আজ তুবড়ির গল্প।
তুবড়ি বানাতাম আমরা। প্রথমে ছিলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট। তার পরে নিজেরাই স্রষ্টা। গোপন ভাগের হিসেব। বল্টুদা বলত,– শুধু ভাগ বলিস কেন? বলতে হয় পুরোটা। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের হিসেব। নইলে ওনারা রাগ করেন।
– ওনারা মানে? কারা?
মন্ত্রগুপ্তি শোনানোর ভঙ্গীতে বল্টুদা বলত ফিসফিস করে, – কারা আবার? ওই সোরা গন্ধক পটাশ লোহাচুর অ্যালুমিনি কাঠকয়লার পাউডার মানে ওই সবের মাঝে লুকিয়ে থাকা বাজির ভগবানেরা। উড়ন আর বসন দুরকমের আবার ভগবান আলাদা সেটা জানিস তো?
উড়ন তুবড়ি এখন বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী। আর উড়ন তুবড়ি ছাড়ার সেই শিল্পীরাও অবলুপ্ত। তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে ধরা থাকবে দেড় ইঞ্চি ব্যাসের এক গোলক। অন্যহাতে থাকবে জ্বলন্ত ধূপকাঠি। সেই তীক্ষ্ণ লাল বিন্দুটি চুমু খাবে উড়ন তুবড়ির নতমুখ প্রজ্বলন অঞ্চলে।
সবচেয়ে ভালো উড়ন ছাড়ত আমাদের পাড়ার আতশবাজির গুরু কিশোর বসু। আহা! সে এক শিল্প বটে! সিকি ছটাক বা তারচেয়েও ছোট খোলের উড়ন। সেই ফুটোয় আলতো করে জ্বলন্ত ধূপকাঠি ছোঁয়ালেই ছির ছির করে রুপোলি-সাদা রঙের হালকা আগুন বেরোতে শুরু করবে। তখন দু আঙুলে ধরা উড়ন কে বার আড়াই সমান্তরাল ঝাঁকিয়ে, আগুনের রাগ হিসহিস করে বেরিয়ে এলে হাত এক পাক বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে তুবড়িটা ছেড়ে দিতে হবে।
ওই হাত ঘোরানোটার মধ্যেই আসল ওস্তাদি। অতি সামান্য এয়ারোডিনামিক্যাল ভুলচুকেই উড়ন হয় মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ঘাড় নড়বড় করতে করতে এর জানালা তার লুঙ্গি ওর শাড়ির তলায় ঢুকে অসভ্যতার চেষ্টা করবে, অথবা ভসভস করে আওয়াজ তুলে খুব সামান্য উচ্চতায় উঠে শ্রীহরিকোটার বিফল রকেটের মত গোঁত্তা মেরে ভাঙা বৃত্তে ঘুরে জ্বলে শেষ হয়ে যাবে। ওস্তাদের হাতের তুবড়ি সোজা উঠে যাবে ওপরে রুপোলি – সাদা আলোর লেজ নাড়াতে নাড়াতে। উড়নে প্রধানতঃ এলুমিনিয়াম চুর দেওয়া হত, তাই সাদা আলো, কখনও অল্প লোহাচুরও… তখন একটু লালচে।
উড়ন তুবড়ি ছাড়তে স্কিল লাগে।
তবে উড়ন বেশ বিপজ্জনক ও বটে। ভীমবেগে নেবে আসা আংরা হয়ে যাওয়া খোল মাথায় পড়লে সর্বনাশ। ফলে কালক্রমে উড়ন তুবড়ি কে বেআইনি করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে বেশ কিছু বছর উড়ন তুবড়ি বিক্রি হতো না। যারা ছাড়তো তারাই বানিয়ে নিতো। পরে আস্তে আস্তে তাও বন্ধ হয়ে যায়। উড়ন তুবড়ি বর্তমানে, আরো অনেক বাজিরই মতো, ম্লেচ্ছ ভাষায়, যাকে বলে এক্সটিংক্ট।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। পাড়ার কিশোর বসু আমাদের অনেকটা সিনিয়ার। সেই সিনিয়রিটির জন্যই ‘কাকু’। ও আবার কবিতাও লিখত। প্রেমের কবিতা। বয়স নির্বিশেষে মেয়েদের দিকে ভারি নেকনজর ছিল তার।
কিশোরকাকু উড়নতুবড়ির সেই আগুন ছোঁয়ানোর জায়গাটাকে বলত বৃন্ত। তখন বুঝতাম না। পরে বুঝেছি এই আদরের নাম করণের কারণ ও অভিঘাত। বলত, – ‘খুবই গুঢ় এই বিদ্যা। কখন আগুন হাতে নিয়ে বৃন্ত স্পর্শ করতে হবে আর কখন আঙুলে টের পাবি তার সেই মুক্তিবেগ এই শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে তবেই উড়ন তুবড়ি হাতে নিবি।’
সন্তু, আমার গলায় গলায় বন্ধু। ফিসফিস করে কানে কানে বলত,
– বড়দের অসভ্য কথা সাঁটে বলছে রে!
সে যাই হোক। শিল্পীর মত উড়ন ছাড়ত কিশোর কাকু। একটুও ট্যারা ব্যাঁকা নয়, সিধে ওপরে উঠে যেত বহুদূর। আমরা বলতাম মরতে দম তক্!
একবার শুধু শিবুদাদুর খোলা জানলার দিকে ধেয়ে গেছিল ওর মিসাইল। হাতের হিসেবের ভুলে। অনেকেরই সন্দেহ নাকি শিবরঞ্জন প্রামাণিক যে সে বছর চাঁদা নিয়ে গণ্ডগোল করেছিল তার জন্যেই এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বুড়োকে। শিবরঞ্জন কিশোরকে ক্লাবের হর্তাকর্তাদের সামনে পাকড়াও করেছিলেন। হেস্তনেস্ত করবেন বলে। বিস্ময়াহত কিশোরকাকু খুব অভিমানের স্বরে থরোথরো গলায় বলেছিল,
– জ্যাঠামশাই, আমি কবিতা লিখি। আমি কখনও এমন কাজ করতে পারি? আপনি ভাবতে পারলেন?
এই যে গল্পটা আপনাদের বলতে যাচ্ছি সেটা উড়নের নয়… বসনের। এই বসন মানে ওই ‘বসন পরো মা’ গানের বসন নয়। সে তুবড়ি বসে থাকে… তাই বসন তুবড়ি। এই ব্যাসবাক্যের সমাস আমি জানি না।
এখানে সামান্য থিয়োরি চর্চা করা যেতে পারে। তুবড়ি তৈরির জন্য লোহা, সোরা, গন্ধক ও কাঠকয়লার দরকার হয়। লোহা ফুলকি সৃষ্টি করে। গন্ধক তাপ বৃদ্ধি। সোরা খোলের মধ্যে উচ্চচাপ সৃষ্টি করে যাতে জ্বলন্ত লোহার ফুলগুলো আগ্নেয়গিরির লাভার মত সজোরে উৎক্ষিপ্ত হয়। কাঠকয়লা আগুন দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করে। তুবড়ির থেকে ছিটকোনো আলোর ফুলকি নানান রঙের করতে পারতাম আমরা। কখনও অ্যালুমিনিয়ামচুর, কখনও শাঁখচুন। মোমছাল, বেরিয়াম (Barium), স্ট্রনশিয়াম, কত না কেমিক্যাল দিয়ে নানা রকম রঙের তুবড়ি তৈরির গুপ্তবিদ্যা সঞ্চারিত হত উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের পাড়ায় পাড়ায়।
আমাদের পাড়ায় তুবড়ি কমপিটিশন হত। বসন তুবড়ির কমপিটিশন। সে এক হই হই কাণ্ড রইরই ব্যাপার। পাঞ্জাবী কাকুদের তিনতলা জুটমিল কোয়ার্টারের সামনের মাঠে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। মাঠটা অবশ্য ছোটোই। তাতে কী?
কমপিটিশনের নাম ছিল সারা বাংলা তুবড়ি প্রতিযোগিতা। যদিও আশেপাশের পাড়া ছাড়াত না আমাদের সেই সারা বাংলার সীমানা। এই তুবড়ি কমপিটিশন এককালে চালিয়েছে আমাদের বাবা কাকারা। এর পরে ভার নিয়েছে ব্যাচের পরে ব্যাচ। পরপর। তাই বলে আগের ব্যাচরা হাত তুলে নিয়েছে এমন না। তারা তদ্বির তদারক করেছে। কিশোরকাকুদের হাত থেকে ভার নিয়েছে বল্টুদারা। ওদের হাত থেকে চার্জ হ্যান্ডওভার হয়ে আমাদের হাতে।
বছরের পর বছর যায়। কমপিটিশনের নিয়ম কানুন একই। ঘোর কৃষ্ণ পক্ষের রাতে মাঠে বসানো হবে ইয়া লম্বা এক বাঁশ। বাঁশ গোলায় একমাস আগের থেকে নজর রাখা হয় সটান লম্বা বাঁশের খোঁজে। ওই রকমের দুটি বাঁশ বুক করে রাখা হবে। তাদের দৈর্ঘ্য হতে হবে তিরিশ ফুটেরও বেশি। বিচারকরা, মানে যাদের আমরা বলতাম আম্পায়ার, সেই তারা থাকবে পাঞ্জাবী কাকুদের তিনতলা কোয়ার্টারের ছাদে। হাতে টর্চ। বলা হয়নি, ওই সিলেক্টেড বাঁশদুটোকে আলকাতরা পেন্ট করে কুচকুচে কালো করা হবে। তার পরে রীতিমত গজফিতে মেপে এক দুই করে স্কেলের মত করে সাদা কালিতে মার্কা করা হবে। সটান সোজা করে সেই বংশ নির্মিত স্কেল মাটিতে পোঁতা হবে। কার তুবড়ির ফুলকি কতদূর উঠবে সেটা আম্পায়ারদের হাতের তিন ব্যাটারি টর্চের আলোয় নোট করে নেওয়া হবে।
পাঞ্জাবী কাকুর দুই মেয়ে। যমজ। তুঙ্গভদ্রা আর শম্পা। পাঞ্জাবী কাকু নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে পাঞ্জাব তনয়। কাকিমা বাঙালিনী। মেয়েদুটো যমজ বলেই তাদের নাম নাকি ওরকম। আমাকে অনেক পরে সেই নাম রহস্য বলবে দুই মেয়ের একজন। পরে যা হয়েছে তুঙ্গভদ্রা, রামায়ণের সময় তাই নাকি ছিল শম্পা। আসলে দুটো নদীই এক। মজার কথা, তুঙ্গভদ্রার ডাকনাম ছিল তুবড়ি। আর শম্পার ডাকনাম ছিল না। ওরা দুজনই ছিল আমার সমবয়সী আর ক্লাসমেট।
সেই আশ্চর্য বছরে তুবড়ি কমপিটিশনে নাম দিয়েছিল ওদের দুজনের একজন। তুঙ্গভদ্রা। যার নিজের ডাকনামও তুবড়ি। আগেই বলেছি।
এমনিতেই তুবড়ি বানানোর যে শিল্পের কথা বলেছি, তাতে আমাদের পাড়ার অনেক মা কাকীমা দিদিরা হাত লাগাতো। কিন্তু কোনও মেয়ের নিজের বানানো তুবড়ি নিয়ে কমপিটিশনে নামা সেই বছরেই প্রথম। সেই নিয়ে হাসাহাসিও হল খুব। মা কাকীমারা বললেন ধীলন আর তার বউ মেয়েদুটোকে একদম গেছো বানিয়েছে দেখছি।
ছোটো থেকে একসঙ্গে বড় হওয়া মেয়েরা যে বড় হলে বদলে যায় সেই নিয়মটা এই দুজনের জন্য খাটত না। মানে খাটেনি সে বছর অবধি। সে বছরেই প্রথম তুঙ্গভদ্রা নিজে হাতে তুবড়ি বানিয়ে নাম দিল কমপিটিশনে। শম্পার তুবড়ি বানানোর সাধ আর সাধ্য কোনওটাই ছিল না।
কোয়ার্টারের ছাদে বসে আছে আম্পায়ার দুজন। কিশোরকাকু তাদের একজন। অন্যজন ধীরাজদা’। চোখে হাই পাওয়ার চশমা কিন্তু ভারি উৎসাহী। আম্পায়ারদের তরফে কিশোরকাকু মূল প্রতিযোগিতার আগে কয়েকদিন ঘন ঘন সেই ছাদে গিয়ে স্ট্র্যাটেজিক পজিশন তদারক করেছে।
এক এক করে তুবড়িতে আগুন দিচ্ছে প্রতিযোগীরা। ছাদের ওপরে বসা আম্পায়ারদের টর্চ বাঁশ বেয়ে ওঠানামা করছে। ওদের কাছে থাকা কাগজে কার তুবড়ির আলো কত ফুট উঠেছে লেখা। ওরা নীচে নামলে সেই কাগজ দেখে ঘোষণা করা হবে কে পাবে বিজয়ীর কাপ।
তা সেই রেজাল্ট বলার সময়েই চূড়ান্ত মতবিরোধ দেখা দিল দুই আম্পায়ারের। কিশোর কাকুর মতে ফার্স্ট হয়েছে তুঙ্গভদ্রা সিং। যার ডাক নাম তুবড়ি। কিন্তু সেকেন্ড জাজ্ ধীরাজদা’র কাগজে লেখা অন্য একজনের নাম। কিশোর কাকু যেহেতু এ লাইনে ভেটেরান, বিশেষত উড়ন তুবড়ির ব্যাপারে স্বনামধন্য, কাজেই সে যখন বলল ধীরাজ ওর হাই পাওয়ার চশমায় কী দেখতে কী দেখেছে, কেউই সে কথা অবিশ্বাস করল না।
অনেক দিন পরে এই রেজাল্টের রহস্য জেনেছিলাম আমার বিয়ের পরে। শম্পার কাছে। ওদের দু বোনেরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তুঙ্গভদ্রা বিয়ের পরে নয়ডায় থাকে এখন। সে এখন তুঙ্গভদ্রা কাউর।
ও আগে বলিনি বোধহয়। সমবয়সী শম্পার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে বছর দশেক পর। ক্লাসমেটের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে যেমন হয়।
শম্পা সেই কমপিটিশনের দিন কতক আগে থেকেই জানত তুবড়ি ফার্স্ট হবে। কিশোরকাকু ওদের ছাদ থেকে নামার সময় সিঁড়ির বাঁকে তুবড়ি দাঁড়িয়ে থাকত।
শম্পা ওদের দুজনকে জড়াজড়ি করে চুমু খেতে দেখে ফেলেছিল।
এই তুবড়ি কমপিটিশনের পর এই নেহাতই শর্তসাপেক্ষ প্রেমটা আর দানা বাঁধেনি। তুবড়ি উড়নতুবড়ি হয়ে উড়ে গেছে নয়ডায়।
★