“আরে কি যে বলেন ডাক্তার বাবু! শেষে কিনা জুতো নিয়ে পড়লেন?” মিত্র বাবুর ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি উঁকি দিল।
বৃদ্ধ রোগীর কথাতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না অভিজ্ঞ ফিজিয়াট্রিস্ট। তিনি মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে থাকলেন মিত্র বাবুর জুতো জোড়া।
খুব কাছে গিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করতেই মিত্র বাবু আঁতকে উঠলেন, “পুরোনো জুতো… পরিষ্কারও করা হয় নি বেশ কিছু দিন। আপনি প্লিজ হাত দেবেন না!”
ডাক্তার বাবু গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, “জুতো অপরিষ্কার থাকলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু জুতো বেশি পুরনো হয়ে গিয়ে হিল, সোল, টো-বক্স যদি ঠিক না থাকে তাহলে মুশকিল।”
মিত্র বাবু কষ্ট পাচ্ছেন বেশ কয়েকমাস ধরে। পায়ের পাতার সামনের দিকের অংশে ব্যথা, বেশিক্ষণ হাঁটতেই পারেন না। তবে শুয়ে বসে থাকলে ব্যথা খুব একটা হয় না। চাকরি থেকে অবসরের পর কাজ বিশেষ নেই। তবে একঘেঁয়েমি কাটাতে সকাল বিকেল হাঁটতে বের হন। কিন্তু ইদানিং ব্যথা এতটাই বেশি হয়েছে যে আর বেরোতেই পারছেন না। এর আগে দু তিন জায়গায় দেখিয়েছেন কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নি। রিপোর্টেও সেরকম কিছু ধরা পড়েনি। গাঁট ফোলা বা লাল হওয়া এসব কিছু না থাকলেও শুধুমাত্র এই ব্যথাই তাঁকে কাবু করে রেখেছে।
সম্বিৎ ফিরলো ডাক্তার বাবুর কথায়, “প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাবেন আর জুতো বানিয়ে নেবেন।”
“জুতোরও প্রেসক্রিপশন!” অস্ফুটে বলে উঠলেন মিত্র বাবু।
ডাক্তার বাবু খুব শান্ত স্বরে বললেন, “সারাজীবন আপনার শরীরের সব ভার যে বয়ে বেড়ালো তার স্বাস্থ্যের কথা কি একবারও ভাববেন না?”
–“সেটা অস্বীকার করছি না… কিন্তু এই প্রেসক্রিপশন কি জুতোর দোকানে দেখাবো?”
–“আরে না না…ওরা এসব বুঝবে না। মেডিসিনের দোকানে যেমন প্রেসক্রিপশন দেখালে ওষুধ দেয়, সেরকম সার্জিক্যাল দোকানে এটা দেখালে ওরা পায়ের মাপ নিয়ে আপনার জন্য নির্দিষ্ট জুতো বানিয়ে দেবে। মনে রাখবেন কোনো নির্দিষ্ট রোগের জন্য যেমন নির্দিষ্ট ওষুধ লেখা হয়, সেরকমই কোনো নির্দিষ্ট রোগের উপশমে নির্দিষ্ট জুতোও খুব জরুরী। বাজারের সাধারণ জুতো পড়লে যেমন ওই রোগ সারবে না, তেমনি ওই নির্দিষ্ট জুতো অন্য কেউ পরলেও তার ক্ষতি হতে পারে।”
সব বুঝে নিয়ে মিত্র বাবু ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। তার মধ্যেই একজন মধ্যবয়স্কা স্থূলকায় ভদ্রমহিলা দ্রুত বেগে ভিতরে প্রবেশ করলেন। পর্দা সরিয়ে বেড়িয়ে আসার মুহূর্তে মিত্র বাবু শুনতে পেলেন মহিলার কণ্ঠস্বর। একমুখ তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলছেন, “ডাক্তার বাবু আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই জুতো পরে আমার সব ব্যথা উধাও।”
হাউসওয়াইফ সাবিনা ইয়াসমিন ঘরের কাজ আর ছেলেদের দেখাশুনা করতেই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু গোড়ালির তলায় ব্যথাটা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোগটা পুরনো হলেও আগে ওষুধ খেলে কমতো। কিন্তু এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওজনও বাড়ছে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গোড়ালির ব্যথাটাও। বার দুয়েক ইনজেকশনও নিয়েছেন, কিন্তু ব্যথা আবার ঘুরে ফিরে আসছে। শেষে এই ডাক্তার বাবুর কাছে আসা। উনি তো প্রথম দিন পা ভালো করে দেখেই জিজ্ঞাসা করেন, “কী জুতো ব্যবহার করেন?”
ভদ্রমহিলা অনেক আগেই কোথাও শুনেছিলেন হাইহিল জুতো একদমই ভালো নয়। তখন থেকেই তিনি ওই সব জুতো ছেড়েছেন এবং হাওয়াই চটিকেই বেশি ভরসা করেছেন।
কিন্তু ডাক্তার বাবু সব শুনে খুব বিষন্ন স্বরে বললেন, “হাওয়াই চটি পশ্চিমবঙ্গে যতই প্রাসঙ্গিক হোক না কেন, আপনার জন্য কিন্তু একেবারেই স্বাস্থ্যকর না।”
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ডাক্তার বাবু একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “আপনার ভিজে পায়ের ছাপ দেখবেন অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মত… বড়দের যেটা থাকে না কারণ আপনার ফ্ল্যাটফুট আছে। তাই জুতোর সাথে মিডিয়াল আর্চ সাপোর্ট থাকাটা যেমন দরকার, তার সাথে কুশন্ড হিল না থাকলেও ব্যথা পুরোপুরি কমবে না।”
–“কিন্তু ডাক্তার বাবু এক্স রে তে যে গোড়ালির হাড় বেড়েছে বলছে… ওটা অপারেশন করতে হবে না?”
–“আরে না না… ওটা ক্যালকেনিয়াল স্পার…ওটার জন্য ব্যথা হচ্ছে এমন নয়, বরং ব্যথা বেশিদিন সহ্য করার জন্য ওটা হয়েছে। দীর্ঘদিন প্লান্টার ফ্যাসাইটিসে ভুগলে ওই জায়গায় ক্যালসিয়াম জমে ওরকম আকার নিয়ে থাকে। ওর ব্যবস্থাও জুতোর হিলেই করা আছে।”
–“তাহলে বলছেন ওই জুতো পরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”
–“ওষুধ, ব্যায়াম…প্রয়োজনে ইনজেকশন… এগুলো তো চলবেই। সাথে আপনাকে এই প্রেসক্রিপশন করা বিশেষ জুতো পরতেই হবে।”
আজ ভদ্রমহিলাকে বেশ উৎফুল্ল দেখে ডাক্তার বাবু প্রশ্নটা ছুঁড়েই দিলেন, “জুতো আবিষ্কারের কারণ জানেন?”
ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর কিশোর পুত্র উত্তর দিল, “পায়ের ধুলো।”
উত্তর শুনে ডাক্তার বাবু কিছুক্ষণের জন্য হতচকিত হয়ে গেলেন। ছেলেটি তারমধ্যে বলে চললো, “কেন আপনি রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ পড়েননি? হবু চন্দ্র রাজার পা ধুলোর হাত থেকে বাঁচাতে গোবু চন্দ্র মন্ত্রীর সেকি করুণ অবস্থা! শেষে এক বৃদ্ধ চর্মকার এসে জুতো বানিয়ে দেয়।”
রসিক ডাক্তার বাবু মুচকি হেঁসে বলে ওঠেন, “তারপর কী কাণ্ড হয়েছিলো জানো? সেই জুতো পরে সবাইকে দেখাবেন ঠিক করলেন রাজামশাই। বহুদিন পর রাজা রাজপথে হাঁটবেন শুনে প্রজারা ভিড় করে দুই ধারে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ অতিভক্তি দেখানোর জন্য রাজপথ গঙ্গাজলে ধুয়ে দিয়েছে, যাতে সামান্য ধুলোতেও রাজা বিব্রত বোধ না করেন। তার ওপর অনেকে পুষ্পবৃষ্টি শুরু করে দিল। এতে রাজপথ একদম পিচ্ছিল হয়ে গেল। রাজা যেই পা ফেললেন রাস্তায়, অমনি পালিশ করা চামড়া মোড়া পা পিছলে গেল। আর রাজা সবার সামনে হলেন চিৎপটাং। তারপরই তো জুতোতে হিল আর সোল করা হল।”
–“আমার জুতোতে হিল সোল আছে।” একঝলক পায়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বললো।
–“আরে তুমি তো জুতোর কলার তুলে চোখগুলো এতো শক্ত করে বেঁধে রেখেছ যে গলা থেকে জিভ বের করতেই সাহস পাচ্ছে না বেচারা জুতো জোড়া!”
_________
কবিগুরুর কল্পনা আশ্রিত ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় যে কাহিনীই লেখা থাক না কেন, তথ্যসূত্র কিন্তু বলছে পনেরো হাজার বছর আগের এক গুহাচিত্র থেকে জানা গেছে যে আদিম মানব পায়ে পশুর চামড়া জড়িয়ে রাখতো। যদিও এশিয়া মহাদেশে কাঠের খড়মের প্রচলন ছিল প্রাচীন কাল থেকেই। ইতিহাস যাই বলুক না কেন, জুতোর ব্যবহার যে পায়ের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এমনকি ভারতে খুবই জনপ্রিয় এক জুতো নির্মাতা সংস্থার স্বাধীনতার আগের এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় টিটেনাস থেকে বাঁচতে জুতো পরার পরামর্শ। প্রতিরক্ষা ছাড়াও ব্যথাহীন ভাবে শরীরের ভার বহন, দুর্বল ও বিকৃত পায়ের চিকিৎসা এবং প্রসাধনের জন্যও জুতো এখন অত্যাবশ্যক।
জুতো সাধারণত বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বুট (যার টপলাইন অ্যাঙ্কেল জয়েন্টের ওপরে থাকে), অক্সফোর্ড স্যু (যার টপলাইন অ্যাঙ্কেল জয়েন্টের নিচে থাকে এবং ফিতে দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা থাকে), মিউল বা স্লিপার, স্যান্ডেল (যার পিছনের ও ওপরের অংশ ঢাকা থাকার বদলে স্ট্র্যাপ থাকে), কোর্ট বা পাম্প সু, অ্যাথলেটিক সু বা স্নিকার্স। এরমধ্যে স্যান্ডেলের ব্যবহার এশিয়া ও আফ্রিকাতে বেশি। এছাড়াও ইন-ডেপথ সু (অর্থোসিসের সাথে), মল্ডেবেল সু, কাস্টম সু রিহ্যাব ফিজিশিয়ানরা প্রয়োজন অনুযায়ী প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
একটা স্ট্যান্ডার্ড জুতোতে হিল, সোল ও তাদের মাঝে স্যাংক থাকা ছাড়াও সামনে থেকে পিছনের দিকে পর্যায় ক্রমে যে অংশগুলো থাকে, সেগুলো হল টো-বক্স, ভাম্প, থ্রোট, আইলেটস, টাং, কোয়ার্টার, কলার, কাউন্টার।
প্রতিরক্ষার জন্য অবশ্যই জুতোকে পায়ের গোড়ালি থেকে আঙুল অব্দি সুন্দরভাবে ফিট হওয়া উচিত। অর্থাৎ দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় পায়ের পাতা ও আঙুল যাতে পর্যাপ্ত জায়গা পায় সেটা দেখতে হবে। সাধারণত জুতোর ভিতরে সবথেকে লম্বা আঙুলের থেকে এক সেন্টিমিটার বেশি ফাঁক রাখা হয় এবং সবথেকে প্রশস্ত অংশ যেন জুতোর সবথেকে চওড়া অংশে থাকে সেটার ওপরও নজর দেওয়া হয়। ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ রোগের মতো যেসব ক্ষেত্রে পায়ের যত্ন বিশেষ ভাবে নেওয়া দরকার, সেসব ক্ষেত্রে নিয়মিত জুতো পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কোনো অংশ ছিঁড়ে বা ক্ষয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ জুতো পাল্টানো উচিৎ। নাহলে অচিরেই পায়ের ওই ‘রক্ষকই ভক্ষক’ হয়ে দাঁড়াবে।
আমরা যেকোনো সাধারণ জুতো ব্যবহার করলেও যাদের পায়ে বিভিন্ন সমস্যা আছে তাদের বিশেষ ধরনের জুতো ব্যবহার করতে বলা হয়, যাকে মেডিক্যালের ভাষায় ‘সু মডিফিকেশন’ বলা হয়। হিল বা সোলে প্রয়োজন অনুযায়ী ওয়েজিং, ফ্লেয়ার, এলিভেশন কিংবা রকার বা মেটাটারসাল বার লাগানো হয়। লক্ষ্য রাখা হয় ব্যথার জায়গাগুলোর ওপর চাপ কমিয়ে অন্য অংশগুলোর ওপর চাপ সুবিন্যস্ত করা। তারজন্য বেশিরভাগ স্পোর্টস সু-তে রকার থাকে। এতে একদিকে সোল যেমন নরম ও সহনশীল হয়, সেরকম দুর্বল ও বিকৃত পায়ের ক্ষেত্রে হাঁটা অনেক সুবিধাজনক হয়ে ওঠে। শুধু গোড়ালি বা পায়ের পাতা না হাঁটুর ডিফর্মিটির উপশমেও সু মডিফিকেশনের প্রয়োজন হয়। কোনো রোগের উপশমের জন্য যেমন নির্দিষ্ট ওষুধের প্রয়োজন হয়, সেরকম নির্দিষ্ট জুতোও ব্যবহার করতে হয় চিকিৎসকের পরামর্শ মত।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে অন্য আরও বিষয়ের মত জুতো নিয়েও সচেতনতার বড় অভাব রয়ে গেছে। বাইরে বের হওয়ার সময় জুতো প্রায় সবশ্রেণীর মানুষ পরলেও পরামর্শ মতো বিশেষ জুতো বানানোর ওপর অনেকেই গুরুত্ব দেন না, বা বানালেও সেটা বেশিরভাগ সময় পরার প্রয়োজন বোধ করেন না। তাই জুতো নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরী।
Darun..
দারুন।