মাইগ্রেন হচ্ছে একটা মাঝারি থেকে তীব্র দপদপে মাথা যন্ত্রণা, এটা সাধারণত মাথার একদিকে হয়। কারোর কারোর মনে হয় সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারোর কারোর এই যন্ত্রণার সময় চোখে আলো পড়লে আরো কষ্ট বাড়ে। দেখা গেছে ৫ জনে ১ জন মহিলা এবং ১৫ জনে ১ জন পুরুষ মানুষের এই রোগ হয়। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রথম দিকে এই রোগের আক্রমণ শুরু হয়।
মাইগ্রেনের প্রকার ভেদঃ
১.অরা (aura) সহ মাইগ্রেন: এখানে একটা নির্দিষ্ট উপসর্গ দিয়ে যেন আগাম বার্তা দেওয়া হয় মাইগ্রেনের আক্রমণ আসছে। যেমন চোখের সামনে দিয়ে ঝটিতি একটা আলো চলে যায়। তারপর মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়।
২. অরা (aura) ছাড়া মাইগ্রেন: এটাই সবথেকে বেশী হয়। মাইগ্রেনের যন্ত্রণা শুরু হয় অরা ছাড়াই।
৩. মাইগ্রেন অরা( aura) কিন্তু মাথা যন্ত্রণা ছাড়া: এখানে অরা( aura) অর্থাৎ ওই হঠাৎ আসা উপসর্গটা আসে কিন্তু মাথা যন্ত্রণা হয়না।
মাইগ্রেনের সাধারণ উপসর্গগুলোঃ
১. প্রধান উপসর্গ হচ্ছে মাথার একদিকে তীব্র যন্ত্রণা।
২.সাধারণত যন্ত্রণা মধ্যম থেকে তীব্র মাত্রার হয় এবং দপদপে যন্ত্রণা হয়। কাজ কর্ম করলে বা হাঁটা চলা করলে যন্ত্রণা বাড়ে।
৩.কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রণা মাথার দুদিকেই হয়, সঙ্গে ঘাড় এবং মুখেও হয়।
মাইগ্রেনের অন্যান্য উপসর্গঃ
১.খুব অসুস্থ হওয়ার অনুভূতি।
২. আলো বা শব্দে অস্বস্তি বেড়ে যাওয়া। এই জন্যে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্ধকার শান্ত ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে পছন্দ করে।
কিছু কিছু মানুষ অন্য আর কিছু উপসর্গে ভোগেঃ
১.ঘাম।
২. মনোযোগের অভাব।
৩.খুব গরম বা শীতের অনুভূতি।
৪.পেট ব্যথা।
৫.পাতলা পায়খানা।
সবার এই অন্য উপসর্গ থাকে না। কারোর আবার এগুলোর সব বা দুই একটি থাকতে পারে কিন্তু মাথার যন্ত্রণাই থাকে না। মাইগ্রেনের উপসর্গ সাধারণত ৪ ঘন্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত থাকে তবে প্রায় ১ সপ্তাহ পর্যন্ত কেউ কেউ ক্লান্ত থাকে।
অরার ( aura) উপসর্গঃ
৩ জন মাইগ্রেন রুগীর মধ্যে একজনের অরা থাকে।
এগুলো হচ্ছে:
১. চোখে দেখার সমস্যা- হঠাৎ চোখের সামনে আলোর ঝলকানি, বা বিদ্যুতের মত ট্যারাব্যাঁকা আলোর উপস্থিতি।
২.অবশ বা পিন ফোটানো অনুভূতি, একটা হাত থেকে শুরু হয়ে মুখ, ঠোঁট, জিভে ছড়িয়ে যায়।
৩.মাথা ভোঁ ভোঁ করা।
৪.কথা বলতে অসুবিধে হওয়া।
৫. খুব বিরল ক্ষেত্রে মানুষটি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
অরার উপসর্গ ৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে কিছু মানুষের শুধু অরা হতে পারে কিন্তু মাথা যন্ত্রণা সামান্য হলো বা হলোই না।
মাইগ্রেনের কারণঃ
মাইগ্রেনের নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বোঝা গেছে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কাজের জন্যে স্নায়ু, রক্তবাহিকা, অন্যান্য রাসায়নিকের অস্বাভাবিক কাজ।
যে যে কারণগুলো বোঝা গেছে সেগুলো হলোঃ
১. হর্মোনাল- কিছু মহিলাদের মাসিকের সময় মাইগ্রেন হয়। তবে সাধারণত ২ দিন আগে এবং ৩ দিন আগে পর্যন্ত হয়। কারোর কারোর মেনোপজের পর মাইগ্রেন ভালো হয়ে যায় তবে অনেকের মেনোপজের পর শুরু হয়। এই সব কিছু থেকেই বোঝা যায় হর্মোনের ওঠানামার সাথে মাইগ্রেনের সম্পর্ক আছে।
২.আবেগ সম্পর্কিত – মানসিক চাপ, উদবেগ, অবসাদ, উত্তেজনা।
৩.শারীরিক কারণ- ক্লান্তি,কম ঘুম, কাজের সময় পরিবর্তন, কাজের সময় ভুল ভাবে বসা, ঘাড় বা কাঁধের ওপর বেশী চাপ পড়া, সুগার কমে যাওয়া, অনভ্যস্ত শারীরিক কসরত ইত্যাদি।
৪.খাদ্যাভাস সম্পর্কিত- একটা মিল না খাওয়া, উল্টোপাল্টা খাওয়া দাওয়া, মদ, কফি চা বেশী খাওয়া, শরীরে জলের অভাব, চকোলেট বা টক ফল বেশী খাওয়া।
টাইরামিন আছে এরকম খাবার– যেমন, কয়েক ধরনের চীজ ( স্টিলটন, কেমবার্ট ইত্যাদি), ইস্ট থেকে তৈরি খাবার, পিকল।
যদিও এই খাবারগুলো ব্যবহার আমাদের মল কালচারের সাথে সাথে বাড়ছে, তবে এখনো এগুলি বড় সমস্যা নয়।
৫. পরিবেশগত কারণ- উজ্জ্বল আলো, টিভি, কম্পিউটার স্ক্রিন, ধোঁয়া, তীব্র আওয়াজ, খুব ঠান্ডা বা আর্দ্রতা বেশী হয়ে যাওয়া। তীব্র গন্ধ। গুমোট আবহাওয়া।
৬. ওষুধ- কয়েক ধরনের ঘুমের ওষুধ, গর্ভ নিরোধী ওষুধ, মেনোপজের সমস্যা এড়াতে ব্যবহৃত হর্মোনাল ওষুধ।
মাইগ্রেনের স্টেজঃ
১.প্রোড্রোমাল বা যন্ত্রণাপূর্ব স্টেজ: এই সময় মানুষটির মেজাজের পরিবর্তন হয়, খিটখিটে বা উদবিগ্ন হয়ে যেতে পারে। শ্লথ হয়ে যায়, আচরণ বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এই দশা কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হতে পারে।
২.অরা স্টেজ: সাধারণত চোখের সামনে আলোর ঝলকানি বা এমন একটা বিন্দু দেখা মনে হয় অন্ধ হয়ে গেছি। এটা ৫ মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
৩.হেডেক স্টেজ: এটা হচ্ছে প্রকৃত যন্ত্রণা দশা। সাধারণত একটা দপদপে তীব্র মাথার যন্ত্রণা হয়। মাথার যে কোনো এক দিক দিয়ে শুরু হয়, সেদিকেই থাকতে পারে বা সারা মাথায় ছড়িয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে বমি ভাব, অসুস্থ লাগা, তীব্র আলো বা শব্দে বিরক্তি এসব থাকতে পারে। এই দশা ৪ থেকে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
৪.রেজলিউশান স্টেজ বা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া: এই সময় ধীরে ধীরে মাথা যন্ত্রণা এবং অন্যান্য উপসর্গ ঠিক হয়ে যায়। তবে অনেকের কয়েকদিন পর্যন্ত ক্লান্তি থাকে।
পরীক্ষা নিরীক্ষাঃ যেহেতু মাইগ্রেনের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই তাই ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় মাইগ্রেন ডায়াগনসিস করা যায় না। তবে মাথা যন্ত্রণা মস্তিষ্কের মধ্যের অনেক রোগের উপসর্গ হতে পারে যেমন টিউমার,সিস্ট, অ্যানিউরিজম,রক্তপাত ইত্যাদি। তাই প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান বা এম আর আই করে নেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে ই ই জিও করতে হয়।
চিকিৎসাঃ এমন কোনো ওষুধ নেই যাতে করে মাইগ্রেন একেবারে সেরে যাবে। তবে উপসর্গ কমানোর ওষুধ আছে।
চিকিৎসা দুরকমের:
১.যখন রোগের আক্রমণ হয়।
২.প্রতিরোধমূলক।
১.যখন রোগের আক্রমন হয়:
নানারকমের যন্ত্রণানাশী ওষুধ আছে।যেমন প্যারাসিটামল, আইবুপ্রফেন, অ্যাসপিরিন।
ট্রিপটান জাতীয় ওষুধ, যেগুলো মাইগ্রেনের জন্যে মস্তিষ্কের শিরায় রক্ত চলাচলে যে পরিবর্তন হয় সেগুলো স্থিতাবস্থায় নিয়ে এসে যন্ত্রণা ঠিক করে।
বমি কমানর ওষুধ।
এছাড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে অন্ধকার ঘরে ঘুমালে লাভ হয়।
২. প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাঃ
এটা আবার দুভাবে হয়।
ক. যে যে বিষয়গুলো অ্যাটাক শুরু করে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। যেমন, কফি, চকোলেট বা অন্য কোনো খাবার খেলে যদি অ্যাটাক হয়, সেগুলো না খাওয়া। মদ না খাওয়া। অতিরিক্ত এক্সারসাইজ না করা। যতটা সম্ভব চাপমুক্ত থাকা। তীব্র রোদ না লাগানো। জল কম না খাওয়া। বেশী রাত না জাগা।ইত্যাদি।
খ.ওষুধঃ
টপিরামেট, সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট। এই দুটি ওষুধ মৃগীরোগে ব্যবহৃত হয়। তবে মাইগ্রেন প্রতিরোধে কাজ করে।
এছাড়া প্রোপ্রানলল। এই ওষুধটি উচ্চ রক্তচাপে ব্যবহৃত হয় এবং মাইগ্রেন প্রতিরোধে কাজ করে।
আর আছে অ্যামিট্রিপ্টিলিন। এই ওষুধটি অবসাদ রোগের ওষুধ, এবং মাইগ্রেন প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
মাইগ্রেন রোগটি সারে না। তবে উপরের বিষয়গুলো মাথায় রাখলে রোগের প্রকোপ থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যায়।
Nausea/vomiting o hoe.