বললাম জামাই বাবু।সব শালা টাকা বোঝে বুঝলে।টাকা দিলে সব কিছুই হয়।ওরকম প্রথমে একটু না না করে তারপর টাকার কথা এলেই সব সিধে হলে যায়। কম তো দেখলাম না।বাইরে আবার বড়ো বড়ো করে লিখে রেখেছে এখানে “গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না “!ওসব ফাঁকি ।বুঝলে না। আইনের ফাঁক। হয়না আবার।নিজের চোখেই তো দেখলে।বাকি দিদি আর তোমার ব্যাপার।ভেবে দেখো তোমরা…
সদ্য আল্টাসনোগ্রাফি করে বেরিয়েয়েছে ওরা তিনজন। রিসেপশন থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতে আসতে কথাগুলো বলছিল অয়ন ওর জামাই বাবু সাগ্নিক কে। অয়ন এর দিদি অয়ন্তিকা কিছুটা আনমনে শুনছিল অয়নের কথা গুলো। তেরো বছর বিয়ে হয়েছে। একটাই মেয়ে ওদের।এবারে ক্লাস নাইন এ উঠেছে। মাঝে মাঝে দু এক মাস বন্ধ থাকত আবার ব্লিডিং শুরু হতো। কোনো সমস্যা হয়নি।কিন্তু এবারে সকাল বেলা কদিন বমি হওয়াতে একটু সন্দেহ হয়েছিল।ডাক্তার দেখাতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে ধরা পড়লো। চেক আপ করে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন প্রেগন্যান্সি মাস তিনেক মনে হচ্ছে ।একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে নিন আর কিছু প্রাইমারি টেস্ট দিচ্ছি।সাথে ওষুধ গুলো খান।টেস্ট হলে দেখিয়ে যাবেন।কোনো চিন্তা করবেন না।একটু সাবধানে থাকুন।ভারী জিনিস তুলবেন না।বেশি সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করবেন না।
তারপর থেকে ওরা দুজন ঠিক করেছিল এই সন্তানকে রাখবে না । অয়নের সাথে আলোচনা করতে অয়ন বলেছিল সিদ্ধান্ত যখন নিচ্ছো সে তোমাদের ব্যাপার তবে আমার একটা সাজেশন আছে…একবার দেখা হোক এবারের টা ছেলে না মেয়ে।সাগ্নিক ভ্রু কুঁচকে বলেছিল ” কিন্তু করবে কোথায়?এখন চারিদিকে যা ধর পাকড় হচ্ছে ভালো কোথাও করা যাবে কিভাবে!” একথা শুনে অয়ন বলেছিল ” আমার ওপর ছেড়ে দাও।আমার এক পরিচিত রেডিয়োলজিস্ট আছেন । আশাকরি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বাড়ি ফিরে রাতে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অয়ন্তিকা বললো “কি গো কি ভাবছো !”
বালিশে ঠেস দিয়ে সাগ্নিক বললো “কি আবার ভাববো।নিয়ে নাও। হাজার হোক ডাক্তার যখন বলেছেন এবারের টা ছেলে এ সুযোগ ছাড়াটা ঐতিহাসিক ভুল হয়ে যাবে না !”
” সে তো ঠিক আছে কিন্তু এতটা গ্যাপ মাঝে। আমি পারবো তো। তাছাড়া মনার বয়স এখন তেরো।ও কি মানিয়ে নিতে পারবে!”
“আলবাত পারবে। কেনো পারবে না। আমি কিন্তু চাই। দেখলে তো অয়ন কেমন ব্যবস্থা করে দিলো। সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত । ডাক্তার ই বা বাদ যাবে কেনো। ডাক্তার না ডাকাত! হা হা !”
” এরম বলোনা। আইনের জাঁতাকলে ওরাই বা কি করবেন। তাছাড়া ভুলে যেওনা উনি করেছেন বলেই কিন্তু আমরা আবার ভাবতে বসেছি প্রেগন্যান্সি টা রাখবো কিনা।সেটা একবার ভেবো।”
“তাহলে কি ঠিক করলে!সেটা তো বলো।রাত অনেক হলো।কাল অফিস যেতে হবে নাকি!এবার ঘুমাবো।ফাইনাল কি বলছো বলো।নাহলে আবার গাইনি ডাক্তার কে ধরতে হবে।তার আবার কি ফিরিস্তি! ডিসিশন তাড়াতাড়ি না নিলে তোমার শারীরিক আর আমাদের অর্থনৈতিক চাপটা কিন্তু বাড়তে থাকবে। কম্প্লিকেসান ও বাড়বে।”
“আমি আর কি করবো। তোমরা যখন বলছো….”
মাঝের মাস ছয়েক কেবল ওষুধ ডাক্তার সোনোগ্রফি। তেমন অসুবিধে হয়নি। কথামত সিজার হওয়ার দিন এসে গেলো। ওটিতে ঢোকার আগে সাগ্নিক অয়ন্তিকার হাত ধরে বললো” ডোন্ট ওরি! সব ঠিক থাক হবে।আমরা তো আছি।তাছাড়া ডক্টর মণ্ডল অভিজ্ঞ গাইনেকলোগিস্ট।কোনো অসুবিধা হবে না।”
সিজার টেবিলে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন “দেখুন…বলুন ছেলে না মেয়ে”।জানা সবই ছিলো তবু একবার দেখা।অপত্যের প্রথম দেখা। সামান্য একটু ঘাড় তুলে মুহূর্তে নেমে এলো অয়ন্তিকার।এবারে নার্স বললেন কি ম্যাডাম বলুন…ঝাপসা চোখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ” মেয়ে”
কালবৈশাখী ঝড়ের আগে এমন হয়। জোর একপশলা বৃষ্টির পরে এমন হয়। নিঃশব্দ।নিস্তব্দ।নিশ্চল। নার্সিং হোম থাকাকালীন বিশেষ কেউ আসেনি। অয়ন ছাড়া।প্রতিদিন আপিস ফেরত এসেছে। খেলনা এনেছে। এবং হাসিমুখে সারাক্ষণ আদর করেছে। সাগ্নিক শুধু একবার অয়ন কে বলেছিল” কি যে হলো। ডাক্তার তো বলেছিল ছেলে” সান্ত্বনা দিয়ে অয়ন বলেছিল “সে তো বলেছিল।কিন্তু সত্যি টাকে মেনে তো নিতেই হবে। শালা জোচ্চোর। বেআইনি প্রসেডিওর করলো।টাকাও নিলো। আবার ডায়াগনসিস ভুল করলো। অসহ্য। কি আর করবে জামাই বাবু। এতো ভেঙে পড়ার কিছু নেই।মনা কে কি তোমরা ভালোবাসনা। ও কি কোনো কিছুতে ছেলেদের থেকে কম যায়। দেখবে ছুটকি টাও ভালো হবে।”
আজ রবিবার। ডাক্তার লাহিড়ী কে কি পাওয়া যাবে! দোনামোনা করে ডায়াল করলো অয়ন…ক্রিং ক্রিং…ক্রিং ক্রিং… “হ্যালো ! কে বলছেন”
“ডক্টর সান্যাল আমি অয়ন বলছিলাম। চিনতে পারছেন ! মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ ! চিনবনা কেনো।বলো অয়ন।আরে মোবাইল চেঞ্জ করেছি।নাম্বার টা ছিল না।তুমি তো আর এলেই না এদিকে।”
“আসলে স্যার আমার জোন চেঞ্জ হয়েছে। এখন মার্কেটিং ম্যানেজার।আসানসোল রিজনে।
আরিবাস! কনগ্রাচুলেশন ! বলো আর কি খবর”
“স্যার।দিদির ডেলিভারি হয়েছে।একটা মেয়ে হয়েছে। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো।আপনি না থাকলে আজ ও পৃথিবীর আলো দেখতো না।”
“আরে এ আর কি ব্যাপার। সে ক্রেডিট তো তোমাকেই দিতে হয়। প্ল্যান টা তো তুমি করেছিল।”
“তা হলেও। আপনাকে প্রচুর খারাপ দেখাতে হয়েছে ওদের চোখে। খুব গাল মন্দ ও করেছি আপনাকে। মাফ করবেন স্যার”
“আমি কিছু মনে করিনি অয়ন। খুব খুশি ।ভালো থেকো।যোগাযোগ রেখো”
ফোন রেখে অয়নের মনটা খুশিতে ভরে গেলো। ছ মাস আগে মনে পড়ে গেলো ডক্টর লাহিড়ীর সাথে কথোপকথন গুলো
“স্যার ! আমাকে একটা হেল্প করতে হবে”
“কি হয়েছে বলো।তোমাকে তো এত চিন্তিত দেখি নি।ব্যাপার কি”
“স্যার ! আমার দিদি প্রেগন্যান্ট কিন্তু ওরা বাচ্চা টাকে রাখতে চায় না। আবর্ট করবে। আপনি পারেন বাঁচতে।”
“আরে কি করতে হবে সেটা বলো।”
“স্যার আমি ওদের কে রাজি করিয়েছি।আপনার কাছে আনতে। আপনি শুধু আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার পর বলবেন এবারে ছেলে হবে। এটুকু মিথ্যে বললে বাকিটা আমি সামলে নেবো। স্যার প্লিজ। শুধু আপনি পারেন বাচ্চাটা কে বাঁচাতে!”
কিছুক্ষণ চিন্তা করে ডক্টর লাহিড়ী বলেছিলেন ‘হ্যা আমি রাজি। একটা ভ্রূণ বাঁচতে এটুকু মিথ্যে আমি বলবো…”
চোখের কোনটা চিক চিক করছে অয়নের।ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ না করেও একজন ডাক্তার শুধু একটা ভ্রূণ বাঁচাতে কেমন অবলীলায় ওর দিদি জামাইবাবুর চোখে অপরাধী হয়ে গেলো!