প্রতিদিন তিন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন মিনতিদি। আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি বাড়িতে বাড়িতে ঘর মোছা, বাসন মাজা, জল তোলার কাজ করে এসেছেন। গত পাঁচদিন ধরে মিনতিদি’র কাজ বন্ধ। কাজ করবেন কিভাবে, ভালোভাবে হাঁটাচলাই তো করতে পারছে না। হাঁটুতে তীব্র ব্যথা, একটা হাঁটু ফুলে আছে। হাসপাতালের আউটডোরে দেখালে কিছু রক্তের পরীক্ষা আর হাঁটুর এক্স রে করিয়ে জানা যায়, অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন এখন থেকে আর ভারি ওজনও তোলা যাবে না, হাঁটু মুড়ে কাজও করা যাবে না।
হাঁটু ব্যথার সমস্যা প্রায় সব বয়সের মানুষেরই হতে পারে। নানাবিধ কারণে এই সমস্যা হয়। তবে বয়সভেদে আলাদা আলাদা কারণ রয়েছে। আমাদের হাঁটুর মধ্যে হাড় ছাড়াও রয়েছে মেনিসকাস, বারসা, লিগামেন্ট, তরুনাস্থি, মাংসপেশী। যে কোনো কারণে এগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা প্রদাহজনিত কারণে হাঁটুর ব্যথা হতে পারে। এছাড়া মেকানিক্যাল সমস্যা, জীবাণু সংক্রমণ বা অস্টিওপোরোসিস এর কারণেও ব্যথা হতে পারে। বয়স বেশি হলে এমনিতেই হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, তার ওপর শরীরের সমস্ত ওজন হাঁটুকেই বহন করতে হয়; তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর ক্ষয়জনিত কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হবার সম্ভাবনা বাড়ে। আর যাঁরা ভারি ওজন তোলার কাজকর্ম করেন তাঁদের বার্ধক্যের অনেক আগেই এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এই লেখায় হাঁটু ব্যথার সমস্যার প্রধান প্রধান কিছু কারন এবং চিকিৎসার ব্যাপারে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করব।
- আঘাতজনিত কারণে অনেক সময় হাঁটুর মাংসপেশী এবং লিগামেন্ট আংশিকভাবে ছিঁড়ে যায়। এইরকম অবস্থাকে Knee Sprain বা Strain বলা হয়। এক্ষেত্রে পরিমিত বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সঙ্গে বরফের প্যাক দিয়ে সেঁক, ইলাস্টিক কম্প্রেশন বা knee cap, ব্যথা কমার ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- আমাদের হাঁটুর ভিতরে দু’দিকে দুটো স্থিতিস্থাপক, তরুণাস্থি দিয়ে তৈরি মেনিসকাস থাকে, যা হাড়ের মধ্যে কুশনের কাজ করে। আঘাতজনিত কারণে বা ক্ষয়ের দরুন মেনিসকাস ইনজুরি হলে হাঁটু ফুলে যায় এবং তীব্র ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে আর্থোস্কোপির সাহায্যে মেনিসকাস রিপেয়ার করতে হয়।
- হাঁটুর বাইরের দিকে দুইপাশে Medial Collateral Ligament এবং Lateral Collateral Ligament থাকে। আর ভিতরের দিকে থাকে Anterior Cruciate Ligament এবং Posterior Cruciate Ligament। খেলাধুলার সময় বা আঘাতের কারণে অনেক সময় এই সমস্ত লিগামেন্ট আংশিক বা পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপারেশনের মাধ্যমে লিগামেন্ট রিপেয়ার বা রিকনস্ট্রাকশন করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না।
- হাঁটুর অস্থিসন্ধির চারপাশে অনেক ছোট ছোট বারসা (Bursa) থাকে। এগুলো তরলে পরিপূর্ণ থলিবিশেষ, যা টেন্ডনের চলাফেরাকে মসৃণ করতে সাহায্য করে। ঘর্ষণ জনিত কারণে অনেক সময় এই বারসা গুলিতে প্রদাহ হয় এবং ফুলে যায়। এইরূপ অবস্থাকে বলা হয় বারসাইটিস্। এক্ষেত্রে বারসা থেকে অতিরিক্ত তরল বের করে নেওয়া যায় বা ইনজেকশন এর মাধ্যমে বারসার ভিতরে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
- অনেক সময় আঘাতজনিত কারণে হাড় বা তরুণাস্থির ছোট অংশ ভেঙে গেলে ওই ভাঙা অংশটি হাঁটুর অস্থিসন্ধির মধ্যে আটকে পড়ে মেকানিক্যাল সমস্যা তৈরি করে। এগুলিকে ‘ লোজ বডি’ বলা হয়। অনেক সময় এই লোজ বডির কারণে হাঁটুর লকিং আনলকিং ব্যাহত হয়, ফলস্বরূপ স্বাভাবিক হাঁটাচলা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে লোজ বডি বের করতে হয়।
- হাঁটুর বাটি সরে গেলেও হাঁটু ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে মেকানিক্যাল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তখন হাঁটুর বাটি পূর্বের সঠিক জায়গায় বসানোর পর ৩-৪ সপ্তাহ প্লাস্টার করে রাখতে হয়। কখনো কখনো অপারেশনের প্রয়োজনও পড়তে পারে।
- হাঁটু ব্যথা ও ফুলে যাওয়ার প্রদাহজনিত কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস, রিউমেটিক আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউট, সিউডোগাউট, সেপটিক আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি।
- জীবাণু সংক্রমণের কারণে হাঁটু ব্যথার সমস্যা হলে পরিমিত বিশ্রামের পাশাপাশি সেনসিটিভিটি অনুযায়ী সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দরকার পড়ে।
গাউট রোগে হাঁটুতে ইউরিক এসিড জাতীয় ক্রিস্টাল তৈরি হয় এবং ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে ব্যথা উপশমের ওষুধের পাশাপাশি ইউরিক এসিড কমানোর ওষুধ ব্যবহার করতে হয়।
রিউমেটিক এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নিরুপনের জন্য বিশেষ কিছু রক্তপরীক্ষা করতে হয়। রোগনির্ণয় হয়ে গেলে সেইমতো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার দরকার পড়ে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস মূলত হাঁটুর অস্থি ও তরুনাস্থির ক্ষয়জনিত একটি রোগ। আমাদের শরীরের যাবতীয় ওজন হাঁটুকেই বহন করতে হয়। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব যেমন কমতে থাকে, ক্ষয়ও বাড়তে থাকে। যাঁরা ভারি ওজন তোলার কাজকর্ম করেন তাঁদের বার্ধক্যের অনেক আগেই ক্ষয়ের শুরু হয়। সাধারণত এক্স রে করলেই এই রোগ নির্ণয় করা যায়। এক্ষেত্রে ভারি ওজন তোলার কাজ, হাঁটু মুড়ে বসা ইত্যাদি বন্ধ রাখতে হয়। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। প্রয়োজনমতো ব্যথা কমার ওষুধ ব্যবহার করতে হতে পারে। সঙ্গে গরম জলের সেঁক ও মালিশ কাজে আসতে পারে।
এছাড়া নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে হাঁটুর মাংসপেশী শক্ত করতে হয়। ব্যায়ামের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হাঁটুর নিচে একটি ভাঁজ করা তোয়ালে বা কুশন রেখে পায়ের পাতা টান টান করে ১০ সেকেন্ডের জন্য বসে থাকতে হবে। এরপর একই অবস্থান থেকে পায়ের পাতা স্বাভাবিক রেখে বিশ্রাম নিন। এই পদ্ধতিতে অন্তত ৫-১০ বার এই ব্যায়াম করতে হবে। দিনে ২-৩ বার এই ব্যায়াম করা যেতে পারে। একে কোয়াড্রিসেপস্ এক্সারসাইজ বলে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগে ভুগলে, হাঁটুর মধ্যে স্টেরয়েড জাতীয় ইনজেকশন বা হায়ালিউরোনিক অ্যাসিড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া আর্থোস্কোপির সাহায্যে অপারেশনের মাধ্যমে অস্টিওফাইট শেভিং করতে হতে পারে।