কালীপুজো এলেই আত্মবিস্মৃত বাঙালির সোনালি বিস্মরণের অতল থেকে উঠে আসেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। ভেসে ওঠেন তাঁর বুক এফোঁড় ওফোঁড় করা আকুল উচ্চারণ নিয়ে — ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা!’
চলে গিয়েছেন ১৯৬৬ সালে, স্বেচ্ছাবিদায় নিয়ে, তবু, অর্ধশতক পেরিয়েও অমন হৃদয় মোচড়ানো রামপ্রসাদী আর কাউকে গাইতে শুনলাম না তো!
তেমন কোনো আলোচনাও কোথাও দেখিনি তাঁকে নিয়ে। ছোট্ট একটুখানি জীবন, প্রায় সবটুকুই আরাধ্য কালীর পায়ে সমর্পিত।
আমার মায়েদের মামার বাড়ি ছিল বালিতে। আমার মামা জন্মেছিল সেখানেই। বারো বছর অবধি মামার লেখাপড়া বালির শান্তিরাম ইস্কুলে। সেই সময় থেকেই বন্ধুত্ব পান্নালাল ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতা হয় পান্নালালের মেজদাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গেও। মায়ের মুখে শোনা, আমার দাদু মন্ত্রী থাকাকালীন দুই ভাই বহুবার এসেছেন আমার গোকুল বড়াল স্ট্রিটের মামার বাড়িতে — শুধু গান শোনাতে নয়, মামার সঙ্গে আড্ডা মারতেও। পান্নালালের স্বভাব, প্রকৃতি কেমন সে আর মায়ের স্মৃতিতে ছিল না — তবে মা কালীকে আহ্বানের সেই মর্মছেঁড়া আকুতি বাড়িসুদ্ধ মানুষের মনকে যে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে যেত, সেটা বেশ মনে ছিল।
এখনকার কালীপুজোর আবহ অন্যরকম। দেওয়ালির আলোকসজ্জা, বাজির বজ্রনিনাদ, আকাশ জুড়ে আতসবাজির নান্দনিক উদযাপনের মাঝে সেই তমসাবৃতা দেবীর আরাধনা একটু যেন পিছিয়ে পড়েছে মনে হয় — দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, ঠনঠনে প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তির পুজোগুলি ব্যতিক্রম। অবশ্য আমি ভুলও হতে পারি। তবে, দিনকে দিন শহরে বাজি ফাটানেওয়ালাদের দল যত ভারী হতে দেখি, মধ্যরাত অবধি মায়ের পুজোয় উপোস করে অঞ্জলি দেনেওয়ালাদের দল ততটা ভারী হচ্ছে বলে চোখে পড়ে না। সাধারণ কালীপুজোর প্যান্ডেল, রাত গভীর হলে, হিমকাতুরে পুরোহিতমশায়, পাড়ার সর্বঘটে বিল্বপত্রের মতো দু’চারজন দাদা-কাকা গোছের ব্যক্তি আর কয়েকজন ভক্তিমতী মাসিমা-কাকিমা-বৌদি ব্যতিরেকে নিতান্তই জনবিরল হয়ে পড়ে দেখেছি। সর্বজনীন দুর্গাপুজোর অষ্টমীর অঞ্জলির থিকথিকে ভিড় বারোয়ারি কালীপুজোর মন্ডপে অনুপস্থিত থাকে বেশিরভাগ সময়।
‘কালী কালী মহাকালী কালিকে পাপহারিণী, ধর্মার্থে মোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে’— র মন্দ্র মন্ত্রোচ্চারণের অবসরে তখনো নির্ভুল বেজে ওঠেন পান্নালাল — ‘মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল!’
কোন প্রার্থনাটির আবেদন যে রাঙা পায়ের কাছে সার্থকতা লাভ করে, জানতে পারি না। আমি দেবী হলে কোন নিবেদনে গলদশ্রু হতাম, সেটা জানি।
এবারে কালীপুজো হেমন্তের প্রায় শেষ লগ্নে পড়েছে। আবহাওয়ায় হিম ভাব, ঘরে ঘরে পাখা তেমন চলছে না আমাদের এই শহরতলিতে। তাই বোধহয় পাশের পাড়ার পুজোপ্যান্ডেলের গানও উত্তুরে বাতাসে ভেসে এসে আমার ছাদের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে। ‘শিশা হো ইয়া দিল হো’ আর ‘ইয়ে শাম মস্তানি’র ফাঁকে কোনো পুজোপ্রেমী ডেঁপো নাবালক চালিয়ে দিয়েছে কবেকার পান্নালাল ভট্টাচার্যকে। উত্তর হেমন্তের বিষণ্ণ দুপুরে বাতাসে ঘুরে মরছে নিষ্ফল আর্তি — ‘পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না ———
জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে, কোলে তুলে নিতে আয় মা—-‘
প্রতিবারেই পান্নালালের মাতৃবন্দনা শুনে চোখ ছলছল করে ওঠে আমার — নিদারুণ রকম ধর্মপ্রাণা নই,তবুও।
এবারে আরো বেশি করে জলে ভরল দু’চোখ। তারপর চোখ ছাপিয়ে নামল গাল বেয়ে। কোন মায়ের চরণে গেল আমার নোনা নৈবেদ্য? জানি না। সব বেদনা কি ছোঁয়া যায়? এক জীবনে অনুভব করে ওঠা যায় সমস্ত অপ্রাপ্তির ব্যথা? মনের ভিতর গুমরে ওঠা কষ্ট চাপা দেওয়া যায় ঝলমলে যাপনের আপাত চাকচিক্যে? জানি না, জানি না, কিচ্ছু জানি না।
শুধু জানি, এইবারের কালীপুজোতে, আমি, সুকন্যা, এক্কেবারে অনাথ হয়ে গেলাম। কোনো বিশ্বনাগরিকত্বের গর্বিত প্রতিস্পর্ধাতেই যে ছোট্ট বিশেষণকে আর কখনো খন্ডানো যাবে না।
হয়ত তত প্রাসঙ্গিক নয়, তাও জয় গোস্বামীর সূর্য পোড়া ছাই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা মনে পড়ল এই অনুষঙ্গে।
মা এসে দাঁড়ায়
জানালায়
নিম্নে স্রোত, নদী
জল থেকে লাফিয়ে উঠছে এক একটা আগুনজ্বলা সাপ
আমি সে নদীর থেকে তুলে নিতে আসি
আমি শিকলবাঁধা বাঁশি
আকাশের উঁচু জানলায়
মা এসে দাঁড়ায়
সরে যায়।
আজ ১০ই নভেম্বর, আজ জয় গোস্বামীর জন্মদিন।