নাইট ইমারজেন্সি ডিউটি সেরে ফিরে এসেছি এই একটু খানিক আগেই।
এই গত কয়েক ঘন্টার কাতর-ক্রন্দন-ধ্বনি আর সেবা-স্যালাইন-শুশ্রূষার মাঝেমধ্যে ফাঁকফোঁকর মিলছিল যখনই তখনই অভ্যাসবশত খুটখাট করে যাচ্ছিলাম আমি– ফেসবুক। আর আছড়ে পড়ছিল মুহুর্মুহু, কঙ্গনা-ক্যালানো পোস্টের চাপান উতোর।
সেইসব শিশু-সুলভ স্থূলতা পড়তে পড়তে কখনো চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল আবার কখনো বা… ভ্রুকুঞ্চন। উচিত আর অনুচিত-গুলো গুলিয়ে যাচ্ছিল বারংবার।
এবং তখনই দৈবাদিষ্টর মতো প্রকট হয়ে উঠলো একদল রোগী। বা বলা ভালো– একটি রোগী, অনেক মারমুখী। মধ্য বিশ থেকে অনুর্ধ্ব চল্লিশ পুরুষ, এরা সকলেই। পুরোভাগে, বছর পঁচিশ ত্রিশের এক মহিলা। এরা, সকলেই নিয়ে এসেছে একটি, হ্যাঁ একটিই মাত্র রোগীকে।
রোগীটি স্পষ্টতই মদ্যপ। এই উদ্দামে চিল্লাছে–মাদারচোদ, বাঞ্চত। আর পরক্ষণেই কাতরাচ্ছে যাতনায় – মা…মালতী…তোমরা কোথায় বাঁড়া?
ঘটনাটা, দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। বেবাক। দেদার মদ খেয়ে বাইক নিয়ে ধাক্কা মেরেছে ব্যাটা, ল্যাম্পপোস্টে। প্যারাইট্যাল… মাথার পাশের দিকে মস্ত বড় ক্ষত। হাঁ-করা। চোট। হেলমেট যে, ছেলেটির মাথায় ছিল না, এ কথা বোধকরি বলাটা বাহুল্যই।
সে হোক। হতেই পারে। হয়েই চলে। নিয়ত। তাই হ্যাঁ… হ্যাঁ…এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। হিসাব মিলিয়ে। যেমত রোগী দেখতে আমরা অভ্যস্ত নাইট ডিউটিতে।
লেকিন গোলটা বাঁধলো তার ঠিক পরে পরেই। যেহেতু হেড ইজনুরি সিভিয়ার, সিটি স্ক্যান প্রয়োজন( হাসপাতালে সিটি স্ক্যান বিনামূল্যে)। প্রয়োজন…ভর্তি থেকে বিশদ চিকিৎসার। আর ইনজেকশন ইত্যাদির। এবং এই সমস্ত কিছুতেই পেশেন্ট তথা পেশেন্ট পার্টির অনীহা। আপত্তি। তুমুল।
আমি বললাম– ভর্তি করুন, মেল সার্জিক্যালে।
উত্তর এলো– ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিন।
বললাম– মাথা ফেটে গেছে। ভর্তি করুন। প্লিজ। আমি তো আর…. আপনি ভর্তি হলে টাকা পাবো না, এটা তো আর নার্সিংহোম নয়…
উত্তর এলো– আবে বকচোদ
আমি দুই ঢোঁক গিলে বললাম– আচ্ছা ভর্তি তো করুন, কাল সকালেই ছেড়ে দেব।
উত্তর এলো– এ শালা ডাক্তার চুতমারানি মাইরি, অপুদা’ কে ফোন লাগা তো…গাঁড় মারুক শালার।
আমি আরো সাবধানী হলাম,– আচ্ছা টিটেনাস টা তো নিন
উত্তর এলো– সুঁই নেবে না বাঁড়া রমেশ। রমেশ…র-মে-শ… সুঁই নেবে না। তুই শালা দশ পয়সার ডাক্তার রমা-রাজাকে ইনজেকশন দিবি?
ততক্ষণে আমি আরো সিঁটিয়ে গেছি, যেমত রোজই থাকি ইদানিং…বাড়ি ফিরতে হবে…বাড়ি ফিরতে হবে– অক্ষত। আর তাই বললাম ভয়ে ভয়ে–
অন্তত স্টিচ টুকু…
এবার উত্তর এলো ‘ পাতাললোক’ ওয়েবসিরিজের ভাষ্যে–
মা কা ভোঁষড়া…এই শালা ডাক্তার…এরা টোটাল দকতারগুলা বাঁড়া…খানকি মাগী।
এসব ঘটে চলছিল যখন, তখন মাথার মধ্যে রেলগাড়ি ছুটে চলছিল বিপরীত মুখে। পশ্চিমবঙ্গের বাষট্টিতম যোগ্য ছাত্র হিসেবে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে ছিলাম আমি। আর কর্কশ পিতা আমার স্রেফ ওই একটি দিনই কপালে এঁকে দিয়েছিলেন–চুমা। বলেছিলেন– এবার থেকে, পার্থ বেটু, তোর পরিচয়েই পরিচিত হব আমরা।
আর নেপথ্যে তখন সেই আকাঙ্খিত পরিচয় ভেসে চলছিল, আকাশে বাতাসে
– মা কা ভোষড়া। মা কা ভোষড়া। মাতার– যোনি।
রাগ হচ্ছিল বেজায়। বীভৎস। বিস্ফোটক। মনে হচ্ছিল এখনই যদি…।
কিন্তু নাঃ। কিছুই করিনি আমি এদের। প্রেসক্রিপশনে লিখিয়ে নিয়েছিলাম – রিফিউজড এডমিশন। রিফিউজড ট্রিটমেন্ট।
আর ‘লাল-ওষুধ’ লাগিয়েই চলে যেতে দিয়েছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয়েছিল বড্ডো যদিও। মারিনি। নাঃ, এ ভয়ে নয় যে আমি একা রোগা, আর ওরা তাগড়া-তেরো। কিংবা আমি ঠিক। আর ও ভুল। বরং–মাথায় ছিল, আমি কর্তব্যরত। আমি, পরিষেবা– প্রদান করছি। উর্দি পরিহিত।
চলে গিয়েছিল ওরা– বেরো বাঁড়া ডাক্তার, তরে চুদব রাস্তায় ফেলে।
আর ঠিক তখনই এসে গিয়েছিল পরবর্তী রোগী। এবং ডিউটির পরবর্তী ‘হ্যান্ডওভার’।
হাসতে হাসতে বলছিলাম– আমাদের প্রবলেমটা কি জানো? যাদের ভর্তি হওয়া প্রয়োজন তারা ঠিক করে আসে, ভর্তি হব না। আর যাদের নেই সেমত দরকার, তারা ভর্তি হবে তো হবেই। সেসবে সুরে সুর মেলে চলতে পারলে বেটার… নয়ত…।
হ্যান্ডওভার ছেলেটি, অন্য-অথচ আমারই ভাষায় বলেছিল– নেহি দাদা, হামারা প্রবলেম ইয়ে হ্যায় কে ইয়ে ফেসবুক সোসাইটি ডিসাইড করতি হ্যায় কৌন বাত ঠিক হ্যায় ঔর কৌন গলত।
ব্যাস।
তারপর আর কী! হ্যাঁ। ফিরছিলাম বাড়িতে। আজও অক্ষত। আর ভাবছিলাম– কে কাকে পেটাবে, কতটা যৌক্তিক সেসব…. এসব কী নেটিজেন ঠিক করে দেবে? ফিরছিলাম অসংখ্য কুকুর কাটিয়ে। যারা প্রত্যেকে তেড়ে আসছিল। যেমত কুকুর-কারণে দুর্ঘটনা পাই গড়ে সাতটা। কিন্তু হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ… কুতুয়া/ডগি-ও কি জরুরি নয়? হ্যাঁ, মুরগি হয়ত বা মেরে খেতে পারি। মশাকেওও…করতে পারি। মোক্ষম চপেটাঘাত।
আচ্ছা, কাকে ঠ্যাঙালে ঠকতে হবে না? সাপ? কুকুর? রেপিস্ট? মালিক-পক্ষ?
এইসব এলোমেলো জটিল-জট কাটাতে কাটাতে।
আর তখনই ড্রাইভার-রতন বললো– চাকরি নাই সার। আমার ছেলে এম.কম পাশ করলো। এখন, মোমোর ঠ্যালা চালায়… মটকা গরম হয়ে যায় সার… কখন যে কাকে থাপড়াই দিব।
বাইরে তখন এক ভবঘুরে মাথায় সবুজ, বুকে গেরুয়া, নিচে লাল পরে চিৎকার করে যাচ্ছে– মুতে দেই হামি…মুতে দেই।
ড্রাইভার-রতনকে বললাম, তোমার গাড়িতে গান নেই রতন?
বাজলো। বাজলো রতন। না। গাড়িতে নয়। ফোন-‘ইস্পিকারে’
ধীরে ধীরে প্যায়ার কো বাড়হানা হ্যায়।
আঃ! অজয় দেবগন। নষ্ট লজিক। নস্টালজিয়া।
এই ভালো আছি। এই বেশ।
( পুঃ, কঙ্গনার ঘটনায় নতুন একটা বানান চোখে বিঁধল– থাপ্পর। মাস্ক তো মাক্স হয়েই গেছে। পড়া, পরা। ভুরিভোজ-ভুঁড়িভোজ। এটা, এইটা না পাল্টালেই নয়?)
নিচের ছবিটা, নাইট-নিংড়ে যাওয়ার পর। আমার।