসাহসী কাজ করে আসছেন আর যে তরুণদের অনেককেই আমরা অতি অকালে হারিয়েছি মহামারীতে.. তাদের প্রতি সরকারের ও দেশের কী সুন্দর প্রতিদান!!! হতবাক হয়ে যেতে হয় যখন দেখি পুলিশ প্রশাসন এদের প্রতিবাদকে যে কোনও বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচির মতোই deal করে..লাঠিচার্জ-আটক-FIR সবই হয়!!
তাছাড়া, জুনিয়র ডাক্তারদের অস্বাভাবিক বাড়তি কাজের প্রসঙ্গ ছেড়েই দিলাম। কিন্তু, জনগণের চিকিৎসায় এই overburdened অতি ক্লান্ত নবীনদের নিয়োগ করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে যখন নাকি করোনার ‘তৃতীয় ঢেউ’ প্রায় অতি আসন্ন??? এতে জনগণের স্বার্থ কী সুরক্ষিত থাকা সম্ভবপর?? ডাক্তারদের নিয়ে মাথা ঘামাতে অনেক মানুষেরই আপত্তি আছে। সে থাকুক..কিন্তু নিজের জন্যও তো মাথা ঘামানোটা জরুরী…….!!
………………………………………….
…………………………………………..
প্রসঙ্গতঃ, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী, ডিপ্লোমা ও DNB নিয়ে মোট বিয়াল্লিশ হাজারের কিছু বেশী আসনে (সরকারি+বেসরকারি), সরকারি কলেজের অল ইণ্ডিয়া কোটায় (50%) OBC ও EWS-দের সংরক্ষিত হচ্ছে যথাক্রমে আড়াই হাজারের কিছু বেশী এবং এক হাজারের কাছাকাছি আসন। কিন্তু এখানে সংখ্যাতত্ত্ব, সামাজিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষন বা সংরক্ষণ-অসংরক্ষণ নিয়ে বিতর্ক কোনওটাই মূল বিষয় নয়। আসল জিনিস হলো সামনের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে OBC ও ব্রাহ্মণসহ উচ্চবর্ণের মন জয়ের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এর জন্য অনেক বুদ্ধি(??) সম্পৃক্ত এই পদক্ষেপকে বরং political science বা চাণক্য নীতি দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব!!…. দুঃখ একটাই এইসব বুদ্ধির মূল্য চোকাতে হচ্ছে হতভাগ্য কিছু ডাক্তারি ছাত্রদের আর তারই সঙ্গে সেই সমস্ত সাধারণ মানুষকে যাদের দিনপ্রতি এক লাখের হাসপাতালে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই
ওঠে না।